কে বেশি জোরে দৌড়য় ঠান্ডা, না গরম? একদা এই প্রশ্নটা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সুব্রক্ষ্মণ্যম চন্দ্রশেখর ছুড়ে দিয়েছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক কামেশ্বর ওয়ালি-র দিকে। চন্দ্রশেখরের জীবনীকার ওয়ালি। লিখেছেন ‘চন্দ্র: আ বায়োগ্রাফি অফ এস চন্দ্রশেখর’ শিরোনামে সুখপাঠ্য বইখানি। ওই বইতে ওয়ালি বর্ণনা করেছেন চন্দ্রশেখরের ব্যক্তিত্ব। বিশেষত তাঁর গাম্ভীর্য। যার কারণে ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ সম্ভ্রমের চোখে দেখত তাঁকে। ওয়ালি চন্দ্রশেখরের ছাত্র নন। আমেরিকায় অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তবু শুধু গাম্ভীর্যের কারণে তিনিও যে দূরত্ব বজায় রাখতেন চন্দ্রশেখরের সঙ্গে, তার সবিস্তার বর্ণনা আছে ওই বইতে। |
সেই দূরত্ব অবশ্য চিরস্থায়ী হয়নি। ক্রমে ওয়ালি ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন চন্দ্রশেখরের। এতটাই যে, ঠাট্টা-মশকরায় যোগ দিতেন দুজনে। এ রকম এক ইয়ার্কির কথা ওয়ালি পরে লিখেছিলেন ‘কারেন্ট সায়েন্স’ পত্রিকায়। তাঁকে এক বার চন্দ্রশেখর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হুইচ মুভস ফাস্টার হিট অর কোল্ড?’ ওয়ালি কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত। কী জবাব দেবেন তিনি? এক জন স্কুলছাত্রও জানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অমোঘ নিয়ম। তাপ সব সময় একমুখী। তা ধেয়ে যায় গরম বস্তু থেকে ঠান্ডা বস্তুর দিকে। যায় তত ক্ষণ, যত ক্ষণ না দুটো বস্তুর উষ্ণতা হয় সমান। মুছে যায় উষ্ণতার তারতম্য। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এটাই দস্তুর। এ নিয়মের ব্যতিক্রম নেই কোথাও। কখনও দেখা যায় না এমন ঘটনা যে, তাপ ছুটছে ঠান্ডা বস্তু থেকে গরম বস্তুর দিকে। ঠান্ডা জিনিস হচ্ছে আরও ঠান্ডা, যা গরম ছিল তা হচ্ছে আরও গরম। এবং কমার বদলে বাড়ছে দুই বস্তুর উষ্ণতার ফারাক। বাস্তবে শৈত্য বলে কিছু নেই। যা আছে, তা হল তাপ। শৈত্য ব্যাপারটা আসলে তাপের কম উপস্থিতি। ছোটাছুটি যা করে, তা তাপ। তা হলে তাপ আর শৈত্যের দৌড় প্রতিযোগিতার প্রশ্ন কোথায়? কে বেশি দ্রুতগামী, সে প্রশ্ন তো অর্থহীন। অন্তত বিজ্ঞানের বিচারে।
কিন্তু মশকরা ও ভাবে বিচারের বিষয় নয়। তা কথার মারপ্যাঁচ, তাৎক্ষণিক চিন্তার কারিকুরি। ওয়ালি কোনও উত্তর দিতে না পারায়, নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই তাঁকে দিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। বলেছিলেন, ‘ইউ সি, হিট মুভস ফাস্টার। হোয়াই? বিকজ ইউ ক্যান অলওয়েজ ক্যাচ কোল্ড’। চন্দ্রশেখরের জবাব শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিলেন ওয়ালি। সত্যিই তো! হিট স্ট্রোক বলে একটা বিপত্তি আছে বটে, তবে তা আর কতই বা দেখা যায়? তার বদলে আমাদের যে প্রায়ই ঠান্ডা লাগে। হয় সর্দি, জ্বর, কত কী। ঠান্ডা যখন সহজেই ধরে ফেলি আমরা, তখন আর তাকে তেমন দ্রুতগামী বলি কী করে? তা বেশি জোরে দৌড়য় না। |
হাড় হিম করা ঠান্ডায় বন্ধ গাড়ি। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন এক জরুরি পরিষেবা কর্মী। নিউ ইয়র্কে। ছবি: রয়টার্স। |
ওয়ালির উদ্দেশে চন্দ্রশেখরের মশকরার কথা মনে পড়ল শীত নিয়ে নানা খবরে। এবং বিশ্বের নানা প্রান্তের ছবি দেখে। আমেরিকায় যেহেতু এ বার শীতের প্রকোপ ছিল খুব বেশি রকমের, তাই ওখানকার ঠান্ডা হেডলাইন কেড়েছে বেশি। কয়েকটি খবর তো মনে রাখার মতো।
যেমন এই তথ্য যে, শিকাগো শহরের তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল মাইনাস ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অবশ্য সেটা থার্মোমিটারের মান। ঠান্ডার সঙ্গে ছিল ঝোড়ো হাওয়া। তার দাপটে ঠান্ডাটা দাঁড়িয়েছিল মাইনাস ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। জানুয়ারি মাসের ৬-৭ তারিখে ঠান্ডা এবং বরফের দাপটে আমেরিকার এয়ারপোর্টগুলিতে ওঠেনি বা নামেনি ৬৮০৪টি ফ্লাইট। যা নাকি একটা রেকর্ড। মিনেসোটা প্রদেশে ক্রেন হ্রদে উষ্ণতা নেমে গিয়েছিল শূন্য ডিগ্রির চেয়ে অনেকটা। মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তার মানে, ওই জায়গাটা হয়ে গিয়েছিল আন্টার্কটিকার চেয়েও শীতল। আন্টার্কটিকায় উষ্ণতা থাকে মাইনাস ২৮ ডিগ্রি। কেনটাকি শহরের ঘটনা আরও বিচিত্র। শহরের জেলখানা থেকে পালিয়েছিল এক কয়েদি। পরনে পাতলা জ্যাকেট আর খাকি প্যান্ট। হায়! কারাগার থেকে পালিয়েও মুক্তির স্বাদ শেষমেশ পেল না সেই কয়েদি। পাবে কী করে? জেলের বাইরে যে হাড়-হিম করা শীত। ঠান্ডায় নেই তা সহ্য করার পোশাক। ফলে মৃত্যুযন্ত্রণা। শীতে কাবু জেল-পালানো কয়েদি ফিরে গেল ফের কারাগারে। আত্মসমর্পণ করল কর্তৃপক্ষের কাছে। শীত এমনই যে তা ভুলিয়ে দিল মুক্তির স্বাদও! |
পরিশ্রমের দিনলিপি। বরফে ঢেকেছে আফগানিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল।
বাইরে থেকে বাড়িতে জল নিয়ে যাচ্ছেন মহিলারা। কাবুলের কাছে। বৃহস্পতিবার। ছবি: এপি। |
শীতের এমন সব খবর পড়তে পড়তে মনে পড়ল বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ঠান্ডা-গরমের চিন্তাভাবনার বিষয়টা। আমাদের শৈশব থেকে উষ্ণতা বা তাপমাত্রার ব্যাপারটা আমাদের অভিজ্ঞতায় প্রকট হয়। জ্বর হয়েছে কি না, তা দেখতে থার্মোমিটার গায়ে ঠেকানো হয়। ডাক্তারি থার্মোমিটার। যাতে মাপ ওঠে সেলসিয়াস নয়, ফারেনহাইট ডিগ্রিতে। সেটা অন্য কথা। গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল উষ্ণতা মাপা। থার্মোমিটার বানানো। তো তা বানানোর উপায় তো বহু কাল জানা। কী উপায়? তাপমাত্রা বাড়লে তরলের আয়তন বাড়ে। তাই সরু নলের মধ্যে তরলের আয়তন বাড়ালে সুবিধে। উষ্ণতা বাড়লে সরু নলে তরলের আয়তন বাড়বে। তরল নল বরাবর সরবে। নলের গায়ে দাগ কেটে রাখলে কত উষ্ণতায় তরল কোন দাগে পৌঁছচ্ছে, তা দেখে মাপা যাবে তাপমাত্রা।
এতে সমস্যা আছে সূক্ষ্ম একটা। উষ্ণতা বাড়লে তরলের আয়তন বাড়ে ঠিকই, কিন্তু সেটা কি সব সময় সমান পরিমাণে? কোনও পরিমাণ তরল ১০ ডিগ্রি থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আয়তনে যতটা বাড়ে, ৯০ থেকে ৯১ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও কি ততটাই বাড়ে? না, তা বাড়ে না। অথচ থার্মোমিটার বানানো হয় কিন্তু সমপরিমাণ আয়তন বৃদ্ধি ধরে নিয়েই। উষ্ণতা স্কেলে ওপরে উঠলে আয়তনবৃদ্ধির হার এক রকম কি না, তা পরীক্ষা করতে থার্মোমিটার চাই। এ দিকে আবার থার্মোমিটার বানানো হয়েছে ভুল নীতির সাহায্যে। তা হলে কোন দিকে যাওয়া? এ তো ডিম-আগে-না-মুরগি-আগে গোছের ব্যাপার। থার্মোমিটার, সুতরাং, উচ্চতা মাপার ত্রুটিমুক্ত উপকরণ নয়। বলা বাহুল্য, সেলসিয়াস কিংবা ফারেনহাইটও তাপমাত্র নির্ণয়ের চূড়ান্ত মাপকাঠি নয়। কেন তা হতে পারে না, সেটা উনবিংশ শতাব্দীতে বুঝতে পেরেছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম টমসন। পরে যিনি পরিচিত হয়েছিলেন লর্ড কেলভিন নামে। |
স্তব্ধ নায়াগ্রা। তাপমাত্রা নেমে গিয়েছে শূন্য থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও নীচে। আর তাতেই জমে গিয়েছে নায়াগ্রা জলপ্রপাত।
এই ঘটনাকে বিরলতম বলে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে নায়াগ্রা পাবলিক লাইব্রেরিতে পাওয়া আরও একটি ছবিতে দেখা গিয়েছে,
ওই জলপ্রপাত জমে রয়েছে। ছবিটি ১৯১১ বা ’১২ সালের বলে অনুমান। যদিও ছবিটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ছবি: রয়টার্স। |
কেলভিন আবিষ্কার করেছিলেন এক সত্য। বুঝেছিলেন কোনও বস্তুর উষ্ণতা মাইনাস ১০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে না। এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বনিম্ন উষ্ণতার একটা সীমা আছে। তার চেয়ে কম উষ্ণতা অসম্ভব। সেটা কত? কেলভিন দেখান সেটা মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পাওয়া যায় তাপমাত্রার এক নতুন স্কেল। কেলভিন। যার শূন্য ডিগ্রি মানে মাইনাস ২৭৩.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
গত ১০০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা নানা কাজে ওই শূন্য ডিগ্রি কেলভিন-এর কাছাকাছি পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন। বিশেষ উদ্দেশ্যে। দেখা গেছে তাপমাত্রা খুব কমালে পদার্থের অণু-পরমাণুর বিচিত্র সব চরিত্র ধরা পড়ে। মূলত ওই সব চরিত্র লক্ষ করার জন্যই পদার্থকে ঠান্ডা, আরও ঠান্ডা করার প্রতিযোগিতায় নামেন গবেষকেরা। এ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে ১৯০৮ সাল থেকে। এগিয়ে চলেছে কঠিন, আরও কঠিন প্রচেষ্টা। শৈত্যের এই অভিযান দুরূহ বলে আজ পর্যন্ত পাঁচটি নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়েছে এ ব্যাপারে। প্রথম পুরস্কার ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। শেষেরটি ২০১২ খ্রিস্টাব্দে।
শূন্য ডিগ্রি কেলভিন-এর কত কাছে পৌঁছেছেন বিজ্ঞানীরা? খু-উ-ব কাছে। সর্বশেষ সাফল্য ২০০৩ সালে। গবেষকরা পৌঁছেছেন ০.০০০০০০০০০৪৫ ডিগ্রি কেলভিন উষ্ণতায়! |