শনিবারের নিবন্ধ ২...
একটি শিশির বিন্দু
জাদুঘরের দু’শো বছরে, বলতে গেলে অমূল্য রতনের সন্ধান পেল কলকাতা।
নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির চিঠিপত্র, ডায়েরি, অসংখ্য বই, এলপি রেকর্ড, নাটকের পাণ্ডুলিপি, ছবির অ্যালবাম সযত্নে রাখা ছিল তাঁরই পারিবারিক সংগ্রহে।
খবর পেয়ে সেসব ক্যামেরাবন্দি করে শিশিরকুমারকে নিয়ে ‘তথ্যচিত্র’র কাজে হাত দিল ‘পাইকপাড়া ইন্দ্ররঙ্গ’ নাট্যদল। নাট্যাচার্যের ১২৫ বছরটিকে মনে রেখে এরা এর মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে শিশিরকুমারের জীবনীভিত্তিক নাটক ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ মঞ্চস্থ করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বাংলা থিয়েটারে এ ধরনের তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ সম্ভবত এই প্রথম।
‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ নাটকের অংশবিশেষের সঙ্গে বাস্তবের শিশির-জীবনের নানা অনুষঙ্গ জুড়ে তৈরি হবে তথ্যচিত্র। থাকবে তাঁর সান্নিধ্যে আসা মানুষজনের সাক্ষাত্‌কারও।
শিশিরকুমার ও ঊষা দেবীর একমাত্র পুত্র অশোককুমার। একুশ-বাইশ বছর হল তিনি গত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী নীহারদেবীও ২০১১ সালে চলে গিয়েছেন। তাঁদের দুই ছেলের মধ্যে বড় ধ্রুবকুমার সদ্য প্রয়াত। ছোট শুভকুমার থাকেন দমদমের কৈখালিতে। আপাতত তাঁরই সংগ্রহে রাখা নাট্যাচার্যের যাবতীয় স্মৃতি।
নিজের বাড়িতে বসে শুভবাবু বলছিলেন, “বেশ কিছু পোশাকআশাকও ছিল। সেগুলোর এখন প্রায় ভঙ্গুরদশা। নাটকের চুল, দাড়ি ট্রাঙ্কে আটকা থেকে থেকে আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। যা কিছু বেঁচেবর্তে আছে, তা নিয়েই যে কাজটা শুরু হল, ভেবে ভাল লাগছে।”
হাতের তালুর চেয়ে অল্প বড় একটা নোটবুক। ধূসর মলিন হার্ড বোর্ডের মলাট। তার ওপর ইংরেজি হরফে লেখা, ‘এজেন্সিজ টেব্‌ল ডায়েরি’।
ডায়েরির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ১৯৫৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে এসে থমকে যেতে হয়। শিশিরকুমার লিখছেন, “সৌমিত্র বলে sixth year-এর ছেলেটি এসেছিল। অনেকক্ষণ বকলাম। a likely merit for the stage.”
সৌমিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তখন বাইশ বছরের যুবক। এই সাক্ষাতের পরই ‘প্রফুল্ল’ নাটকে তাঁকে সুরেশের চরিত্রে নেন তাঁর ‘দ্রোণাচার্য’। সে কথাও লেখা ৬ মার্চ-এর পাতায়। “সৌমিত্র এসেছিল। ওকে সুরেশের পার্ট দিলাম। একখানি বই কিনে নিয়ে শনিবার আসবে।”
শীর্ণ, ক্ষীণ হয়ে যাওয়া লালচে একটি কাগজ। ১৯৩৮ সালের নভেম্বর মাসে ভাগলপুরের স্টেশন রোড থেকে পাঠানো চিঠি। প্রেরক ড. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বনফুল। প্রাপক শিশিরকুমার ভাদুড়ি।
শিশির কুমার ভাদুড়ি
বনফুল লিখছেন, “আমি যখন মেডিকেল কলেজে পড়ি (অর্থাত্‌ প্রায় বারো তেরো বছর আগে) তখন একখানা ছোট নাটক নিয়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছিলাম। আপনি নাটকটি আগাগোড়া শুনে আমাকে নাটক লেখায় উত্‌সাহিত করেছিলেন। তার পর আর আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে মেলবার আমার সুযোগ হয়নি। এবার কোলকাতায় গিয়ে শুনলাম আপনি ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা ‘শ্রীমধুসূদন’ পড়ে খুব খুশি হয়েছেন তাই সাহস করে এই পত্রখানি লিখছি...।”
শুভবাবু বলছিলেন, “অনেকেরই চিঠি আছে। সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, শরত্‌চন্দ্র থেকে বিধানচন্দ্র রায়...। এমনকী পদ্মভূষণ ফিরিয়ে দেওয়ার পর রথীন্দ্রনাথ যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন দাদুকে, সেটিও।”
শুভবাবুর আফশোস তাঁর বাবা-মা কিংবা দাদা বেঁচে থাকলে তথ্য সংগ্রহে অনেক সুবিধে হত।
বলছিলেন, “দাদুকে নিয়ে বেশির ভাগটাই আমার শোনা কথা। ওঁদের তো দাদুকে দীর্ঘদিন ধরে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল। আসলে আমার যখন ছ’বছর বয়স তখন দাদু মারা যান। সেসময় আমরা উত্তর কলকাতায় ৪ নম্বর শিবু বিশ্বাস লেনের বাড়িতে থাকি। একবার মনে আছে, পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেল দাদুর, তখন বেশ কয়েক দিন আমাদের কাছে ছিলেন। তারপর ছানি অপারেশনের পরেও দাদুকে আমাদের বাড়িতে থাকতে দেখেছি।”
শিশিরকুমারের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ একবার তাঁর ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকটিকে কেটেছেঁটে নতুন রূপ দেন। নাম রাখেন ‘শেষরক্ষা’। শুভবাবুর কাছে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে কাটাকুটি করা সেই বইটি।
১৯৮০ সালে ২৭৮ বিটি রোড
হাতিবাগানে ‘শ্রীরঙ্গম’ থিয়েটার হলটি (পরবর্তী কালের বিশ্বরূপা) ভাড়া নিয়ে টানা চোদ্দো বছর অসম্ভব আর্থিক টানাটানির মধ্যে নাটক করেছেন শিশিরকুমার। সংগ্রহে রয়েছে ‘শ্রীরঙ্গম’-এর সময়কার কিছু স্মারক।
হলটি চালাতে গিয়ে শেষমেশ অবস্থা এমন দাঁড়ায়, বকেয়া ভাড়ার টাকা দিতে না পারায় কর্তৃপক্ষ শিশিরকুমারকে উত্‌খাত করে দেয় শ্রীরঙ্গম থেকে। তাঁর চোখের সামনেই যাবতীয় সরঞ্জাম ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তায়। সেই সময়কার ব্যবহৃত কিছু ট্রাঙ্ক, এমনকী শ্রীরঙ্গম ছাপ দেওয়া একটি তালাও রয়েছে পারিবারিক সংগ্রহে।
‘শ্রীরঙ্গম’-এ নাটক করতে গিয়ে দিনের পর দিন ঋণ বেড়ে গিয়েছিল শিশিরকুমারের। নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন প্রায়। একে একে বন্ধুরাও পাশ থেকে সরে গিয়েছিলেন। তাও ওই ক’বছরে চোদ্দোটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন তিনি। তার মধ্যে আর্থিক সাফল্য দেখেছিল শুধুমাত্র ‘বিপ্রদাস’। আর কিছুটা ‘মাইকেল’ আর ‘বিন্দুর ছেলে’। শিশির ভাদুড়ির নিজের হাতে লেখা ‘বিন্দুর ছেলে’র সেই পাণ্ডুলিপি এখনও সযত্নে রাখা তাঁর পারিবারিক সংগ্রহে।
বাংলা বা ইংরেজি ছাড়াও অন্য কয়েকটি বিদেশি ভাষায় দখল ছিল শিশিরকুমারের। অসম্ভব আগ্রহ ছিল অভিধানের প্রতি। তেমন অসংখ্য অভিধান আজও রয়ে গিয়েছে শুভবাবুর কাছে। এমনকী একটি বাংলা বিশ্বকোষ-এর দুর্মূল্য ২৬টি খণ্ডও। প্রত্যেকটিতে তাঁর স্বাক্ষর করা। রয়েছে ব্যবহৃত অনেক গ্রন্থও।
চিঠি, বই, অ্যালবাম থেকে দুষ্প্রাপ্য ছবি ও অন্যান্য স্মারকের পাশাপাশি ‘ইন্দ্ররঙ্গ’ ক্যামেরাবন্দি করতে চায় শিশিরকুমারের স্মৃতিজড়িত বাড়িগুলিরও।
শিশিরকুমার জন্মেছিলেন মেদিনীপুরে মামাবাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি ছিল সাঁতরাগাছি। কলকাতায় বহুকাল কাটিয়েছেন হেদুয়ার কাছে ২২ নম্বর ঘোষ লেনে। শেষ জীবনে থাকতেন ২৭৮ নম্বর বিটি রোডে। এই বাড়িতে বসেই অভিমানী শিশিরকুমার ‘পদ্মভূষণ’ প্রত্যাখ্যান করেন।
শুভবাবু বলছিলেন, “বছর পঁচিশ আগে যখন শেষবার মেদিনীপুরের বাড়িটায় যাই, তখনও সেটা ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু সাঁতরাগাছির বাড়িটা খুঁজে পাইনি।”
ঘোষ লেনের বাড়িটির খোঁজে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তাটির নাম এখন নাট্যাচার্যের নামে, কিন্তু বাড়িটি নেই। স্থানীয় কেউই কোনও হদিশ দিতে পারলেন না। শুভবাবুর অনুমান, হয়তো বা বিবেকানন্দ রোড তৈরির সময় বাড়িটা ভাঙা পড়েছে। আর সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে ২৭৮ বিটি রোড।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.