আগের দিন পিরামিডও দেখে ফেলেছি। পিরামিড... যার জন্য মিশর, মিশর হয়েছে। সেই পিরামিড, যার ঠিক মাঝ বরাবর (এই মাঝ বরাবরের নাকি পৃথিবীর কেন্দ্রের সঙ্গে ডিরেক্ট কানেকশন আছে!) শুয়ে থাকে ‘মামি’, আমরা যাকে ছোটবেলা থেকে চিনি মমি বলে। যে পিরামিডে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। তার ভেতর আলো ছিল না, তার ভেতর আর কিছুই ছিল না। ছিল কেবল মরে যাওয়ার পরেও একটা মানুষের বহতা জীবনের আনুষঙ্গিক। তার রোজকার লাঞ্চের মেনু আপেল-কলা-চাল বা বিরিয়ানির উপকরণ, তার পেয়ারের নৌকর-চাকর, পোষা বেড়াল, সাতনরি হার, মলমলের ওড়না, মৌরি-মিছরির ডিব্বা, টগবগে টাট্টু, আটপৌরে পাশবালিশ, অর্থাত্ কিনা তার জীবন, আহা জীবন রে।
এখন আমি হাতে একটা টিকিট নিয়ে চলেছি মিশরীয় মিউজিয়ামের ‘রয়্যাল মামি রুম’-এর দিকে। অন্যরা প্রায় কেউই শুকনো মৃত ফারাওদের দেখতে রাজি হল না। খুব অল্প আলো, এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডা হাওয়া আর মৃদু আওয়াজের মধ্যে কাচের বাক্সে শুয়ে রয়েছেন ওই ত্তো, রামেসেস টু। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ফারাও হওয়ার চেয়ে বেশি বিখ্যাত ৪৫টি বিয়ে করার জন্য। বুড়ো বয়সেও যাঁর রেশম-রেশম চুলের নাকি ভারী নামডাক ছিল। ধক্ করে উঠল বুকটা। ওই তো মাথার পেছন দিকটায় এখনও মরচে রঙের রেশমগুচ্ছ। এই লোকটা তখনও ছিল, এখনও আছে। ওঁর দাঁত, চুল, কাঠের মতো শুকনো হাত, কালো হয়ে যাওয়া করোটি, শূন্য চোখের কোটর, সব নিয়েই তিনি হয়তো তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী জীবন বেশ জমিয়ে বাঁচছেন। জীবত্কালে তো খুঁটিনাটি পরিপাটি সেই ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। পাশাপাশি কাচের বাক্সে যাঁরা শুয়ে রয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই এখন সেই অন্য-জীবন যাপন করে চলেছেন।
|
ঠিক এমনটাই তো বিশ্বাস করত মিশরীয়রা। তাদের দেবদেবীরাও দু’রকমের: ইহজীবনের আর পরজীবনের। সেই সব দেবদেবী, যাঁরা কিনা সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মিশরীয়দের আশ্বস্ত করেছিলেন, মৃত্যুতে জীবন শেষ হয় না তাঁদের সঙ্গে মোলাকাত হল আসওয়ান শহরের কাছে লেক নাসের-এর মাঝে একটা দ্বীপের মধ্যে, ফিলা-র মন্দিরে। আমাদের সঙ্গী মিশরবিশেষজ্ঞ, যিনি এই সব ইতিহাস বলে চলবেন আগামী পাঁচ দিন ধরে, শুরু করলেন দেবতা ওসাইরিসকে দিয়ে। মন্দিরের গায়ে খোদাই করা তাঁর অবয়ব। তিনি পরজীবনের দেবতা। আত্মাকে তাঁর পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। প্রশ্নপত্র সহজ: ইহজীবনে ভাল কাজের পাল্লা ভারী, না খারাপ কাজ? পাশ করলে পরজীবন চমত্কার, ফেল করলে নরকময়।
মন্দিরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে, রাজা দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য দিচ্ছেন নানা উপচার। আর দেবতা তুষ্ট হয়ে দিচ্ছেন, key of life, যে চাবিকাঠি পরজীবনে শান্তি আর স্বস্তির দায়িত্ব নেবে। দেবতার কাছ থেকে সেটি পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন এবং পুণ্যের কাজ। কোনও সময় সেই দেবতা সৃষ্টির, তিনি হোরাস, কখনও সর্বশক্তিমান সূর্যদেবতা আমুন-রা। তিনি নাকি নিজেকে সৃষ্টি করেছিলেন আর তার পর সৃষ্টি করেছিলেন এই মহাবিশ্ব। সুতরাং তাঁকে তো তুষ্ট করতেই হবে। আরও এক দেবতা মন্দিরের গায়ে বিরাজমান, যাঁকে দেখেই চিনেছি: আনুবিস। শেয়াল-দেবতা। সত্যজিত্ রায়ের গল্পে তাঁর কথা পড়েছি। আনুবিস-ই ‘মামি’ করার দেবতা। গড অব মামিফিকেশন। তাঁর হাতেই ইহজীবন আর পরজীবন মিলিয়ে দেওয়ার চাবিকাঠি। তিনিই দেহকে এমন ভাবে রক্ষাকবচ পরিয়ে দেবেন, সে থেকে যাবে হাজার হাজার বছর পরেও। তিনি রক্ষা করবেন খাত্ (khat) বা দেহকে, যাতে খা (kha) অর্থাত্ আত্মা পরজীবনটা ভাল করে বাঁচতে পারে। আত্মার আধার তো দেহ, এত দিন তো তারা একসঙ্গে থেকেছে, তা হলে মৃত্যুর পর হঠাত্ দেহকে অবহেলা করলে আত্মা বাঁচবে কী করে? আর মৃত্যুর পর যে ন’টা ভাগে ভাগ হয়ে যায় অস্তিত্ব, সেই সবক’টার ওপরেই তো আত্মাকে নির্ভর করতে হবে। খাত্ আর খা ছাড়া অন্য সাতটা ভাগ হল বা: মানুষের মতো মুখওয়ালা এক পাখি, যে স্বর্গ আর মর্তের মধ্যে ওড়াউড়ি করে। শুয়েত: ছায়া-সত্তা। আখ্: রূপান্তরিত সত্তা, যার বিনাশ নেই। সাহু ও সেচেম: আখ্-এর দুই রূপ। আব: হৃত্পিণ্ড বা হৃদয়। রেন: ব্যক্তির গুপ্তনাম (রাশনাম)। ব্যক্তির রাশনামকে অসম্ভব গুরুত্ব দেওয়া হত। সারা জীবন সেই নাম লুকিয়ে রাখতে হত। ফলে মানুষের পরিচিতি হত একটা অন্য নামে। অর্থাত্, তুত-আন খামন-এর আসল নাম অন্য।
এ সবের মধ্যে আব বা হৃত্পিণ্ড খুব জরুরি। কারণ আনুবিস যখন ওসাইরিস সহ ৪২ জন দেবতার সভায় নিয়ে যাবে রাজাকে, তখন এই হৃত্পিণ্ডকেই চড়ানো হবে শুদ্ধতার দণ্ডে। হৃত্পিণ্ড পালকের চেয়ে হালকা হলে তবেই স্বর্গপ্রাপ্তি, নচেত্ নরক। তা হলে আনুবিস-এর কাজ তো সাংঘাতিক কঠিন। তাকে তো আত্মাকে সংরক্ষণ করতে হবে। সেই আত্মা সংরক্ষণের প্রথম কাজ দেহ সংরক্ষণ। আর তাই আনুবিস পুরোহিতদের মাধ্যমে দেহ সংরক্ষণের যে কাজ আরম্ভ করতেন, তার প্রথম পর্ব ছিল: মৃত্যুর পর প্রথম চল্লিশ দিন একটা পাথরের স্ল্যাব-এ শুইয়ে নুন দিয়ে দেহকে ভিজিয়ে রাখা আর তার পর ৪৫ রকম রাসায়নিকের সাহায্যে দেহ সংরক্ষণ করা। দেহ থেকে সমস্ত অরগ্যান বের করে নেওয়া হত লিভার, কিডনি, ফুসফুস... কেবল হৃত্পিণ্ড রাখা থাকত তার নিজের জায়গায়। তার পর দেহ নিয়ে যাওয়া হত সমাধিস্থলে। এই সমাধি স্থল প্রথম ছিল লাক্সারের কাছে। তার নাম, ‘ভ্যালি অব দ্য কিংস অ্যান্ড ভ্যালি অব দ্য কুইন্স’। অনেক পরে, পিরামিড তৈরি হওয়ার পর, মামি রাখা হত পিরামিডের ভেতর। আধুনিক বিজ্ঞানীরা নাকি ওই ৪৫টির মধ্যে মাত্র পাঁচটি রাসায়নিক খুঁজে বের করতে পেরেছেন, বাকি চল্লিশটা এখনও ধাঁধা।
সমাধির দেওয়াল জুড়ে শুধু এই পরজীবন নিয়ে খোদাইকার্য। রং কোথাও ফিকে কোথাও উজ্জ্বল। কোথাও আনুবিস হাত ধরে রাজাকে পার করিয়ে দিচ্ছেন ওসাইরিস-এর কাছে। কোথাও রাজার হৃত্পিণ্ডকে খেতে আসছে সাপ। অর্থাত্ রাজার পরজীবন সুখের হল না। রাজা সিংহাসনে বসামাত্র দুটো কাজ শুরু করতেন। এক, নিজের একটা মন্দির তৈরি করা, যে মন্দিরের গায়ে উত্কীর্ণ থাকবে পরজীবনে দেবতাকে তুষ্ট করার প্রসেস। আর দুই, নিজের সমাধি বানানো।
ভাবছিলাম, লোকে পারেও বটে। আরে, জীবনটাকে ঠিকঠাক উপভোগ করে নে, বেঁচে নে। তা নয়কো, আমার পরজীবন কী রকম হবে সেই চিন্তায় নাওয়া-খাওয়া নেই। গোটা জীবনের কেন্দ্রে একটাই ফোকাস মৃত্যু। স্বর্গ পেলাম কি না, আনুবিস ঠিক করে হার্ট ওজন করল কি না, আমার খাত্ আর খা ঠিক ঠিক সম্মিলিত হল কি না, ওসাইরাস-এর দেখা পেলাম কি না। ওরে, ভাব না, তোর বউ সুন্দর কি না, তোর রাজকোষে কত খাজনা, তুই আর ক’টা রাজ্য জয় করতে পারিস? তা নয়, সারা ক্ষণ এক ঘ্যানরঘ্যানর, মৃত্যু, মৃত্যু আর মৃত্যু।
তা হলে একটা জাতি কেবল মৃত্যু নিয়ে অবসেস্ড ছিল? জীবনটা বাঁচার চেয়ে মৃত্যুর ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে নেওয়াই ওদের কাছে অনেক জরুরি ছিল? এটা কি আশ্চর্য জীবনবিমুখতা নয়? তার পর ভাবলাম, হয়তো ব্যাপারটা উলটো। আমরা সারা ক্ষণ মৃত্যুকে ভুলে থাকতে চাই, মৃত্যুর কথা উঠলেই তড়িঘড়ি অন্য প্রসঙ্গে যাই, মৃত্যুর থেকে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচতে চাই। মিশরীয়রা তা করেনি। হয়তো আসলে আমরা খুব ভিতু আর মিশরীয়রা অনেক সাহসী। ওরা মৃত্যুকে মর্যাদা দিয়ে রোজকার জীবনের অঙ্গ করে নিয়েছে। মৃত্যুকে ভেবে নিয়েছে জীবনের একটা এক্সটেনশন, আর সেই মতো কাজ করেছে। মৃত্যুকে সেই একই মনোযোগ দিয়েছে, জীবনকে যতটা দেয়। তাতে ওদের জীবন বাঁচা আরও অনেক সহজ হয়েছে। আমাদের কাছে যা ভয়, ওদের কাছে তা নিত্যই হয়। ভাত খাওয়া, বেড়াতে যাওয়ার মতোই মৃত্যুও একটা ঘটনা। যেমন স্কুল যাওয়ার নিয়ম, সকালে উঠে দাঁত মাজার নিয়ম, তেমনি এক দিন মরে গেলে অন্য জীবন বাঁচাটাও নিয়ম।
কেউ মিশরীয়দের বলবে ‘বোকা’, কেউ বলবে, ‘আমি থাকব না এত বড় সত্যিটা মেনে নেওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই পরজীবনের মস্ত্ একটা ব্লুপ্রিন্ট বানিয়েছে।’ কিন্তু আসলে ওরা মৃত্যুকে চোখ ঠেরে থাকেনি। এখানেই ওদের জয়। আমরা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি ভয়ংকর সত্যি হিসেবে, ওরা মৃত্যুকে গ্রহণ করেছে নিতান্ত আর একটা ঘটনা হিসেবে।
মিশরে ঘোরার শেষ পর্বে আমরা কায়রোয়। বাসের সামনে পেছনে কনভয়। বাপ রে, উত্তাল সময় ঠিকই, তাহ্রির স্কোয়ারে নামতেও দেয়নি বটে, কিন্তু একেবারে সাইরেন বাজিয়ে যেতে হচ্ছে? ও হো, তাই জন্যই মিউজিয়ামের সামনে ষোলোটা ট্যাঙ্ক দেখেছিলাম। কিন্তু রাস্তাঘাট দেখে তো কিছু মনে হচ্ছে না। এই তো ডাউনটাউন জুড়ে মেয়েরা ভীষণ সেজেগুজে, হাই লেদার বুট্স পরে হইহই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রাত বারোটায় যা জ্যাম হচ্ছে সেটা আমাদের পার্ক স্ট্রিটে সন্ধে ছ’টায়ও হয় না। রাত দুটোয় কাফেতে কাফেতে তুলকালাম আড্ডা। আচ্ছা, কায়রোয় কেউ ঘুমোয় না? উত্তর আসে, ‘নো ম্যাডাম, উই আর অলওয়েজ অ্যালাইভ।’
ঝাঁকুুনি লাগল মস্তিষ্কে। সত্যিই তো! জীবন তো শেষ হতে পারে না। কিছুতেই পারে না। এটা ভুল ধারণা যে এক দিন হঠাত্ এত সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে দুম করে মরে যেতে হবে আর তার পর আর কিচ্ছু থাকবে না, একদম কিচ্ছু না! এই গমগমে শহর, নীল নদ, মরুভূমি, মরীচিকা-ছলনা, তার পর হঠাত্ দড়াম অন্তহীন শূন্যতা! ধুর, তা হয়? আসলে আমরা ভাবি মৃত্যু মানে সব শেষ। ওরা ভাবে মৃত্যু একটা অন্য জীবন যাপনের শুরু। তার নিয়ম, নীতি, কায়দাকানুন আলাদা, কিন্তু তা কখনওই ‘শেষ’ নয়। ওরা জীবনকে জড়িয়ে ধরে। ‘মামি পজিশন’ মানে হল, দু’হাত বুকের কাছে জড়ো করে, জড়িয়ে নেওয়ার ভঙ্গি। ওরা জীবন ভালবাসে তো, তাই পরজীবনও খুব ভালবাসে। খুব। |