লাভপুরের নির্যাতিতা ও তাঁর মাকে গ্রামে ফিরতে দিতে আপত্তি নেই। শনিবার অন্তত এমনটাই দাবি করলেন সুবলপুরের মহিলারা।
শুক্রবার বীরভূমের লাভপুরের ওই গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য ছিল, তাঁরা নির্যাতিতা বা তাঁর পরিবারকে গ্রামে ফিরতে দিতে চান না। সে খবর প্রকাশও হয়। কিন্তু এ দিন সুখী মাড্ডি, পাবর্তী কিস্কু, আরতি মাড্ডির মতো সুবলপুরের আট-দশ জন মহিলা বলেন, “কাল যা বলেছি, রাগের মাথায় বলেছি। বাড়ির লোককে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ায় মাথার ঠিক ছিল না। যা হয়েছে, হয়েছে। ওই মেয়েকে আর জরিমানা দিতে হবে না। ও, ওর মা গ্রামে ফিরে আসুক। আমাদের আপত্তি নেই।”
প্রশাসনও মেয়েটিকে গ্রামে ফেরাতে চায়। সিউড়ি হাসপাতালে এ দিন নির্যাতিতার সঙ্গে দেখা করার পরে রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শশী পাঁজা বলেন, “মেয়েটি গ্রামে ফিরতে ভয় পাচ্ছে। ও লাভপুরেরই অন্যত্র ওর মামাবাড়িতে যেতে চেয়েছে। সেখানে পরিবারটির কিছু জমিও আছে। আপাতত সেখানেই ওদের বাড়ি করে দেবে প্রশাসন। তবে ওই পরিবারটি যাতে সুবলপুর গ্রামে ফিরতে পারে, সেই পরিবেশও তৈরি করে দেওয়া হবে।” |
জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা জানান, ইন্দিরা আবাস যোজনায় ওই পরিবারটিকে দ্রুত বাড়ি করে দেওয়া হবে। ওই তরুণীর মায়ের বিধবা ভাতা চালু করা হয়েছে। পরিবারটিকে অন্ত্যোদয় যোজনার অন্তর্গত করে সরকারি সুযোগ-সুবিধে দেওয়া হবে। প্রশাসন সূত্রের খবর, পরিবারটির বাড়ি তৈরির কাজেও চলছে।
নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ানোর আরও গুচ্ছ আশ্বাস মিলেছে প্রশাসনের তরফে। মন্ত্রীর কথায়, ‘‘ওয়েস্টবেঙ্গল ভিকটিম কমপেনসেশন ফান্ড থেকে মেয়েটিকে সাহায্য করা হবে। তা ছাড়া, মানসিক ভাবে তরুণীটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরানোর জন্য মহিলা কাউন্সেলরের ব্যবস্থা করতেও বলেছি সিউড়ি হাসপাতালের সুপারকে।”
তবে প্রশাসনের তরফে গ্রামে ফেরানোর আশ্বাস এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতিতেও ভরসা পাচ্ছেন না নির্যাতিতার দুই ভাই। তাঁরা বলেন, “কয়েকদিন পরেই সব শোরগোল থেমে যাবে। তখন কিছু হলে কে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে?”
বীরভূমের নতুন পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া অবশ্য বলছেন, “আপাতত পুলিশ মেয়েটির নিরাপত্তার বিষয়টি দেখছে। তবে উনি বা ওঁর পরিবার যখনই গ্রামে ফিরবে, পুলিশ ওঁদের নিরাপত্তা দেবে।” জেলাশাসকের সংযোজন, “সুবলপুরে ওই পরিবারের বাস করার মতো ব্যবস্থাও করা হবে।”
ওই পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থার পাশাপাশি তদন্তের কাজও চলছে। এ দিন দুপুরে রাজ্য ফরেনসিক ল্যাবরেটরির চার সদস্যের একটি দল সুবলপুরে যায়। তাঁরা তরুণীর উপরে নির্যাতনের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত বলাই মাড্ডির রান্নাঘরে গিয়ে সেখানে রাখা খাটিয়া, কম্বল, মশারি, পুরুষদের পোশাক-সহ বিভিন্ন জিনিস পরীক্ষা করেন এবং নমুনা সংগ্রহ করেন। অতিবেগুনী (আল্ট্রা-ভায়োলেট) আলো ব্যবহার করে খুঁটিয়ে দেখা হয় রান্নাঘরের মেঝে। শুক্রবার রাত থেকেই নাইলনের দড়ি দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিল রান্নাঘরটি। তবে এ দিন কিছু গ্রামবাসীকে বলতে শোনা গিয়েছে, “ঘটনাটা সোমবার রাতের। শুক্রবার পর্যন্ত বহু বাইরের লোক ওই ঘরে যাওয়া-আসা করেছে। এর পরে ওখানকার নমুনা থেকে কী করে ঠিকঠাক ফল পাওয়া যাবে?” তদন্তকারীরা অবশ্য এ প্রশ্নের কোনও জবাব দেননি। জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে বীরভূম জেলার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক শুভ্রদীপ মিত্র কাল, সোমবার সুবলপুর গ্রামে গিয়ে তদন্ত করবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট পাঠাবেন।
সিউড়ি হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, নির্যাতিতার শারীরিক অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল। এ দিন স্বাভাবিক খাওয়াদাওয়াও করেছেন তিনি। এ দিন বিকেলে একটি মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। জাতীয় মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্যা ভারতী মুৎসুদ্দির নেতৃত্বে বামপন্থী বিদ্বজ্জনদের একটি প্রতিনিধি দল আবার গিয়েছিল সুবলপুরে। এ দিন সন্ধ্যায় ওই তরুণীকে নির্যাতনের ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে মোমবাতি মিছিল হয় সিউড়ি শহরে।
এ দিকে, লাভপুরের ঘটনায় রাজ্য সরকার যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে সন্তোষ প্রকাশ করলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। শনিবার দুপুরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-প্রাঙ্গণে একটি অনুষ্ঠানের পরে সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এটা ঠিকই, আমরা ওই ঘটনা ঠেকাতে পারিনি। কিন্তু তার পরে দরকারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।” লাভপুর-কাণ্ডের পরে বীরভূমের আগের পুলিশ সুপার সি সুধাকরকে সরিয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। তার পরেই নবান্ন থেকে সব জেলার পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ-স্তরে ধর্ষণ রুখতে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। এর পরেই রাজ্যপালের এ দিনের মন্তব্য।
সালিশি সভা ডেকে শাস্তির বিধান প্রসঙ্গেও নারায়ণন বলেন, “আমি পুরোপুরি এ সবের বিরুদ্ধে। একটাই শব্দ বুঝি, ন্যায়বিচার।” রাজ্যপাল এ দিনও বলেছেন, “আমার রায় আমি আগেই দিয়েছি। কর্পোরাল পানিশমেন্ট বা শারীরিক নিগ্রহমূলক শাস্তিই ধর্ষণকারীর দাওয়াই।” তবে এই ধরনের অপরাধের দায় কোনও রাজনৈতিক দলের উপরে চাপানো ঠিক নয় বলে জানিয়েছেন রাজ্যপাল। তাঁর মতে, “দল নয়, ব্যক্তিই এমন অপরাধের জন্য দায়ী।” |
সহ প্রতিবেদন: ভাস্করজ্যোতি মজুমদার। |