রাজ্যের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ফিকির প্রাক্তন মহাসচিব তথা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র আয় বাড়াতে বেছে নিলেন কর্পোরেট-দর্শিত পথকেই। সরাসরি কর না-বাড়িয়ে, করের ক্ষেত্রকে আরও বিস্তৃত করে ও আদায়-কুশলতার উন্নতি ঘটিয়ে তৈরি করে নিলেন লক্ষ্যপূরণের রাস্তা।
সোমবার বিধানসভায় ২০১৪-’১৫ আর্থিক বছরের জন্য ৩ লক্ষ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন অমিতবাবু। বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯ কোটি টাকা। বাজেট মূল্যায়ন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, “নিজেদের সঙ্গতির মধ্যে দাঁড়িয়েই কী ভাবে কী করা হবে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে এই বাজেটে। স্বচ্ছতাই এই বাজেটের বৈশিষ্ট্য।” এ দিনই লোকসভায় অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। সেই বাজেট লক্ষ্য করে মমতার কটাক্ষ, “কোনও প্রতারণা নেই। নেই সংখ্যাতত্ত্বের চমক। নেই অবাস্তব প্রতিশ্রুতিও। আমাদের বাজেটে কর্মসংস্থান ও মহিলাদের উন্নয়নে জোর দেওয়া হয়েছে।”
এক দিকে বাজারের বেহাল অবস্থা, অন্য দিকে, অনেকটাই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিপুল ঋণের বোঝা এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে বাঁচার রাস্তা খুঁজেছেন অমিতবাবু। লোকসভা ভোটের বছরে করের হার না-বাড়িয়েও রাজকোষ ভরতে মমতার অর্থমন্ত্রী হেঁটেছেন একেবারেই ফিকির মহাসচিবের সেই ‘চেনা’ পথে। বৃত্তিকর তিনি বাড়াননি। বরং ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ করদাতাদের একটা বড় অংশকে নিয়ে গিয়েছেন বৃত্তিকরের বাইরে। শুধু নিম্নবিত্ত মানুষই নন, ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ছাড় ঘোষণা করেছেন তিনি। বৃত্তিকর জমা দেওয়ার পদ্ধতি নিয়েও নানা অনুযোগ ব্যবসায়ীদের ছিল। সেই কারণে এই পদ্ধতিটিকে আরও সরল করতে ১০০টির বদলে মাত্র চারটি তথ্য ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছেন। এবং নথিভুক্তির এই পুরো পদ্ধতিটাই এখন অন-লাইন ব্যবস্থার আওতায় আনা হচ্ছে। |
পরামর্শ। বাজেট বক্তৃতার ফাঁকে। সোমবার বিধানসভায়। ছবি: সুদীপ আচার্ষ। |
একই সঙ্গে সম্পত্তি হস্তান্তর বাবদ স্ট্যাম্প ডিউটি ও রেজিস্ট্রেশনের হার কমিয়েছেন তিনি। ২৫ লক্ষ টাকার অধিক মূল্যের সম্পত্তির ক্ষেত্রে স্ট্যাম্প ডিউটি বাবদ ৭ শতাংশ কর দিতে হয়। সেই হার ১ শতাংশ কমানোর পাশাপাশি তিনি ২৫ লক্ষের সীমা বাড়িয়ে ৩০ লক্ষ করেছেন। এ ছাড়াও, রেজিস্ট্রেশন করাতে দেরি করলে এখন মাসিক ২ শতাংশ হারে যে সুদ দিতে হয়, অমিতবাবু তা কমিয়ে ১ শতাংশ করেছেন। শুধু তাই নয়, সুদের ঊর্ধ্বসীমা ২০ হাজার টাকায় বেঁধে দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, বাড়ির সংস্কার বা মেরামতের জন্য ঋণ নিতে বাড়ি বন্ধক রাখলে ৪ শতাংশ হারে স্ট্যাম্প ডিউটি দেওয়ার নিয়ম ছিল। সেই করের সর্বোচ্চ সীমা এক লক্ষ টাকায় বেঁধে দিয়েছেন অমিতবাবু।
ব্যবসা থেকে কর আদায়ের মূল উৎস ভ্যাট বা যুক্তমূল্যকর। অমিতবাবু প্রথম থেকেই জোর দিয়ে আসছেন কর ব্যবস্থার সরলীকরণের উপর। এ বার সেই পথে হেঁটে তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তিনি ডিলারদের জন্য অন-লাইন রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ভ্যাট নথিভুক্তির জন্য ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকা লেনদেনের প্রমাণ জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও তুলে দিয়েছেন। এর ফলে ভ্যাটের হার না-বাড়িয়েও আয়ের উৎস আরও বিস্তৃত হয়েছে। যারা বড় ডিলার তাদের জন্য কর জমা দেওয়ার ‘এক জানলা’ ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব রেখেছেন তিনি। এর ফলে ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় কর, তা কেন্দ্রের হোক বা রাজ্যের, একই জায়গায় জমা করা যাবে।
অর্থমন্ত্রীর মতে, কর ব্যবস্থা সরল করলে অনেকেই কর দিতে উৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি সামান্য জরিমানা দিয়ে বকেয়া শোধের পথ করে দিলে অতীতে কোনও কারণে যাঁরা কর দিতে পারেননি, তাঁরা সেই সুযোগ নিয়ে কর মিটিয়ে স্বস্তি পাবেন। আখেরে বাড়বে রাজ্যের আয়।
দিনের শেষে বাজেট হল সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসেব। সাধারণ সংসারের মতোই আয়ের থেকে ব্যয় বেশি হলে দায় মেটাতে ঋণের রাস্তায় হাঁটতে হয় সরকারকে। আর আয় ও ব্যয়ের ফারাক বেশি হয়ে গেলেই ঋণের দায়ে বেহাল অবস্থা হয়। পশ্চিমবঙ্গের ঋণের বোঝা এখন গোটা দেশেরই আলোচনার বিষয়। বাজেট পেশ করতে গিয়ে অমিতবাবু এই ঋণের দুষ্টচক্রের জন্য একই সঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার ও এ রাজ্যে তাঁদের পূর্বসূরি বামফ্রন্টকে। ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকার ‘বাম-ঋণের’ দায় মাথায় নিয়ে ২০১১ সালে রাজ্যের ভার নিয়েছিলেন মমতা। অমিতবাবু বলেন, “বামফ্রন্ট সরকারের পাপের জন্য ২০১১-’১২ থেকে ২০১৩-’১৪ সালের মধ্যে মূল ও সুদ বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার ৬৯,০৬৫.৮১ কোটি টাকা কেটে নিয়েছে।” তাঁর অভিযোগ, ঋণের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কেন্দ্র সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। ঋণের ফাঁস গত তিন বছরে আরও এঁটে বসেছে রাজ্যের গলায়। অমিতবাবুরই বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী, ২০১৪-’১৫ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে হবে ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। আগামী আর্থিক বছরে এ বাবদ সুদে-আসলে অমিতবাবুকে ২৯ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা শোধ করতে হবে। |
তবে এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েই অমিতবাবু যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী। ২০১১-’১২ সালে ২২ হাজার কোটি টাকার কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরে এগিয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত আদায় হয়েছিল ২৪ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। পরের আর্থিক বছরে আয় আরও বেড়ে হয় ৩২ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। ২০১৩-’১৪ সালের বাজেটে ৩৯ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষমাত্রা ধার্য করেছিলেন অমিতবাবু। দেশজোড়া বেহাল আর্থিক অবস্থার মধ্যেও ইতিমধ্যেই ৩৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা রাজকোষে ভরেছেন। আগামী আর্থিক বছরের জন্য তাঁর লক্ষ্য ৪৫ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন বছরের মাথায় কর বাবদ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণের বেশি বাড়িয়ে নিয়েছেন তিনি।
অমিতবাবু এ বার এমন একটা সময় বাজেট তৈরি করেছেন, যখন জানেন না যে আগামী বছর কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পরিমাণ কী হবে। কারণ, কেন্দ্রে এ দিনই পেশ হয়েছে চার মাসের অন্তর্বর্তী বাজেট। চলতি আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পরিমাণ ১৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু অমিতবাবু তাঁর বাজেটে এই বরাদ্দ দ্বিগুণ বেড়ে ৩০ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। অর্থ দফতরের এক কর্তার ব্যাখ্যা, অমিতবাবু মিথ্যা আশা করছেন না। কেন্দ্রীয় বরাদ্দ কী হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করে রাজ্যের কর আদায়ের উপরে। তাই কর আদায়ে রাজ্যের দক্ষতা অমিতবাবুর প্রধান হাতিয়ার।
রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে যে কৌশলটি তিনি নিয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অমিতবাবুর বক্তব্য, ব্যবসা না-বাড়লে আয় বাড়ে না। আবার করের হার যদি নাগরিকের ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তবে তার প্রতিফলন ঘটে কর আদায়ে। তাই কর না-বাড়িয়ে (বরং কমিয়ে) আদায়ের ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করা যেমন তাঁর কৌশলের একটি দিক, তেমনই অন্য দিকটি হল রাজ্যের আর্থিক কর্মযজ্ঞকে উজ্জীবিত করে তোলা। অর্থমন্ত্রীর দাবি, বর্তমান সরকার নীতিগত ভাবে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প, কৃষি, কৃষিজ পণ্য, কুটির শিল্প এবং পর্যটনকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লগ্নিক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেই লক্ষ্যেই এই ক্ষেত্রগুলিতে পরিকাঠামো উন্নয়নের উপরে অধিক জোর দেওয়া হয়েছে। জোর দেওয়া হয়েছে পঞ্চায়েত, গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, বিদ্যুৎ, স্কুলশিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতির কাজে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে বাম জমানার অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত রাজ্যে ফিনান্সিয়াল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট (এফআরবিএম) চালু করেন। সেই বেড়ি মেনে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ৩ শতাংশের মধ্যে বেঁধে রাখার প্রচেষ্টা কিন্তু সফল হয়নি। দিল্লিতে চিদম্বরম ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যর্থ অমিতবাবুও। অর্থ দফতর সূত্রের খবর, রাজকোষ ঘাটতি রাজ্যের মোট আয়ের ৫% ছাড়িয়ে গিয়েছে। বাজেট প্রস্তাব অনুযায়ী রাজকোষ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ১৩ হাজার ৪১৪ কোটি। তবে অমিতবাবু মনে করছেন, আগামী বছরের রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ কমে দাঁড়াবে ১৫ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা।
প্রত্যাশিত ভাবেই অমিতবাবু তাঁর বাজেটে বিরোধীদের সন্তুষ্ট করতে পারেননি। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের অভিযোগ, অথর্মন্ত্রী যে সব পরিসংখ্যান দিয়েছেন, তা ভিত্তিহীন। তাঁর মতে, “রাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য চূড়ান্ত নয়। এর কোনও ভিত্তি নেই।” শিল্পে এক লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ এবং রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ৯ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে বলে বাজেটে যা বলা হয়েছে তা ‘অবাস্তব’ বলেও মন্তব্য করেন সূর্যবাবু। তিনি বলেন, “রাজ্যের রাজস্ব আয় বেড়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু সব টাকা তো মেলা, উৎসব আর মুখ্যমন্ত্রীর হেলিকপ্টার চড়তেই খরচ হয়ে যাচ্ছে!” সূর্যবাবুর আরও অভিযোগ, “প্রবেশ করের ফলে রাজ্যে জিনিসের দাম বেড়েছে। সরকার জ্বালানি তেলে কর ছাড় দিলে সব জিনিসের দামই কমতো।”
অন্য দিকে, তৃণমূলের একদা জোটসঙ্গী কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করেন, এটি দিশাহীন, সারবত্তাহীন একটি বাজেট। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “নারেগা, গ্রাম সড়ক যোজনা, পানীয় জল প্রকল্প বা সংখ্যালঘু উন্নয়নের মতো অসংখ্য প্রকল্পে কেন্দ্র যে টাকা দিচ্ছে, তা স্বীকার করতে অর্থমন্ত্রীর এত দ্বিধা কেন?” |