গরিমা স্মৃতি মাত্র, শাসক দলের হাতিয়ারের নাম এখন সিআইডি |
সরকার তথা শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য সিআইডি-কে ব্যবহার করার নজির কম নেই। লিখছেন
সুরবেক বিশ্বাস |
টেলিভিশনের পর্দায় ‘ব্রেকিং নিউজ’ দেখে অফিসার তো তাজ্জব! তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, এই খবর কী ভাবে সম্ভব। ২০১০-এর জুলাই। তার কয়েক দিন আগে মাওবাদীদের রাজ্য কমিটির সদস্য, নন্দীগ্রামের মধুসূদন মণ্ডল ওরফে নারাণ সিআইডি-র হাতে ধরা পড়েছেন। মধুসূদনকে জেরা করে নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের জাল বিস্তারের খবর, সেখানে ২০০৭-এ ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরক্ষা কমিটির আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন তথ্য জানার চেষ্টা করছিলেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে এক দিন দিল্লির একটি ইংরেজি ট্যাবলয়েডকে উদ্ধৃত করে কয়েকটি টিভি চ্যানেল দেখাতে শুরু করল এক বিস্ফোরক খবর। মধুসূদন নাকি ভবানী ভবনে সিআইডি গোয়েন্দাদের জেরার মুখে জানিয়েছেন, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনে সামিল মাওবাদীদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী।
সেই খবরের সঙ্গে ইংরেজি সাইক্লোস্টাইল করা একটি কাগজ টিভির পর্দায় দেখিয়ে বলা হচ্ছিল, ওটা সিআইডি-র তৈরি মধুসূদনের ইন্টারোগেশন রিপোর্ট এবং তাতে এই ব্যাপারে সবিস্তার তথ্য রয়েছে।
সিআইডি-র সেই অফিসার বললেন, “এ তো ডাহা মিথ্যে। মধুসূদন জেরায় এক বারও শুভেন্দু অধিকারীর নাম বলেনি।” এমনও তো হতে পারে, তাঁর অনুপস্থিতিতে ওই মাওবাদী নেতাকে জেরার সময়ে তিনি অন্য কোনও অফিসারকে সে কথা বলেছিলেন? কিন্তু ওই অফিসার কিছুতেই তা মানবেন না। তাঁর সাফ কথা: “মধুসূদন যদি এ রকম বলেও থাকে, তা হলেও সেটা ইন্টারোগেশন রিপোর্টে নেই।” এতটা জোর দিয়ে তিনি কী ভাবে বলছেন সে কথা? ওই দুঁদে গোয়েন্দার কথায়: “প্রথমত, ইন্টারোগেশন রিপোর্ট আমিই টাইপ করছি। দ্বিতীয়ত, সেটি কম্পিউটারে লেখা হচ্ছে, সাইক্লোস্টাইলের কোনও প্রশ্ন নেই। সে সব আমাদের বিভাগ থেকে বহু দিন আগেই উঠে গিয়েছে।” |
|
পরে অবশ্য কলকাতা পুলিশে সেই সময়ে কর্মরত এক আইপিএস অফিসার কয়েক জন সাংবাদিককে ডেকে ওই রিপোর্টের কপি দিয়েছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই জানা গিয়েছিল, সিআইডি-র ইন্টারোগেশন রিপোর্ট বলে যেটা দেখানো হচ্ছিল, সেটা আসলে আইবি, অর্থাৎ রাজ্য গোয়েন্দা শাখার ইন্টারোগেশন রিপোর্ট।
প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও আইবি-র রিপোর্ট যে তাঁদের নামে চালানো হচ্ছে, সে কথা বুঝতে পেরে সিআইডি-র কর্তারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু সেই স্বস্তি ছিল ক্ষণস্থায়ী। দু’-তিন দিনের মধ্যেই ‘উপর’ থেকে ভবানী ভবনে নির্দেশ এল, মধুসূদনকে দিয়ে ওই কথাটাই যে করে হোক বলাতে হবে এবং তার পর তা যোগ করতে হবে সিআইডি-র ইন্টারোগেশন রিপোর্টে। কারণ, আইবি-র ওই রিপোর্টে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব রয়েছে বলে মত দিলেন পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের একাংশ।
ভবানী ভবনের চার তলায় এক আইপিএস অফিসার বাছাই কয়েক জন ইনস্পেক্টর ও সাব ইনস্পেক্টরকে নিয়ে এক জরুরি বৈঠকে বসলেন। সেখানে ঠিক হল, মধুসূদনকে এমন প্রশ্ন করতে হবে, যাতে তিনি জেরায় বলে দেন, মাওবাদীদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করতেন শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু তার আগে এক সপ্তাহেরও বেশি সিআইডি হেফাজতে থাকা ওই মাওবাদী নেতা তো এক বারও এমন প্রসঙ্গের উল্লেখই করেননি। তা হলে এখন তিনি বলবেন কেন? ওই আইপিএস অফিসার নির্দেশ দিলেন, প্রশ্নটা করতে হবে এই রকম: শুভেন্দু অধিকারীই তো তোমাদের বন্দুক, বোমার মালমশলা দিত, তা-ই তো? তার পর শুধু মধুসূদনের ‘হ্যাঁ’ বলার অপেক্ষা। আর তাতেই কাজ হবে! সব আটঘাট বেঁধে এই পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও রেকর্ডিং-ও করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল মধুসূদনকে নিয়ে। গণ্ডগোলের আঁচ কোনও ভাবে পেয়ে গেলেন তিনি। তাই, জেরার সময়ে যত বারই ওই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হল, তত বারই মাওবাদী নেতা কেবল ‘আমি কিছু জানি না’ বলে চুপ করে গেলেন।
সে যাত্রায় আসামি কিছুতেই সহযোগিতা করতে না চাওয়ায় সিআইডি-কে দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ওই মতলব শেষ পর্যন্ত বানচাল হয়ে যায়। কিন্তু সরকার তথা শাসক দলের রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য সিআইডি-কে ব্যবহার করার নজির কম নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দল যেমন সিবিআইয়ের জুজু দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কিংবা কোনও ক্ষেত্রে জোটসঙ্গীদেরও শান্ত রাখে, তেমনই রাজ্য সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কখনও ব্যবহার করে কিংবা কখনও নিষ্ক্রিয় রাখে সিআইডি-কে।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার গার্ডেনরিচের হরিমোহন ঘোষ কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন জমা দেওয়াকে ঘিরে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ঠেকাতে গিয়ে দুষ্কৃতীদের গুলিতে নিহত হন কলকাতা পুলিশের সাব-ইনস্পেক্টর তাপস চৌধুরী। কলকাতা পুলিশের এলাকায় ঘটনা ঘটলেও তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডি-র হাতে। যদিও সিআইডি সাধারণত কলকাতা পুলিশের এলাকার বাইরে ঘটা অপরাধেরই তদন্ত করে। তা হলে গার্ডেনরিচে এসআই খুনের মামলার তদন্ত সিআইডি করল কেন? কলকাতা পুলিশ এবং সিআইডি অফিসারদের একাংশের মত, গার্ডেনরিচের ওই ঘটনায় স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের নাম জড়িয়েছিল বলে মামলা দুর্বল করতে চেয়েই সিআইডি-কে তদন্তভার দেওয়া হয়। প্রকাশ্যে অবশ্য কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তারা সেই সময়ে অন্য কথা জানিয়েছিলেন।
তাঁদের বক্তব্য ছিল, এক অফিসার গুলিতে খুন হওয়ায় বাহিনী সেই সময়ে এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিল। তার উপর ওই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব কলকাতা পুলিশ পেলে যুক্তির জায়গায় আক্রোশ ও আবেগ অগ্রাধিকার পাবে এবং সে ক্ষেত্রে তদন্তে সত্য উদ্ঘাটিত হবে না বলে আশঙ্কা করেছিলেন প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু সিআইডি-র তদন্তেই বা কী সত্য উদ্ঘাটিত হতে দেখা গেল? |
|
এসআই খুনের মামলায় অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যান মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাকে গ্রেফতার করে সিআইডি। কিন্তু হেফাজতে পাওয়া ওই রকম গুরুত্বপূর্ণ অভিযুক্তকে জেরায় জেরায় জেরবার করে দেওয়া হলেও মুন্নার ক্ষেত্রে সে রকম কিছুই হয়নি। সিআইডি-র কয়েক জন তুখোড় অফিসারকে নিয়ে যে তদন্তকারী দল তৈরি করা হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই এই ব্যাপারে আক্ষেপ করেছিলেন। সেই সময়ে তাঁদের বক্তব্য ছিল, মুন্নাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহসন চলছে। তাঁকে লকআপ থেকে বের করে কোনও সিনিয়র অফিসারের ঘরে এনে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। বড়জোর এক ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে গোয়েন্দাদের। তা-ও কোনও প্রশ্ন এড়িয়ে গেলে বা অস্বীকার করলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য রকম প্রশ্ন করে ধৃতকে চাপে ফেলে দেওয়ার কৌশলও মুন্নার ক্ষেত্রে তাঁরা নিতে পারছেন না। গোয়েন্দাদের বলা হচ্ছে, মুন্নার ক্ষেত্রে এটা করা যাবে না।
হেফাজতে থাকা মুন্নাকে এতটা রেয়াত করা নিয়ে সিআইডি-র দুই শীর্ষকর্তার মধ্যেই বিরোধ বেধেছিল। যে কর্তা মুন্নাকে অতটা খাতির করার পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি পরবর্তী সময়ে অন্যত্র বদলি হন।
অথচ ২০১১-র অগস্টে বেনাচাপড়ার কঙ্কাল কাণ্ডে ধৃত সিপিএম বিধায়ক ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্ত ঘোষকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলেও টানা জেরা করা হয়েছে। এমনকী, কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটুও বিরতি না দিয়ে টানা ছ’ঘণ্টা জেরা করা হয়েছে ওই সিপিএম নেতাকে। জেরা করতে করতে গোয়েন্দাদের একটি দল ক্লান্ত হয়ে পড়লে অন্য দল জেরা শুরু করেছে। কিন্তু সুশান্তবাবুর কোনও বিশ্রাম ছিল না। শুধু তা-ই নয়, গভীর রাতে সিআইডি-র এক ডিএসপি পদমর্যাদার অফিসার লকআপে গিয়ে ওই প্রাক্তন মন্ত্রীর ঘুম ভাঙিয়ে তাঁকে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিতে শুরু করেন। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও কিছু ক্ষণের মধ্যে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ওই সিপিএম বিধায়ক তীব্র প্রতিবাদ জানান। পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়ে পিছু হটেন ওই ডিএসপি। প্রাক্তন মন্ত্রী তখন রাগে থরথর করে কাঁপছেন। হুমকি দিচ্ছেন, তিনি এই ব্যাপারে আদালতে ও মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ জানাবেন। সে ক্ষেত্রে সিআইডি-রই মুখ পুড়বে, সে কথা বুঝতে পেরে ওই জায়গায় উপস্থিত সিআইডি-র অন্য কয়েক জন অফিসার তড়িঘড়ি শান্ত করার চেষ্টা করেন সুশান্তবাবুকে। বেশ কিছু ক্ষণের চেষ্টায় শেষমেশ নিরস্ত হন তিনি। |
|
এক অফিসারের কথায়, “বর্তমান বিধায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবে সুশান্ত ঘোষকে খাতির করা দূরে থাকুক, কখনও কখনও ন্যূনতম সৌজন্যও দেখানো হয়নি। আমাদের বলাই হয়েছিল, সুশান্ত ঘোষকে যতটা সম্ভব চাপে রাখতে হবে। যাতে বেনাচাপড়ার কঙ্কাল-কাণ্ডে তিনি সিপিএমের আরও তাবড় নেতার নাম জেরায় বলেন। সে ক্ষেত্রে ওই সব নেতাকে গ্রেফতার করে সিপিএমকে আরও বেকায়দায় ফেলতে পারত সরকার।”
তা ছাড়া, ওই কঙ্কাল কাণ্ডে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রকে অভিযুক্তদের তালিকায় রাখতে বিশেষ মহল থেকে নির্দেশ এসেছিল সিআইডি-র কাছে। কিন্তু সেই সময়ে সিআইডি-তে থাকা ডিআইজি পদমর্যাদার এক আইপিএস অফিসার খোঁজখবর করে জানিয়ে দেন, সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ নেই। শুধু তা-ই নয়, ওই একই তদন্তে দলে দলে সিপিএম নেতা-কর্মীর নাম অভিযুক্তদের তালিকায় রাখতে বলা হয়েছিল সিআইডি-কে। সে ক্ষেত্রেও বেঁকে বসেছিলেন ওই ডিআইজি।
কিন্তু সব সময়ে সিআইডি-তে ওই ধরনের ডিআইজি থাকেন না। সিআইডি-ও তাই নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে পারে না। কখনও শাসক দলের অভিযুক্ত কোনও নেতাকে আড়াল করতে সিআইডি-কে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়, আবার সেই অভিযুক্ত যদি বিরোধী দলের হন, তা হলে অতি সক্রিয় হতে বলা হয় সিআইডি-কে। মূলত রাজ্য পুলিশের অপরাধ দমন শাখা সিআইডি কয়েক বছর আগেও মাওবাদী নেতা, আইএসআই মদতে পুষ্ট জঙ্গি, আন্তঃরাজ্য মাফিয়া, দুর্ধর্ষ ডাকাত, সাইবার অপরাধী, অস্ত্র পাচারকারীদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত বলে গণ্য হত। এখন সে সব অতীত মাত্র। সিআইডি এখন যেন শুধুই রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করার হাতিয়ার। |
|