|
|
|
|
|
|
|
প্রেম বহুত চাপ |
পেট খারাপ, প্রাইভেসি গাপ, সারা ক্ষণ মিথ্যে বলা, নেকু ফ্যান্টাসির চাটনি,
এসএমএসের খাটনি, খিস্তি গিলে ফেলা। যাচ্ছেতাই, ভালবাসা। লিখেছেন অনেকে মিলে।
|
কেন রে বাবা, প্রেমই তো করছি, চাকরির ইন্টারভিউয়ে তো বসছি না। তা হলে রোজ বিকেলে অমন ধোপদুরস্ত ধড়াচুড়ো পরে ডিয়ো বাগিয়ে হাঁচিকাশি চেপে প্রেজেন্ট প্লিজ কেন দিতে হবে? রোজ চোখ কুঁচকে, ম্যাগো, কী মুটোচ্ছ রে বাবা! দেখি, বেল্টের ফুটো ফের এক ঘাট বেড়েছে? প্রেম করছি না পি.টি. টিচারের কাছে দশ আঙুলের নখ পরিষ্কার কি না দেখাচ্ছি! এ কী, পাঞ্জাবি পরেছ, এ দিকে পায়ে স্নিকার? আড়াই দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়িমুখ, সামনে গেলে চাঁদবদনি হাঁড়িমুখ। খবরদার চুমু খাবে না এই জঙ্গুলে মুখ নিয়ে! বুঝে গেছি, প্রেমিক=২৪x৭ মডেল-লুক। প্রেম করতে গিয়ে আমি ফ্যাশন জেনে ফেলেছি!
শুদ্ধু বেগার খেটে যাও। তা-ও শুধু ওর জন্য হলে মানতাম। ওর ছোটভাই-মাসির মেয়ে-থুত্থুড়ে দিম্মা সব্বার জন্য খেটে মরতে হবে। এই তুমি আজ সন্ধেয় ফ্রি তো, বুকাইকে একটু ম্যাথ্সটা দেখিয়ে দিও। ব্যস, পাড়ার আড্ডা জলে। সোনামুখ করে একটা হাফ-বাঁদরকে পড়াতে বোসো। ঠাক্মার বুক ধড়ফড়, অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো বটেই, ডাক্তারখানায় নিয়ে পর্যন্ত যেতে হবে। হ্যাঁ, ট্যাক্সিতে। ভাড়াটাও তুমিই গুনবে হে গৌরী সেনের নাতজামাই। বাঁকুড়া থেকে ন’মাসিরা এসেছে, নেটে চারটে টিকিট কেটে দাও না সোনা। উঁহু, নো দাঁতচাপা খিস্তিয়াল কমেন্টস। এখন ডেবিট কার্ডে খরচা তো কী, ও দিকে ক্রেডিট (প্রেম) জমিতেছে।
এমন জেনারেল নলেজ বাগাতে হবে, কেথায় লাগে কম্পিটিটিভ এগজাম! রবীন্দ্রসদনের সিঁড়িতে প্রেমিকার কোলে কুঁজো হয়ে বসে আছ, পটাপট ঝাড়তে হবে তামাম ফান্ডা: আইআইটি থেকে আইপিএল, মেনল্যান্ড চায়না থেকে আফ্রিকার হায়না, গড়িয়াহাট থেকে গড়বেতা। প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে স্মার্ট ছেলে। কী কচ্ছিস রে? এই ভ্যালেন্টাইন ডে’র হিস্ট্রিটা এট্টু গুগ্ল করে নিলুম, আজ ওর সঙ্গে ভি-ডে ডিনার না? মিউচুয়াল বন্ধু-আসরে চুপচাপ বসে থাকলে কেলো। ওরা কী রকম আপডেটেড, কত্ত জানে, আর তুমি? মুখচোরা হাবলা একটা। পরে বন্ধুদের ফোন এলে: ইডেন যেতে পারব না, মনোরমা ইয়ার বুক পড়ছি, ইয়ার!
মাঠেঘাটে বসলে পিঁপড়ে-লোফার-ভিখিরি-পলিউশন, তাই রোজ রেস্তরাঁ। টানা হপ্তাদুই বিরিয়ানি পোলাও চিলিচিকেনের পর, যা হওয়ার তাই। সারা রাত বাথরুমে বসে তার কথা ভাবা। মুশকিল হল, প্রেমিকের কখনও ‘আমাশা’ হতে পারে না। তাই ফুটো লিভার থ্যাঁতলা প্যানক্রিয়াস ও ছদ্মসুখী মুখ নিয়ে ফের রেশমি কাবাব, রোগান জোশ। ক্রমে প্রেম জম্পেশ, আলসার-ও। আদ্ধেক সময় প্রণয়ী ছেড়ে যায়, পেটব্যথা ছাড়ে না।
|
|
যেন প্রেম করতে গেলে অসামাজিক হতেই হবে! প্রথমেই বেস্ট ফ্রেন্ডদের নামে চুকলি করে করে তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবে। বন্ধুরা যখন ফ্রিক আউট করছে, আমায় পার্কে ওর চোখে চোখ রেখে মশার কামড় খেতে হবে। বন্ধুরা গ্রুপে মন্দারমণি গিয়ে মস্তি করছে, কিন্তু ওই গ্রুপে দুটো ছেলে আছে বলে ও আমাকে যেতে দেবে না। কলেজের টিচারের বিয়েতে নেমন্তন্ন। ও কী এক অজানা কারণে, এক ঘণ্টা আগে সেখানে পৌঁছে আমাকে বের করে আনবে। এই যে আমরা গোটা পৃথিবীটাকে দু’ভাগ করে ফেললাম, এক প্রান্তে আমরা দো জিস্ম এক জান আর অন্য প্রান্তে না জানি কেন ‘দুশমন জমানা’, বলতে নেই কোনও কারণে যদি সাধের লাভটাই ভ্যানিশ হয়ে যায়, এই ব্যর্থ প্রেমের আবর্জনা পোড়াতে আসবেটা কে? সেই বন্ধুবান্ধব আত্মীয়রা? যাদের এক দিন ‘হাম কো জমানে সে কেয়া’ বলে ফুটিয়ে দিয়েছিলে? ইল্লি?
বাবার ও নিজের অর্ধেক সম্পত্তি ফোন-বিলে উড়ে যায়। সারা রাত ফোন, কানে ঝিঁঝি। এসএমএস করে করে বুড়ো আঙুলে আর্থ্রাইটিস। প্রেম একটু আস্পদ্দা পেলে আবার শুরু ‘সেক্সটিং’। বসে বসে আকাশ-পাতাল ভেবে রগরগে সব সিকোয়েন্স লিখে পাঠাও। আগে তবু প্রেমপত্র হপ্তায় একটা লিখলেই হত, এর-তার কোটেশন দিয়ে অনেকটা ম্যানেজ করা যেত। এখন সমস্ত জাগ্রত সেকেন্ড শুধু নাগাড়ে ইনস্ট্যান্ট লেখো আর বলো। এমবিএ-র চেয়ে অনেক বেশি খাটনি!
ভায়োলেন্ট জিনিস। টিন-ছেলেমেয়েগুলোর কবজির কাছাকাছি গুচ্ছের কাটা-চেরার দাগ। কাঁদতে কাঁদতে শিরা কাটতে গিয়েছিল। অনেকে প্রেমের প্রাথমিক গদগদ স্টেজেই দিগ্বিদিক কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে নাম পার্মানেন্ট ট্যাটু করিয়ে ফেলে। তার পর? যন্তন্না-ভর্তি ঘষটানিতে সেই ট্যাটু তোলো রে, নতুন জনের ট্যাটু করাও রে। নইলে একই নামের প্রণয়ী খোঁজো রে! একটা প্রেম হল মানেই অপঘাতে মরার চান্স সাঁইসাঁই বাড়ল। সুইসাইডের চেষ্টার দুশো বখেড়া। ফ্যান থেকে দড়ি বাঁধব না মেট্রোর থার্ড লাইন? মেট্রোর ভাড়াও তো এখন বেড়ে গেছে।
মুখে চোর চোর ভাব। হাত ধরাধরি করে গড়ের মাঠে হাঁটতে গিয়েও তিনশো ষাট ডিগ্রি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুন্ডুর ব্যায়াম। যদি দু-এক পিস চেনা মুখ বেরিয়ে পড়ে! সামনের সিটের ভদ্রলোকের টাকটা ঠিক পিসেমশাইয়ের মতো চকচক করছে না! গাছের আড়াল থেকে অবিকল ছোটকাকার স্টাইলে ধোঁয়ার রিংগুলো বেরিয়ে আসছে না! পার্কের ঝোপে চুমু খেতে গিয়েও বুক ধড়াস ধড়াস। যদি ঘাড়ে এসে পড়ে (পুলিশের) থাবা! আত্মীয়ঘন পরিবেশে বেমক্কা মোবাইলে ওর ডাক এলে বেইজ্জতির ভয়, দুম করে কেটে দিলে ওর রাগের ভয়, প্রেমের কথা বাড়িতে চেপে রাখতে ভয়, উগরে দিলে তুমুল অশান্তির ভয়। তেইশের আগেই ব্লাডপ্রেশার, ইস্কিমিক হার্ট, ইরিটেব্ল বাওয়েল সিনড্রোম।
দাসখত দিতে হয়। পাসওয়ার্ড দিতে হয়। ফোন ঘাঁটতে দিতে হয়। জিভে-জল চুরমুর ছেড়ে, ‘ওর ইচ্ছে’ জপে পাশে বসে পানসে চাউমিন চিবোতে হয়। ভূতের ভয়ে হাত-পা ছেড়ে আসে, তবু ‘ওর পছন্দ’ বলে ঠায় বসে অন্ধকার হলে র্যামসে ব্রাদার্স গিলতে হয়। অফিস থেকে একটু রাস্তা দেখতে দেখতে আপনমনে বাড়ি ফেরার জো নেই, বাড়ি এসে একটু শোওয়ার উপায় নেই। হয় হার্ট বার করে এসে উপস্থিত হবে, নয়তো ফোন করে করে শুতে-বসতে-খেতে-টিভি দেখতে কিচ্ছু করতে দেবে না। এত সবের পর ‘পরাধীনতা দিবস’-এ আবার গলে পড়ে সেলিব্রেট করতে হয়!
বিশেষত ছেলেদের অসুবিধে। প্রেম অন = খিস্তি অফ। ওর সঙ্গে থাকলে, পেট ফুলে গেলেও খিস্তি করা যাবে না। অটোয় দুজন যাচ্ছি, সিগনালে কেতাবাজ বাইকবাহন ওর দিকে তাকিয়ে স্যাট করে নিজের ঠোঁটে কদর্য জিভ বুলিয়ে নিলেও না। দক্ষিণাপণের সিঁড়িতে জোড়ায় বসে, ঠিক সামনেটায় কেউ ছিড়িক গুটখার পিক ফেললেও না। রাগে অন্ধ, তবু খিস্তি বন্ধ। আলজিভ নিশপিশিয়ে ভোকাবুলারি উঠে আসছে, কিন্তু মুখ দিয়ে মিনমিনে পলিটিকালি কারেক্ট ‘অসভ্য! অশিক্ষিত!’ আহা, ‘ও’ তো গোলাপ-পবিত্র, চার অক্ষর বলতে হয়তো ‘ভালবাসা’ বোঝে!
গোড়াতেই নিজের কাছে নিজে শপথ নিতে হয়, কদাপি সত্য বলিব না। ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের নাটকীয় মুহূর্তে প্রেমিকার ফোন এলে অম্লান বদনে ‘এই তো তোমার কথাই এত ক্ষণ ভাবছিলাম’। সাজের বহর দেখে রাগে গা জ্বলে গেলেও মুখে এক টুকরো হাসি লাগিয়ে ‘ফাটাফাটি!’ বুক ফাটলেও মুখ দিয়ে বেরোবে না: ওরে মড়া, আমি এখন পাশবালিশ আঁকড়ে স্বপ্নে ইমরান হাশমি-র সঙ্গে মরিশাস-এ বেড়াতে যেতে চাই, তোমার সঙ্গে গঙ্গার পাড়ে নয়। কিংবা এর আগে আরও তেরোটি মেয়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তুমি চোদ্দোতম। প্রেমের রাজ্যে পৃথিবী মিথ্যেময়। আর অভিমান বোঝাতে নিজের চোখের কোনায় নখ দিয়ে খুঁচিয়ে ফুলে-ফুলে কান্নার ফ্যাকড়া তো আছেই!
বাস্তব ডকে উঠে যায়। পুরোটাই ভবিষ্যৎ কাল, পুরোটাই ওয়ান্ডারল্যান্ড। কীইই সুন্দর একটা ছোট্ট বাড়ি হবে আমাদের, গুল্লু গুল্লু দুটো ছানা, বছরে এক বার ফরেন, আমরা কিন্তু একদম ঝগড়া করব না, কেমন? ঘুন্টুপুচু, এখন একটু কষ্ট করে ঝালমুড়িতে মন দাও। এই তো, মাইনে এক বার বাড়লেই ফি হপ্তায় দু’বার মোক্যাম্বো থেকে মেনল্যান্ড চায়না। প্রমিস। সে দুনিয়ায় আর্থিক মন্দা নেই, ইএমআই নেই, আগুন বাজার নেই, হু হু করে ডলার পতন নেই... কিন্তু ফ্যান্টাসির ফানুস ফুলতে ফুলতে এক দিন ফটাস। তার পর সোজা ইউরেনাস থেকে পৃথিবীতে আছাড়। গায়ের ব্যথা মারতে নেক্সট প্রেমের অপেক্ষায় হাঁ করে বসে থাকা।
প্রেম সফল হলে বিয়ে হয়ে যায়! যে জিনিসের লাস্ট সিনে এমন সাংঘাতিক সর্বনাশ অপেক্ষা করে আছে, সে কি ভদ্র কাণ্ড হতে পারে? ভুলিয়েভালিয়ে ল্যাবেঞ্চুস দেব বলে ফুটন্ত কড়ায় এনে ফেলা যার অভ্যেস, সেই প্রেমকে তোল্লাই দেয় কারা? ‘চাই চাই’ বলে নাকে কাঁদে কোন জন? চিহ্নিত করুন ও রদ্দা মারুন। |
|
|
|
|
|