সম্পাদকীয়...
বিনা ধ্রুপদী ভাষা
য়পুর সাহিত্য উৎসবে অমর্ত্য সেন ‘ক্লাসিকাল’ অর্থাৎ ধ্রুপদী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব চিহ্নিত করিয়াছেন। দুনিয়ার নানা জাতির মতোই ভারতবাসীও এখন ধ্রুপদী ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে উদাসীন। অনেকেরই ধারণা হইয়াছে যে, প্রগতির সহিত ধ্রুপদীয়ানার বিরোধ আছে। ভ্রান্ত ধারণা। ধ্রুপদী জ্ঞান প্রগতির অনুঘটক। মৌলিক শিক্ষা এবং জ্ঞানচর্চা কেবল প্রযুক্তির শিক্ষায় সীমিত থাকিতে পারে না, তাহা বহুমাত্রিক হওয়া জরুরি। দুনিয়া জুড়িয়াই মৌলিক শিক্ষা বিপন্ন। জ্ঞানচর্চায় তাহার ক্ষতিকর প্রভাব পড়িতেছে। শিক্ষাবিদরা তাহা লইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বাঙালির সমস্যা তাহার অধিক। তাহার কারণ, শিক্ষার ন্যূনতম মান হইতেই সে বিচ্যুত হইয়াছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃত চর্চার গুরুত্ব সমধিক। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী শাসকেরা কেবল ইংরাজির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হন নাই, সংস্কৃতের প্রতিও বিরূপ ছিলেন। তাঁহাদের বাস্তববিমুখ অপরিণতি সংস্কৃতকে পুরোহিততন্ত্রের ভাষা ও ইংরাজিকে সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা হিসাবে চিহ্নিত করিয়াছিল। ফল: প্রাথমিক শিক্ষা হইতে ইংরাজির বিদায়ের পাশাপাশি বিদ্যালয় শিক্ষায় সংস্কৃত ভাষার গুরুত্ব হ্রাস। এই হ্রাস ও নাশের ফল ছাত্রছাত্রীদের দক্ষতার ক্ষয়।
প্রশ্ন উঠিতে পারে, ইংরাজি বিদায় যে ক্ষতিকর তাহা বোঝা গেল, কিন্তু সংস্কৃত না পড়িলে কী ক্ষতি? একদা এশিয়াটিক সোসাইটির বক্তৃতায় উইলিয়ম জোন্স সংস্কৃতকে লাতিন ও গ্রিকের চাহিতেও ‘অনুকরণযোগ্য’ বলিয়া রায় দিয়াছিলেন। ইহা কথার কথা ছিল না। সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ পড়িলে বুঝিতে পারা যায়, এই ভাষা অত্যন্ত বিধিবদ্ধ। তাহার ভাষাবিধিগুলির পশ্চাতে গাণিতিক প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানমনস্কতা বর্তমান। এই ব্যাকরণের চর্চায় কেবল ভাষাবোধ নয়, যুক্তিশৃঙ্খলার বোধও তীক্ষ্নতর হয়। লক্ষণীয়, বঙ্গদেশের পুরাতন বিদ্যালয়গুলিতে সংস্কৃতের পণ্ডিতেরা অনেকেই গণিতেরও পণ্ডিত ছিলেন। আর সাহিত্য? সংস্কৃত ভাষায় রচিত সাহিত্য তাহার ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং উৎকর্ষে প্রথম সারির। শিক্ষার সামগ্রিক বিকাশের যে যুক্তিতে ধ্রুপদী সংস্কৃতির চর্চা গুরুত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করা হয়, সংস্কৃতের ক্ষেত্রে তাহা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ বন্ধ হওয়ায় তাই ভারতীয় মন এবং মনন ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। এই ধ্রুপদী ভাষা-সাহিত্য পড়িলে বিশ্বায়িত দুনিয়ায় যোগ্যতা প্রদর্শনের অসুবিধা হইত না, সুবিধাই হইত। তাহার চর্চা ছাড়িয়া ভারতবাসী, বিশেষ করিয়া বাঙালি, নিজেদেরই ক্ষতি করিয়াছে।
এই ক্ষতি ‘অপূরণীয়’ নয়। প্রতিকারের উপায় আছে। উপায় শিক্ষায় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সসম্মান পুনর্বাসন। সংস্কৃত শিখিতে হইবে। যত অল্প বয়সে শেখা শুরু করা যায়, তত ভাল। বিদ্যালয় স্তরে সংস্কৃত পাঠ আবশ্যিক করা উচিত। শৈশবে মন তাজা থাকে, অর্জনের সামর্থ্য বেশি থাকে। ইংরাজি, বাংলা, সংস্কৃত লইয়া পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে ত্রিভাষা প্রকল্প গড়িয়া তোলা উচিত। ইংরাজির প্রত্যাবর্তন, অন্তত নীতিগত ভাবে, শুরু হইয়াছে। সংস্কৃত আজও সমান অবহেলিত। যে ভাষা-জননীকে বাঙালি একদা গৃহহীন করিয়াছিল, তাঁহাকে সসম্মানে ফিরাইয়া আনুক। ‘জননী’ কথাটি আলঙ্কারিক নয়, বাস্তবিক। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের সন্তান। সংস্কৃতের জ্ঞান বাংলা ভাষার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করিবে। বাংলা ভাষা চর্চার স্বার্থেই সংস্কৃত পড়া দরকার। বস্তুত, ইংরাজি এবং সংস্কৃত, দুইটি ভাষা এবং সাহিত্যের চর্চাই বাংলার যথার্থ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে অত্যাবশ্যক। অত্যাবশ্যক ধ্রুপদী সংস্কৃতি হইতে পুষ্টি সংগ্রহ করা। বাঙালির শিক্ষা যেখানে পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে কথাগুলি অসম্ভব এবং অবিশ্বাস্য বোধ হইতে পারে। তাহা কথাগুলির দোষ নহে, বাঙালির শিক্ষার অধঃপাতের দোষ।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.