আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
জাভেদ আখতার তাঁর ট্যুইটার অ্যাকাউন্টে হিন্দি সিনেমার পাঁচ নায়িকার অভিনয়কে ‘মাইলস্টোন’ আখ্যা দিয়েছেন।
১. ‘মাদার ইন্ডিয়া’র নার্গিস
২. ‘সাহেব, বিবি অউর গুলাম’ য়ের মীনাকুমারী
৩. ‘বন্ধন’য়ের নূতন
৪. ‘অর্থ’-য়ের শাবানা আজমি
৫. ‘হাইওয়ে’র আলিয়া ভট্ট
নার্গিস, মীনাকুমারী, নূতন, শাবানা আজমি এঁরা সবাই কিংবদন্তি অভিনেত্রী। কিন্তু ইমতিয়াজ আলির ছবিতে আলিয়া ভট্ট? ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’য়ে জেনিফার কেন্ডাল অভিনীত ভায়োলেট স্টোনহ্যাম-য়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। তার পরের প্রজন্মের অভিনেত্রীরা? ‘অস্তিত্ব’র তব্বু, ‘ইশকিয়া’র বিদ্যা বালন, ‘দেব ডি’র মাহি গিল, ‘গ্যাংস অব ওয়াসেপুর’য়ের রিচা চড্ডা, ‘পেজ থ্রি’র কঙ্কনা সেনশর্মা, ‘বিএ পাস’য়ের শিল্পা শুক্ল আর ‘দেড় ইশ্কিয়া’র হুমা কুরেশি এঁদের সবাইকে পিছনে ফেলে জাভেদ বেছে নিলেন আলিয়াকে।
কেন?
কী এমন রয়েছে আলিয়ার অভিনয়ে? কী এমন রয়েছে তাঁর চরিত্রে যার কারণে তিনি এই তালিকায়?
মহেশ ভট্ট আর সোনি রাজদানের কন্যা আলিয়া। বয়স মাত্র ২০। অভিনয়ের হাতেখড়ি কর্ণ জোহর প্রযোজিত ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ দিয়ে। তবে সে ছবির সানায়ার সঙ্গে ‘হাইওয়ে’র ভীরার কোনও মিলই নেই। সানায়া তো দেখনদারিতে বিশ্বাসী। নাচগানেই তার দিন কেটে যায়।
অনেকেই ভেবেছিলেন যে আলি হয়তো সানায়ার মতো চরিত্র বেছে নেবেন। স্টার কিডরা সচরাচর যেমনটা করে থাকেন। কিন্তু ‘হাইওয়ে’ সেই ধারণাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। ভীরার চরিত্রে আলিয়ার একমাত্র পোশাক হল তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা।
মেক আপ-য়ের লেশমাত্র নেই তাঁর মুখে। ডান গালে ছড়ে যাওয়া রক্তের দাগ। ছবির আশি ভাগ সময় তাঁর পরনে একটা লাল টি-শার্ট, ঢোলা পাজামা আর একটা শাল। সিনেমার শেষের দিকে, যখন কাশ্মীর হয়ে ওঠে ছবির পটভূমি, তখন গায়ে চাপিয়ে নেন কিছু ছেঁড়া ফাটা উলের জামাকাপড়।
কেরিয়ারের দ্বিতীয় ছবিতে এসে এমন একটা চরিত্র বেছে নেওয়াও সাহসের কাজ। তবে সাহসে তাঁর থেকেও কম যান না ইমতিয়াজ যিনি এমন একটা চরিত্র লিখেছেন।
বেশির ভাগ বলিউড চিত্রনাট্যেই নায়িকারা যত সাহসীই হোন না কেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা আবার ফিরে আসেন চেনা গণ্ডির মধ্যেই। নায়িকারা প্রতিবাদ হয়তো করেন। নিজের মনের কথা শোনেন। কিছুটা পথ নিজেদের মতো করে হাঁটেনও। কিন্তু ছবির শেষে যাকে বলে ‘ব্যাক টু স্কোয়্যার ওয়ান’। সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল ‘অর্থ’। শাবানা আজমি অভিনীত পূজা চরিত্রটি ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র। ভিতু পূজা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পাল্টায়। নতুন করে নিজের জীবনটা গড়ার স্বপ্ন দেখে। যখন দ্বিতীয় বার তার জীবনে প্রেম আসে, সেটাও সে প্রত্যাখ্যান করে। তবে সেই সিদ্ধান্তের মধ্যে কিন্তু পুরুষ-বিদ্বেষ নেই। আছে শুধু নিজের মতো করে বাঁচার সাধ।
তবে সে যুগেও এই রকম ভাবে চিত্রনাট্যটা শেষ করার জন্য পরিচালক মহেশ ভট্টকে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। অনেক দিক থেকেই চাপ ছিল যাতে ক্লাইম্যাক্সে পূজাকে আবার তার স্বামীর কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু মহেশ তা করেননি। তাতে অবশ্য বক্স অফিস সাফল্য আসেনি। তবে পরিচালক হিসেবে অনেক প্রশংসা পেয়েছিলেন। “আমি চাইনি যে শাবানা নিজের স্বামীর বিছানা ছেড়ে শেষে প্রেমিকের বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেটা করলে শাবানার চরিত্রটার উত্তরণই ঘটত না! ‘মার্ডার’য়ে মল্লিকা শেরাওয়াতকে যতই সাহসী বলা হোক না কেন, শেষে কিন্তু ও স্বামীর কাছেই ফিরে যায়। যখন ‘হাইওয়ে’ দেখলাম, তখন ‘অর্থ’য়ের শেষটার কথাই মনে পড়ছিল। ‘হাইওয়ে’র শেষটা সাহসী।”
সেই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছোতে গিয়ে ইমতিয়াজও পারতেন গতানুগতিক ভাবেই চরিত্রটা লিখতে। হাইওয়েতে অপহরণ কাণ্ডের রোমাঞ্চ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে তো ভীরাকে আবার তার চেনা গণ্ডিতেই ফিরিয়ে আনা যেত। অন্য দুনিয়ার স্বাদ পাওয়া হয়েই গিয়েছে। এ বার বক্স অফিস জয় করার জন্য নায়িকাকে তো ফিরতেই হবে চার দেওয়ালের দমবন্ধ করা পরিবেশে। হয়তো মাঝেমধ্যেই ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ত। কিন্তু ও টুকুই।
তবে ইমতিয়াজ সে পথে হাঁটেননি। “আমার মনে হয় যখন আমরা সমাজের গণ্ডি ছেড়ে এক বার বাইরে চলে যাই, তখন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে যায়। ভীরা অপহৃত হওয়ার ঠিক পরেই বেশ খুশি ছিল এই ভেবে যে বাড়ির দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে ও বেরিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর স্বাধীনচেতা মন বুঝতে পারে যে, ও আর বাড়ি ফিরে গিয়ে খুশি থাকতে পারবে না। শি বিকামস আ ফ্রি থিঙ্কিং বডি। শেষে ফিরে গিয়ে ও বোঝে যে এটা আর ওর জায়গা নয়।”
তবে ভীরা যখন ওর সব থেকে ভরসার মানুষটাকে হারায়, তখন কি ইমতিয়াজের কোনও প্রলোভন ছিল না, ‘সেফ এন্ডিং’য়ের দিকে চিত্রনাট্যকে ঠেলে দেওয়ার জন্য? উত্তরে ইমতিয়াজ বলছেন, “না, আমি কোনও দিনই এমন ছবি বানাইনি যাতে কেউ আমাকে কিছু করতে বাধা দিয়েছিল।”
আরও জানান, “নিজের ছবির বাজেট এমন ভাবে ঠিক করি, যাতে আমি রিস্ক নিতে পারি। এই নয় যে ‘হাইওয়ে’র চিত্রনাট্যে ভুল নেই। বা ছবিতে গলদ নেই। তবে আমি প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম যে ভীরার শেষ সিদ্ধান্ত এই রকমই হবে। ভরসার মানুষকে হারালেও ভীরা কুঁকড়ে যাবে না। দুঃখ হবে। অদ্ভুত ভাবে ও আরও বেশি মুক্ত হয়ে যাবে। উঠে দাঁড়াবে। ছোটবেলায় যে ওকে যৌন হেনস্থা করেছিল, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। আর তার পর খুঁজবে নিজের মুক্তির পথ।” হয়তো বা নিজের মতো করে বলা, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’।
মেয়ের প্রতি ভালবাসা সরিয়ে রেখে মহেশ স্বীকার করেছেন, “পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলছি, আলিয়া ইজ টু ‘হাইওয়ে’ হোয়াট শাবানা ওয়াজ টু ‘অর্থ’। ছবিটি দেখে যখন আলিয়ার সঙ্গে জাভেদ দেখা করতে আসে, তখন ও আবেগাপ্লুত। তার বহিঃপ্রকাশ ছিল ওঁর এই ট্যুইট।”
এই ট্যুইট দেখে অবশ্য ইমতিয়াজ আহ্লাদিত হলেও ভয়ও পেয়েছেন বেশ খানিকটা। “ভাল লাগা তো ছিলই। তার সঙ্গে ভয়ও। কারণ আমি বুঝেছিলাম কী সাঙ্ঘাতিক ‘ম্যাগনিচিউড’য়ের কমপ্লিমেন্ট এটা। আমাদের ফিল্ম ইতিহাসের একজন সব থেকে শক্তিশালী লেখক হলেন জাভেদ সাব। উনি তো আর এমনি এমনি এমন একটা কথা বলবেন না। জাভেদ সাব-এর প্রশংসাটা শুনে ভয়-মিশ্রিত আনন্দ হয়। আমি আলিয়াকেও সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলাম,” বলছেন ইমতিয়াজ।
আর আলিয়া? এখন চণ্ডীগড়ে ‘টু স্টেটস’য়ের শু্যটিংয়ে ব্যস্ত তিনি। বলছেন, “আমি বিশ্বাস করি না যে আমি কোনও ‘মাইলস্টোন’য়ে পৌঁছে গিয়েছি। তবে এটাও বলব যে যদি সত্যি তা হয়ে থাকে, আমি সেটা বুঝতে পারিনি। আমি এটুকু আশা করি যে ‘হাইওয়ে’ ছবির নিষ্ঠা দিয়েই যেন অন্যান্য ছবি করতে পারি। ওটা শু্যটিং করার সময় মনে হয়েছিল যেন আমার রক্তে ফিল্মের নির্যাসটা বইছে।”
মাইলস্টোনস মাদার ইন্ডিয়ার ‘নার্গিস’, ‘সাহেব,
বিবি...’তে মীনাকুমারী, ‘বন্ধন’য়ের নূতন,
‘অর্থ’-য়ের শাবানা আর এখন ‘হাইওয়ে’র আলিয়া ভট্ট।
জাভেদ আখতার
‘হাইওয়ে’ দেখে নিজেকে গর্বিত
অভিভাবকের মতো লাগছে।
আলিয়া ভট্ট অসাধারণ।
কর্ণ জোহর
 
আলিয়ার ব্যবহারের মধ্যে অনুভূতিপ্রবণ
মনের পরিচয় পাওয়া যায়।
ইমতিয়াজ আলি
‘অর্থ’য়ের শাবানার সঙ্গে আমি
‘হাইওয়ে’র আলিয়ার মিল খুঁজে পাই।
মহেশ ভট্ট

কিন্তু ইমতিয়াজ নাকি আলিয়ার প্রথম ছবিটা দেখেননি ভীরার চরিত্রে তাঁকে কাস্ট করার সময়। তবে প্রথম আলাপেই পরিচালকের মনে হয়েছিল আলিয়ার মধ্যে একটা মননশীল হৃদয় রয়েছে। “ওর ব্যবহার, ওর কথার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অনুভূতিপ্রবণ মনের পরিচয় পাওয়া যায়। একটা ফ্রেশ ভাব। আলিয়া আর আমার মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। আমি লক্ষ করেছি যে ও মাঝে মাঝে একা বসে নিজের সঙ্গেই কথা বলে। অন্য কারও কাছে উত্তর খোঁজে না। ও বেশ অন্তর্মুখী। ভীরাও তাই। ছবিতে ওই রকম দৃশ্য আমি রেখেছি যেখানে ও নিজের সঙ্গে কথা বলে।”
আর এই কথা বলা এবং নিজের মতো করে বাঁচতে চাওয়ার মধ্যে দিয়েই নাকি একটা নতুন বার্তা দেওয়া হয়েছে। “ছবিটা দেখার পর মনে হয়েছে কোথাও বোধহয় আমার চরিত্রটা আজকের মেয়েদের একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে দিয়েছে। একটা নতুন ভয়েস, যেখানে আত্মসম্মান রক্ষার কথা আছে। আছে উত্তরণের চাহিদাও। নিজের একটা জোর থাকা সব সময়ই ভাল। আর তা যদি খুব শক্তিশালী হয়, তা হলে তো কথাই নেই!” বলছেন আলিয়া।
তবে পূজা, ভীরা-র মতো চরিত্র কি বাস্তব জীবনে থাকে? নাকি এরা সবাই শুধুমাত্র সুপ্ত ইচ্ছেপূরণের উচ্চাকাশে বিচরণ করে? যাদের দেখে মনে হয় যদি এমনটাই হওয়া যেত! পরিচালক অবশ্য বলছেন, “ভীরাকে নিয়ে লেখার সময় পূজার কথা ভাবিনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে ভীরার চরিত্র বেশ ‘অ্যাসপিরেশনাল’। ওকে দেখে অনেকের মনে হবে যদি ওর মতো হওয়া যেত!”
তবে তার সঙ্গে এটাও বলছেন যে বাস্তব জীবনেও আজকাল নাকি তিনি অনেক মেয়েকে চেনেন যাঁরা ভীরার মতোই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। ঝড়ঝাপ্টা সামলেও বেঁচে থাকার হাইওয়েতে নিজেদের জীবনের হালটা তাঁরা অন্যদের ওপর আর ছাড়তে রাজি নয়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.