আমবাঙালি ‘গোপাল’ বলতে সচরাচর বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়ের সুবোধ বালককেই বোঝেন। সে সদা সত্য কথা বলে, নিয়ম করে পড়াশোনা করে, ফাঁকি না দিয়ে রোজই পাঠশালায় যায়, যখন যা করার কথা তখন ঠিক তা-ই করে। যাকে বলে ‘সোনার টুকরো’ ছেলে। অনেক সময় সোনার টুকরো ছেলেরা যতটা আত্মসচেতন ও কেরিয়ারসচেতন হয় দেশ ও সমাজ সম্পর্কে ততটা সচেতন হয় না। বিদ্যাসাগরের গোপাল মোটেই বিদ্যাসাগরের মতো নয়, না দুরন্তপনায়, না সমাজসচেতনতায়। কথাটা রবীন্দ্রনাথ এক রকম ভাবে তাঁর বিদ্যাসাগর বিষয়ক রচনায় খেয়াল করিয়েও দিয়েছিলেন।
তবে বাঙালি জীবনে আর এক জন গোপাল ছিলেন। কিংবদন্তির মধ্যে, তাম্রশাসনে সেই গোপালের পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা তাঁকে খানিক ভুলেই গিয়েছি। তিনি পাল সাম্রাজ্যের গোপাল। সত্যি কথা বলতে কি, উনিশ শতকের বাংলা প্রাইমারের ইংরেজ উপনিবেশের সুবোধ বালক গোপালের চাইতে এই ‘প্রাগাধুনিক’ গোপালের প্রয়োজন আমাদের এখন অনেক বেশি। বোধহয় এক জনকে পেয়েছি। কিন্তু তার পর?
ভারতীয় গণতন্ত্রের বর্তমান মডেলটি যে মুখ্যত পশ্চিমী আধুনিকতার সঙ্গে বোঝাপড়ার ফল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে জনমতের প্রকাশ ও শাসনে সেই মতের প্রতিফলন গণতন্ত্রের এই মেজাজ প্রাগাধুনিক ভারতবর্ষের রাজতন্ত্রের মধ্যেও কোথাও কোথাও দেখা যেত। অমর্ত্য সেন (দি আইডিয়া অব জাস্টিস) বিষয়টি আলোচনা করেছেন। সংবিধানের অন্যতম রূপকার বি আর অম্বেডকরও জানতেন এ কথা, কিন্তু এই পুরনো লক্ষণগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। এই সব রাজকাহিনি বরং অন্য ভাবে গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে তাঁর শান্তিনিকেতনের স্কুল নাটকে গানে ভরপুর। পড়ুয়াদের তিনি বিদ্যাসাগরের গোপাল হিসেবে গড়ে তুলতে চাননি, তাঁদের সমাজসচেতন, নিজস্ব মতামত প্রকাশে কাবিল করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই কাজে নাটক অন্যতম হাতিয়ার। |
১৯১২-১৩। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে। তাঁর স্কুলের ছেলেদের জন্য সরাসরি ইংরেজিতে একটি নাটক লিখলেন। ‘কিং অ্যান্ড রেবেল’। অজিতকুমার চক্রবর্তীর তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতনে সেটি ১৯১৩-র এপ্রিল মাসে অভিনীত হয়। সেই নাটকে বিদ্রোহী প্রজারা শুধু দুষ্টু রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করেনি, কে রাজা হবে তাকে বেছেও নিয়েছে। অরাজকতা, অপশাসন দূর করার জন্য প্রজারা নির্বাচন করছে তাদের শাসককে এই বার্তাটুকু রবীন্দ্রনাথ সচেতন ভাবেই তাঁর ছাত্রদের দিতে চেয়েছিলেন। তিনি চাইতেন ছাত্ররা নিজেদের শাসন করুক। কথাটা বলে তিনি সেখানেই থেমে যাননি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন ‘মুক্তধারা’ ও ‘রক্তকরবী’ লিখলেন তখনও এই কথাটাই বড় হয়ে উঠল। রাজার শাসন যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজার নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে, তা হলে প্রজারা মতামত বিনিময়ের ভিত্তিতে একজোট হয়ে রাজার সেই নিয়ম ও শাসনকে লঙ্ঘন করবে।
রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি নাটক ‘কিং অ্যান্ড রেবেল’-এর বাংলা অনুবাদ করেন জগদিন্দ্র ভৌমিক। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় তা ছাপা হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের অলংকরণ-সহ। সত্যজিৎ পরে যখন ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবি করলেন তখনও সে সিনেমা রাজার গপ্পো বটে, কিন্তু আসল কথাটা তো রাজা-প্রজার টানাপড়েন নিয়েই। প্রজারা দলবদ্ধ হয়ে দুষ্টু হীরক রাজাকে গদিচ্যুত করে। প্রজারা দলবদ্ধ হয়ে মানে অবশ্য সবাই নয়, সচেতন প্রজারাই এই পালাবদলে হাত লাগান। দরকার মতো নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে শাসক হিসেবে বেছে নেন। অন্তত ‘কিং অ্যান্ড রেবেল’ নাটকে ছেলের দল যুদ্ধবাজ রাজেনকে সরিয়ে হেমকে রাজা হিসেবে বেছে নেয়। প্রধান বিচারপতি কুশাসক রাজেনকে বলে: I think it will be a better move for you to lay down your crown peacefully and take up the role of an ordinary person.
‘অর্ডিনারি পার্সন’। প্রতিশব্দ কী হবে? আম আদমি? এখনকার দিল্লির আম আদমি পার্টির সূত্রে তা-ই লিখতে ইচ্ছে করে। রাজা মুকুট খুলে নেমে যাবেন আম আদমির দলে, আর আম আদমি বেছে নেবেন তাঁদের নতুন রাজা! রবীন্দ্রনাথের রাজেন-হেম-এর কিস্সা এক রকম করে আমাদের মনে করিয়ে দেয় কিংবদন্তির গোপালকে। সে অনেক দিন আগের কথা। দিল্লির অরবিন্দ তখন কোথায়! অষ্টম শতাব্দীর শেষ ভাগ। তখনকার বঙ্গদেশে কোনও কেন্দ্রীয় শাসন নেই। ভয়ানক অবস্থা। যাকে বলে মাৎস্যন্যায়। ক্ষমতাশালী বড় মাছেরা ইচ্ছে মতো ছোট মাছদের খেয়ে ফেলছে। সাধারণ মানুষের প্রাণান্ত। ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্মপাল’ উপন্যাসে অবস্থার বিবরণ দিয়েছিলেন। বাসুদেবের মন্দির। নরকঙ্কাল ছড়ানো। দস্যুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য আম আদমি গ্রামদেবতার মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিল। দেবতা বা অবতার দুষ্কৃতীর হাত থেকে জনসাধারণকে বাঁচায়নি, ফলে সাধারণের প্রাণ গিয়েছে। এ অবস্থায় শাসনভার নিলেন গোপাল। খালিমপুর তাম্রশাসনে জানানো হয়েছে, গৌড়ীয় প্রজাপুঞ্জ গোপালদেবকে রাজলক্ষ্মীর করধারণ করিয়েছিলেন। এই প্রজাপুঞ্জ কারা? সাধারণ মানুষ? গৌড়ীয় কৃষকবৃন্দ? ইতিহাসবিদরা নানা কথা বলেছেন। রাখালদাসের ধারণা, সীমান্ত-রাজারা তাঁদের মধ্য থেকে কোনও রণকুশল লোককে রাজা হিসেবে বেছে নেন। নিজেদের স্বার্থ ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা।
নিরাপত্তার জন্য, সুশাসনের জন্য প্রজাদের রাজা খোঁজার ঘটনা নানা সময় নানা ভাবে ঘটছে। গণতন্ত্রের আধুনিক মডেল এই মতামতকে প্রতিনিধি-শাসনের কাঠামোয় জায়গা দিয়েছে। তবে একটা জায়গায় ভাল রাজতন্ত্র আর ভাল গণতন্ত্রের মিল। প্রজাসাধারণের মতকে গুরুত্ব দেয় তারা। সাম্প্রতিক কালে দিল্লিতে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে যা ঘটল তা অনেকটা এ-রকমই। রবীন্দ্রনাথের নাটকে যে অর্ডিনারি পার্সন-এর কথা আছে তাদের মধ্য থেকেই এক জন ক্ষমতায় এলেন এবং তিনি সরকার গড়বেন কি না, মুখ্যমন্ত্রী হবেন কি না, তা-ও এক রকম ভাবে দিল্লির আম আদমি ঠিক করে দিলেন।
রূপকথার গল্পের শেষে বলা হয়, এর পর তারা সুখে বসবাস করতে লাগল। বাস্তব রূপকথা নয়। বেছে নেওয়ার মুহূর্ত অতিক্রান্ত। এর পর শাসনের পালা, সেই শাসন ঠিক পথে চলছে কি না তার বিচার। নানা প্রশ্ন উঠছে। শেষ কথা এখনই বলা যাচ্ছে না। আম আদমির মুখ্যমন্ত্রীকে মাথায় তোলারও দরকার নেই, আবার খারিজ করারও সময় আসেনি। তবে প্রজাতন্ত্রের প্রজাদের সচেতন থাকতে হবে। |
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |