ছাত্র-সংসদের নির্বাচনকে ঘিরিয়া হিংসা, হানাহানি, বিদ্বেষ অব্যাহত। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে হরিমোহন ঘোষ কলেজের নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া সংঘটিত হিংসা ও সন্ত্রাসের প্রেক্ষিতে ছয় মাসের জন্য নির্বাচন-প্রক্রিয়া স্থগিত করিয়া যে কোনও লাভই হয় নাই, তাহা স্পষ্ট। নূতন করিয়া ভোটের আয়োজন শুরু হইতে-না-হইতে কলেজে-কলেজে মনোনয়নপত্র তোলা ও জমা দেওয়াকে ঘিরিয়াই হিংসা ও উচ্ছৃঙ্খলতার তাণ্ডব শুরু হয়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ব্যাপক পুলিশি নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় ভাবে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনে অধ্যাপকরা মনোনয়নপত্রগুলি লইয়া আসেন। সেখানেই অতঃপর সেগুলি ততোধিক কড়া প্রহরায় পরীক্ষিত হইবে। নির্বাচনের দিন কী ধরনের গোলমাল, মারপিট, বোমাবাজি হইবে, তাহা অনুমান করিলেও আতঙ্ক হয়।
কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে জবরদস্তি ছাত্র-সংসদ দখলের যে প্রক্রিয়া পূর্ববর্তী জমানায় শুরু হইয়াছিল, তাহা প্রশমিত হওয়ার কোনও লক্ষণ তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবর্তনের সরকারের আমলে দেখা যায় নাই। ছাত্র-রাজনীতির কলুষ দূর হয় নাই। সহপাঠিনীর শ্লীলতাহানির দায়ে হাজত-বাস করা ‘ছাত্র’ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের হাত হইতে পুরস্কার লয়। প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়া শাসক দলের নেতারা কলেজে ঢুকিয়া কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তারক্ষীদের শাসাইয়া যায়। এই অরাজকতার পিছনে শিক্ষক, পরিচালন সমিতির সদস্য, অশিক্ষক কর্মী— সর্ব স্তরের রাজনৈতিক মেরুকরণ ও বিভাজনের প্রভাব আছে। পরিচালন সমিতির সদস্য বা সভাপতিরা যখন কলেজের অধ্যক্ষ বা অধ্যাপিকাকে নিগ্রহ করিয়াও বুক ফুলাইয়া ঘুরিয়া বেড়ান, তখন ছাত্রদের সামনে যে নজির স্থাপিত হয়, তাহা বিশৃঙ্খলায় মদত দিবেই। কিন্তু এই সমস্যার মূলে আছে ছাত্র-রাজনীতির অঙ্গনকে রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যতের নেতা-ক্যাডার সংগ্রহের প্রশিক্ষণকেন্দ্র রূপে গণ্য করার প্রবণতা। তাই ছাত্র-রাজনীতিতে হিংসা, দলীয় আনুগত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদ, দলের প্রভাব বাড়াইবার তাড়না এমন অনিবার্য হইয়া ওঠে।
লিংডো কমিশন রাজনীতি-বর্জিত ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের সুপারিশ করিয়াছিল। ইহাই যথার্থ নীতি। ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতির সহিত সম্পর্কশূন্য হইবে, এমন নয়। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের সহিত তাহার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক থাকিবে না। ছাত্র সংগঠন একান্ত ভাবেই ছাত্রস্বার্থে নিয়োজিত, শিক্ষার অগ্রগতির সমস্যা মীমাংসায় নিবেদিত অথবা উচ্চশিক্ষা বা রাজনীতি বিষয়ক নূতন ভাবনা, ধ্যানধারণা, বিতর্কের মধ্য দিয়া প্রবাহিত। বাস্তবে যাহা দেখা যায়, তাহা হইল, প্রচলিত রাজনৈতিক দলের অনুগামী সংগ্রহের জন্য ছাত্র-সংসদের অপব্যবহার। লিংডো কমিশন ইহাকেই নিবারণ করিতে চাহিয়াছিল। সুপ্রিম কোর্টও তাহাতে সম্মত ছিল। কিন্তু রাজ্যে-রাজ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তৃপক্ষ কমিশনের সুপারিশ শিরোধার্য করে নাই। ফলে ছাত্র-রাজনীতিতে দলীয় আনুগত্যভিত্তিক বিভেদপন্থা, পারস্পরিক বিদ্বেষ ও হানাহানির প্রকোপ যথাপূর্বম্। পশ্চিমবঙ্গে ইহার অন্যথা নাই। যে নিরাপত্তা ঘেরাটোপে এ বারের ছাত্র-সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইতেছে, তাহা নজিরবিহীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলি দুর্গের চেহারা লইয়াছে, বিদ্যাস্থানে বিদ্যার্থীদের আসা-যাওয়াও নিয়ন্ত্রিত হইতেছে। একদা ছাত্র ছিলেন, এমন রাজনীতিকরা প্রভাবাধীন কলেজে বসিয়া প্রায়শ ছাত্রছাত্রীদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করিতেছেন। পূর্বসূরিদের তুলনায় বর্তমান শাসকরা দলতন্ত্রের সর্বগ্রাসী প্রসারে ঈষৎ কম আগ্রহী হইবেন, এমন একটি আশা ছিল। আশা এখনও সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয় নাই। কিন্তু নীতি ও ব্যবস্থা না বদলাইলে আশামাত্র সার হইবে। |