রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
জাস্ট যাচ্ছি
লাইনে লাফিয়েছে কেউ। কেন যে লাফায়! এই সব ভাবছিলাম দমদম রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে। ট্রেন বোধহয় যাবে না। সাতসকালে এ সব ভাল লাগে না আমার। মেট্রোর প্ল্যাটফর্মে উঠে এলাম। কুয়াশার জন্য আলো কম, ঠান্ডাও লাগছিল। দপদপ করা কামরার একটা আলো দেখে মনে পড়ল জোর করে প্রাণবায়ু বের করে নেওয়া মানুষটার দেহ নিশ্চয়ই পড়ে আছে আমার মাথার ওপরে, ক্রমেই তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছি আমি। ঝমঝমিয়ে চলে যাচ্ছি অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে। শোভাবাজার এসে গেল, হয়তো ওখানে রোদ উঠেছে। হাজার হাজার জ্যান্ত মানুষ দৌড়চ্ছে মাথার উপর দিয়ে। নামলাম না। আসলে কামরার কেউই নামল না। আমার কাছে মেট্রোর নীল কার্ড আছে। অনেক দূর যেতেই পারি, তাই বসেই রইলাম। চাঁদনি চক ছেড়েই মেট্রো আবার দাঁড়িয়ে গেল। আমার পাশের এক জন কাগজ পড়ছিল, সেখানে তিন জন মহিলার মৃত্যুসংবাদ বেরিয়েছে। আলাদা আলাদা কারণে মৃত্যু। আমি আড়চোখে দেখছিলাম। লোকটা চোখ তুলে এ দিক-ও দিক দেখল, মেট্রো ছাড়তেই একটু হাসল। তাই আমিও হাসলাম। খেয়াল করলাম, সেই আলোটা আর দপদপ করছে না।
রবীন্দ্র সদনে বেশ ভিড় হয়ে গেল। তার মধ্যে থেকে এক জন বুড়োমানুষ মুখ বার করে আমার দিকে সরাসরি তাকাতেই উঠে দাঁড়ালাম। এ বারে মাথার চারপাশে অনেকগুলো পাথরের মতো মাথা, কেউ কথা বলছে না। অল্পবয়সিরা শুনছে। তাদের কানে সরু তার। আমার কোমরে কিছু একটা খোঁচা মারছে। হাঁটুতে শক্ত ব্রিফকেস লাগছে, হাঁটুটা ঘুরিয়ে নিলাম। কোমরের খোঁচাটাও থেমে গেল। কামরায় হঠাত্‌ আলো বেড়ে গেল, চারপাশের শব্দগুলো অন্য রকম আসছে মহানায়ক উত্তমকুমার। সুড়ঙ্গের বাইরে চলে এসেছি, জানলার ওপরের খোলা জায়গা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়েছে। রাস্তা, নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি, ধুলো পড়া গাছ, সব এখন নীচে। শহরের ওপরে ওপরে চলেছি। খোলার চালের ওপর এগোচ্ছে লাউ-লতা। অনেক দূরে সিনেমার সেটের মতো হাইরাইজ। বাঁক ঘুরছে মেট্রো।
ছবি: লেখক।
কবি সুভাষ স্টেশনে নামতেই হল। ওখানেই শেষ। নেমে বাইরে বেরিয়ে দেখি একেবারে ফাঁকা, শুনশান। বেখাপ্পা সুন্দর স্টেশন বাড়ি। ঝকঝকে স্টিলের গেট। এক পাশে গুরুত্বহীন রাস্তা। এগোলাম ও-দিকে। একটা খাল। ঝুপড়ি। চায়ের দোকান। লোকাল ট্রেনের হর্ন শুনলাম। নিউ গড়িয়া স্টেশন। আরও দক্ষিণে যাওয়ার লাইন। বেশি দূর চলে গেলেই সুন্দরবন। পকেট হাতড়ালাম সিগারেট খাব বলে। পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘শলাই হবে?’ দেখি দুজন দাঁড়িয়ে আছে, চাদর মুড়ি দিয়ে। এক জনের আঙুলের মধ্যে ছোট শুকনো বিড়ি। পায়ের কাছে বস্তা জাতীয় ব্যাগ, অনেক কিছু আছে মনে হচ্ছে। ভারী বোধহয়। তাই নামিয়ে রেখেছে মাটিতে। বললাম, ‘আমারটা থেকে ধরাও। ওতে কী আছে?’ ধোঁয়ার পিছনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মাথা থেকে উত্তর এল ‘করমট’। আমি বুঝতে পারিনি সেটা বুঝতে পেরে বলল, ‘কেঁড়া, কেঁড়া।’ অন্য জন তাকিয়ে ছিল অন্য দিকে। বলল, ‘বলছে ও গাড়িতে উঠতে মানা আছে। কী বেপার বুঝি না। এ গাড়িতে তো কিছু বলল না।’ এত বড় ব্যাগ নিয়ে মেট্রোতে উঠতে দেবে না, নিয়ম নেই। ‘কোথায় যাবে’ জিজ্ঞেস করায় উত্তর এল, ‘চিনাদের ওখানে। ওরা তো খায় বলে। চামড়াটাও লাগিয়ে দেবে।’
ব্যাগটা আড়চোখে আর এক বার দেখলাম। মনে হল একটার মধ্যে কী যেন একটু নড়ল। মুখের কাছটা একটু খোলা মতো। উঁকি দেবার চেষ্টা করলাম। কালো রঙের আঁশওয়ালা কিছু একটা রয়েছে। বললাম, ‘ও সব নিয়ে কলকাতায় ঢোকা যাবে না গো, ধরবে।’ ‘ধরবে বললে চলবে? বিল্লাপাড়ার লোক বলেছে আমাদের, চায়নার লোক মাল নেয়। জাহাজ ভরতি মাল ঢুকে যাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না, আমারটায় দোষ হয়ে গেল? ওই নতুন গাড়িতে এক বার উঠে গেলে সদনে নেমে যাব, তার পর বাস ধরে নেব। তুমি একটু বলে দাও না।’ আমার চেহারা দেখে ওরা স্বজাতীয় ভেবেছে। তুমি বলছে। হয়তো খুব মরিয়া হয়েই বিশ্বাস করেছে। বললাম, ‘ঝামেলা বাড়িও না। ভাল কথা বলছি শোনো। ও সব যেখান থেকে ধরেছ, সেখানেই ছেড়ে দাও, এ দিকে ঢুকলেই ধরবে। ধরে ফাটকে ভরে দেবে সবসুদ্ধু।’ অন্য জন খ্যাঁক করে বলে উঠল, ‘পুরলে পুরবে। দেখব কী করে ধরে রাখে। বস্তা খুলে দেব না, থানা ছপছপে করে দেবে না।’ এ সব কথার কোনও উত্তর দেওয়া যায় না। আমি অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম। এটা কলকাতা। ওটাও কলকাতা। ওটাই হল আসল কলকাতা। ওখানে থাকি বলেই এখানে এসেছি। তার মানে এই নয় যে, যে-কেউ যা-কিছু নিয়ে যত দূর পর্যন্ত কলকাতার ময়লা কার্পেটটা বিছোনো আছে, সেখানে তার বস্তা নামিয়ে দেবে। যদিও বস্তায় ঠিক কী আছে, সেটা পরিষ্কার নয় আমার কাছে।
ছোট ছোট রঙিন টালি বসিয়ে কলকাতার একটা বড় ছবি তৈরি করা আছে স্টেশনের এক পাশের দেওয়ালে। তার আড়াল থেকে ইলেকট্রিক হর্নের আওয়াজ শুনলাম। যেন সতর্কবাণী। একটা চাপা আর্তনাদ ক্রমশ ভারী হয়ে উঠল। ফিকে গোলাপি রঙের লোহার তৈরি সরীসৃপ রওনা হয়ে গেল শহরতলি ছেড়ে, জাল দেওয়া বেড়ার ও-পার দিয়ে। তাকালাম ওদের দিকে। ওরাও শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে একই দিকে। এক জন চাপা গালাগাল দিল। বলল, ‘আবার জাল লাগিয়েছে! যেন রেল চুরি করে নেবে। না থাকলে রানিং উঠে যেতাম।’ বলে নিজেদের ব্যাগ, বস্তা দুটো আর এক বার দেখে নিল। বললাম, ‘দু’স্টপ হেঁটে চলে যাও রাস্তা দিয়ে। বড় রাস্তা পড়বে। বাইপাস বলে। ওই ধরে সোজা হাঁটলে ট্যাংরা পৌঁছে যাবে। কেউ কিছু বলবে না।’ যেতে যে অনেক ক্ষণ লাগবে সেটা আর ভাঙলাম না। ওরা গ্রামের লোক, ঠিক চলে যাবে। প্রথম জন আবার বিড়ি বের করেছে। আমি লাইটার দিলাম। মুখ-চোখ দেখে মনে হচ্ছে ওরা ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। যদি বোঝে যে, শহরে ঢোকার দরকার নেই, বাইরে বাইরে দিয়েই মাল বেচে চলে আসা যাবে, তা হলে ভালই হয়। মুখটা কাছে নিয়ে গিয়ে নরম করে বললাম, ‘ও-ই করো, ভাল হবে।’ এক জন চাপা স্বরে বলল, ‘থানা পড়বে না তো?’ গলা শুনে আন্দাজ করলাম আমার কথাটা মনে ধরেছে। আমিও বললাম, ‘না না, ছোট পুলিশ আছে, কিন্তু ওদের নজর মালভরতি লরির দিকে, তোমাদের আর কী-ই বা আছে বলো।’ মাল তুলে নিল দুজন, তার পর আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল। ওরা একটু দূরে চলে যেতেই দেখি সামনের রাস্তায় চটচটে জলীয় কী যেন একটা পড়ে আছে। এখানেই দ্বিতীয় জনের ব্যাগটা রেখেছিল। চারপাশে কেউ নেই দেখে উবু হয়ে বসলাম। কালচে লাল একটা পদার্থ, আঙুল দিয়ে ছুঁয়েও দেখলাম। ভুরভুর করে গুড়ের গন্ধ বেরোচ্ছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.