প্রবন্ধ ২...
পাবলিক যা চায়, যে ভাবে চায়?
নাটক শেষ হয়েছে। অ্যাকাডেমির মঞ্চে দর্শকদের সামনে এসেছেন পরিচালক ও তাঁর কলাকুশলীরা। এক দর্শক প্রশ্ন করলেন, আজই কেন এই নাটকের শেষ অভিনয়? কেন আপনারা বন্ধ করে দেবেন নাটক? পরিচালক কাঁদতে কাঁদতে বলতে আরম্ভ করলেন, “আমি অন্তরালে থেকে কাজটা করে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এই নাটককে ঘিরে এখন কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ফোন করে কুৎসিত মন্তব্য করা হচ্ছে। সুমন মুখোপাধ্যায়, কৌশিক সেনরা যে ভাবে থুতু ছেটাচ্ছেন তাতে ভয়ে নয়, ঘেন্নায় নাটক বন্ধ করছি আমরা।” “দু’জন সমালোচক কী বললেন তাই শুনে নাটক বন্ধ করবেন কেন? ওঁরাই কি সব বোঝেন নাকি?” আর এক দর্শকের কথা, ভেসে এল ব্যালকনি থেকে। অতঃপর আরও কেউ কেউ। তাঁদের প্রায় সকলেরই এক কথা: নাটক বন্ধ করা চলবে না। দর্শকদের চাহিদায় পরিচালক এ বার কিছুটা নরম, “আপনারা ফেসবুক, মেলের মাধ্যমে মতামত জানান, হলের বাইরে রাখা ফিডব্যাক ফর্ম পূরণ করে পাঠান, তার পরে আমরা দেখব নাটকটা আবার অভিনয় করা যায় কি না।”
ফেসবুকেই এক জনের একটি মন্তব্য এবং তার সূত্রে হুমকি-বিতর্কে ‘শেক্সপিয়র্স ট্র্যাজিক হিরোজ: ওথেলো, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট’ নাটকের অভিনয় বন্ধ করার সিদ্ধান্ত। আবার জনতার দাবিতে সেই নাটকের পুনরভিনয়ের বিবেচনা। বাংলা থিয়েটারকে সাম্প্রতিক সময়ে এমন করে আম আদমির দরবারে যেতে দেখা যায়নি। ‘গ্রুপ থিয়েটার’-এ দর্শকের সঙ্গে সংযোগ আগেও ঘটেছে। কিন্তু তা মূলত চিঠিপত্র আর সমালোচনার মধ্য দিয়ে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কোনও কোনও নাটক সম্পর্কে দর্শকদের মতামত নিতেন ছাপানো প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে। ১৯৯৭-এ অন্য থিয়েটার-এর ‘অদ্ভুত আঁধার’ পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের সমালোচনা করে প্রচুর বিতর্ক তৈরি করেছিল। তখন রীতিমত পোস্টকার্ডে প্রশ্ন ছাপিয়ে দর্শকদের মতামত সমীক্ষা করেছিলেন বিভাস চক্রবর্তী। নাটকটি বন্ধ করা উচিত কি না, তেমন প্রশ্নও ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ‘স্বার্থান্বেষী মানুষের ব্যক্তিগত আক্রমণের’ কারণে পাঁচ-ছ’টি শোয়ের পরেই নাটক বন্ধ করে দেওয়ার বিজ্ঞাপন দিতে হয়নি।
অথচ রাষ্ট্র এ নাটক বন্ধ করতে চায়নি। প্রশাসনের এখানে কোনও ভূমিকা নেই। নাটকের কোনও অভিনয়ে কোনও আইনশৃঙ্খলা-জনিত সমস্যাও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে কোনও বিতর্কবার্তাও নেই এই ওথেলো-য়। কেবল একটি দৃশ্যে ‘ওথেলো’র সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়া নিয়ে ফেসবুকের একটি মন্তব্যকে করে তোলা হয়েছে মিডিয়ার কোলাহলের কেন্দ্রবিন্দু। সেই নগ্নতা নিয়ে মিডিয়ায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে। নাটকটির প্রথম অভিনয়েই অবশ্য ওথেলো সম্পূর্ণ সম্মুখ-নগ্ন হননি। কলকাতার মঞ্চে এই প্রথম ‘মেল ফ্রন্টাল ন্যুডিটি’ জাতীয় সংবাদ ফলাও করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পরে ওই চরিত্রের অভিনেতা ক্রমে সম্পূর্ণ নগ্ন হতে পেরেছেন। নাটকের পরিচালক মণীশ মিত্রই বলছেন, “প্রথমে ও অতটা সাহস করতে পারেনি। অভিনেতারও তো একটা যাত্রা থাকে।”
প্রশ্ন উঠবেই, সেই যাত্রাটা অন্তরালে হলেই তো ভাল হত, শুধু নাটকের দর্শকরা ‘শিল্পের প্রয়োজনে’ ওই নগ্নতাকে মঞ্চে দেখতেন। এত শোরগোলের কি কোনও প্রয়োজন ছিল? “আমি আড়ালেই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু খবরটা বেরিয়ে গেল,” আক্ষেপ মণীশের। খবরটা ‘বেরিয়ে গেল’ বলেই ‘আম আদমি’ আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন এ নাটকে। নাটকের শেষ অভিনয়ে তার যে অংশটি উপস্থিত ছিলেন তাঁরা দাবি তুললেন, ওথেলো-র ওই নগ্ন দৃশ্যসমেত পুরো নাটকটাই ফের অভিনীত হোক। নাট্যপরিচালক জনতার সেই দাবি মেনে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু যদি উল্টোটা হত?
প্রশ্নটা এইখানেই। আম আদমি মানেই তো আসলে ছ’জনায় মিলে পথে চলানো। তার বিপদ যে কী, সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দিল্লিতে ‘আপ’-এর সরকার। কিন্তু সরকারের কথা আপাতত থাকুক। সংখ্যাগরিষ্ঠের তন্ত্র, তাকে দশচক্র বলি আর না-ই বলি, সে তো আসলে শিল্পীর স্বাধীনতার শত্রুই। ওথেলো-র নগ্নতা ‘অশ্লীল’ মনে হয়েছে কি না, বার বার মণীশ জানতে চেয়েছেন দর্শকের কাছে। চাইতেই পারেন। জিজ্ঞাসার স্বাধীনতা তাঁর নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু জনগণেশ বড় বিষম বস্তু। আমজনতার দরবার যদি নিয়ন্ত্রণ করে শিল্পীর সিদ্ধান্তকে সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে হয়তো ভাল, শিল্পের পক্ষে নয়।
এই আশঙ্কাটাকে অবশ্য আমল দিতে চান না মণীশ। কারণ এ তাঁর কাছে নিছক ‘দর্শকের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের প্রক্রিয়া’। মণীশ বলছেন, “যাঁরা রাত জেগে হাজার টাকার টিকিট কেটে আমাদের উরুভঙ্গম-এর মতো সম্পূর্ণ স্টারবর্জিত নাটক দেখেছেন সেই দর্শকের কাছে আমার একটা দায় আছে। তাঁদের অভিরুচি আমি উপেক্ষা করতে পারি না।” তা হলে এই যে এত মানুষ নাটকটি আবার অভিনয় করতে বলছেন নাটকটির, করবেন? “আমরা সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি,” বলছেন পরিচালক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.