চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
স্থাপত্যের পরিমণ্ডলে বীরভূমের লাল-মাটির স্মারক
চিত্রকলা বা দৃশ্যকলা এখন আর একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমের চিত্রপটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতার সমন্বিত ও দ্বান্দ্বিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় আমাদের দেশে শিল্প-প্রকাশে যে বিপুল পরিবর্তন এসেছে, তাকে ‘বিকল্প রূপকল্প’ বলে চিহ্নিত করা যায়। আমাদের দেশের শিল্পচর্চার সাধারণ প্রবাহে বিকল্প রূপকল্পের অনুশীলন সীমিত হলেও অনেক শিল্পী আছেন, যাঁরা নিষ্ঠাভরে এই বিকল্পের সাধনাতেই নিমগ্ন আছেন। সঞ্চয়ন ঘোষ এরকমই একজন শিল্পী। ‘এক্সপেরিমেন্টার’-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সঞ্চয়ন ঘোষের সাইট স্পেসিফিক ইনস্টলেশন ও ভিডিয়োর একটি প্রদর্শনী। শিরোনাম: ‘রিভার্সড পার্সপেকটিভ’: থ্রি কনজাংশনস’। এর উপশিরোনাম: ‘অ্যান ইনটারডিসিপ্লিনারি আর্কিটেকচারাল ইনটারভেনশন অন ল্যান্ডস্কেপ স্টাডি’। দৃশ্যকলাকে এই শিল্পী প্রায় বিজ্ঞানের গবেষণার পর্যায়ে তুলে নিয়ে এসেছেন।
সঞ্চয়ন বিশ্বভারতী থেকে চিত্রকলায় স্নাতকোত্তর শিক্ষা শেষ করেছিলেন ১৯৯৭ সালে। তিনি বিকল্প রূপকল্প নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন। নাটকের মঞ্চ স্থাপত্যেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
আলোচ্য প্রদর্শনীটি ‘কনসেপচুয়াল’ বা ভিন্ন ভাবধারার হলেও, উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই বিশেষ ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। মাটির জন্য, পরিবেশের জন্য, মানুষের জন্য ভাবনাকেই তৃণমূল স্তর থেকে অনুধাবনের জন্য শিল্পীর এই বিকল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তিনি শান্তিনিকেতনে থাকেন। শান্তিনিকেতন বীরভূম জেলার অন্তর্গত। তাই এই প্রকল্পে তিনি কাজ করেছেন বীরভূম জেলা নিয়ে। এই জেলার ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ , মানুষ ও নৃতত্ত্ব তাঁর গবেষণার বিষয়।
শিল্পী: সঞ্চয়ন ঘোষ
প্রদর্শনীটি ‘সাইট-স্পেসিফিক’। অর্থাৎ গ্যালারির পরিসরকে প্রকৃষ্ট ভাবে ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে এই দৃশ্য-প্রকল্প। পুরো পরিসরকে কাঠের বাটাম ও সুতো দিয়ে জ্যামিতিক স্থাপত্যের আকারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বীরভূমের পরিবেশ বা বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে এর কি কোনও সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্ন জাগে। তাহলে এটা কি বীরভূম নিরপেক্ষ বিশেষ একটি স্থাপত্যধর্মী নির্মাণের দৃষ্টান্তমাত্র? একটি সংশয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয় এখানে। এই স্থাপত্যের পরিমণ্ডল জুড়ে খুব হাল্কা লালাভ আলো জ্বলে। বলা হয়েছে বীরভূমের লাল-মাটির স্মারক এই আলো।
সেই স্থাপত্যের কল্পিত দেয়ালের গায়ে বীরভূমের প্রত্ন-ঐতিহাসিক পরিচয় লেখা থাকে এ রকম: ‘বীরাভূ: কামকোটি: স্যাৎ প্র্যাচ্যাং গঙ্গাজয়াবিতা।’ ওখানকার প্রচলিত লোটাগানের পঙ্ক্তি চিহ্নিত থাকে।
ওলো বাংরুলি
মন্দ জ্বাল ববাতুলি
ওই আসছে খরজল
মন্দ জ্বাল চিকুলি
’।
তার পর থাকে ভূতাত্ত্বিক পরিচয়। বিভিন্ন পাত্রে বিভিন্ন অঞ্চলের মাটি বা পাথরকুচির দৃষ্টান্ত সাজানো থাকে। কোনটা অম্লজাতীয়, কোনটা ক্ষারজাতীয়, সেই পরিচিতি অবহিত করা হয়। এ সব বৈজ্ঞানিক তথ্য অতিক্রম করে আমরা একটি ভিডিয়ো-র সামনে দাঁড়াই। ত্রিমাত্রিক ত্রিকোণ একটি দীর্ঘ পরিসরে দুই দেয়ালের গায়ে বীরভূমের বর্তমানের দৃশ্যাবলি প্রবাহিত হতে থাকে।
এই যে টুকরো টুকরো করে দেখা হল একটি জনপদকে, তা থেকে কি সামগ্রিক কোনও পরিচয় উঠে এল? উত্তর-আধুনিকতা বলে, কোনও কিছু সম্বন্ধেই শেষ সিদ্ধান্ত কিছু হয় না। আমরা ভেঙে ভেঙে জানার দিকে ক্রমাগত এগোতে থাকি। এটাই জ্ঞানচর্চার একটা পদ্ধতি। এখনকার শিল্পচর্চারও। আধুনিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, একে প্রহেলিকা মনে হতে পারে। এই প্রদর্শনীর দর্শকও হয়তো এই প্রহেলিকায় পথ হারাতে পারেন।
শান্তিনিকেতনের অনেক শিল্পীই বীরভূমকে ভালবেসেছেন। নন্দলাল, বিনোদবিহারী, রামকিঙ্করের বীরভূম-চিত্রমালা থেকে এই অঞ্চলের নিসর্গ ও মানুষকে আমরা অনেকটাই জেনেছিলাম। জানার ও জানানোর পদ্ধতি বিশ্বায়িত-উত্তর-আধুনিক যুগে অনেকটাই পাল্টেছে। তবু মনে হয় এই আলোচ্য প্রকল্পে ওই সব শিল্পীর ছবি বা ভাস্কর্যের যদি কিছু উদ্ধৃতি রাখা যেত, তাহলে ওই অঞ্চলের নিকটবর্তী অতীতের কিছু নান্দনিক আভাস হয়তো আমরা পেতে পারতাম। সেই প্রেক্ষাপট থেকে আজকের জটিল ইতিহাস-ভূগোলের দিকে তাকাতে পারতাম। এই নৈর্ব্যক্তিক প্রকল্পে কিছু রসসঞ্চারের প্রয়োজন হয়তো ছিল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.