|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪... |
|
পাবলো নেরুদা |
জয় গোস্বামী |
সেটা ’৭৩ সাল। কলেজ স্ট্রিটে, এক জুন মাসের বৃষ্টিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নতুন কবিতার বই কী বেরিয়েছে, খোঁজ করলাম দোকানে। কাউন্টারে চোখে পড়ল একটা বই: ‘পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ’। সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরই অনুবাদ করা। বাড়ি নিয়ে গিয়ে উলটে-পালটে পড়ি আর অবাক হই। ‘মাচু পিচুর শিখর থেকে’ কবিতাটি পড়ে এক রকম দিশেহারা ভাব তৈরি হল আমার। কী বিরাট ক্যানভাস! কত দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে যাওয়া কল্পনাবিস্তার! কিছুটা ধরতে পারি, বেশিটাই পারি না।—
‘পাথরের ওপর পাথর: মানুষ, কোথায় সে ছিল?
বায়ুর ওপর বায়ু: মানুষ, কোথায় সে ছিল?
সময়ের ওপর সময়: মানুষ, কোথায় সে ছিল?
তুমিও কি তখন ছিলে, নিষ্পত্তিহীন মানুষের
ফাঁপা ঈগলের ছোট্ট ভগ্নাংশ’...
দেড় বছরের মধ্যেই পেয়ে গেলাম— ‘পোয়েম্স: পাবলো নেরুদা’। পেঙ্গুইন-এর। অদ্ভুত ব্যাপার, বারোটি অংশে বিস্তৃত সুদীর্ঘ কবিতা ‘মাচু পিচুর শিখর থেকে’র শুধু একটা অংশ নেওয়া হয়েছে এই বইয়ে। ও দিকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনূদিত সংগ্রহে যে বইটি থেকে মাত্র গোটাদুয়েক লেখা নেওয়া হয়েছিল— হাতে এল তাও। ‘টোয়েন্টি লাভ পোয়েম্স অ্যান্ড আ সং অব ডিসপেয়ার’। ক’দিন আগে বন্ধুর কাছ থেকে এনেছি একটা ‘সিলেক্টেড পোয়েমস্’। এই সব বই খুঁজতে খুঁজতে অবাক হওয়ার শেষ রইল না আমার। ধরা যাক, ‘ওড’। ‘ওড’ বলতে যতটুকু যা বুঝতাম, তার সঙ্গে নেরুদার ‘এলিমেন্টাল ওডস্’-এর তো কোনও মেলামেশাই নেই! ‘ওড টু এ নেকেড বিউটি’, ‘ওড টু স্যাডনেস্’ না হয় মেনে নিতে পারছি, কিন্তু ‘ওড টু টম্যাটোজ’? ‘ওড টু ক্লোদ্স’? ‘ওড টু মাই সক্স’? এমনকী ‘ওড টু এ লার্জ টুনা ইন দ্য মার্কেট’! বাজারে একটা বড় টুনা মাছ দেখে তার ওপরে ওড? এই ভাবে ভাবতে পারে কেউ? অলিভ অয়েলের প্রশংসায় ওড? হয়? আসলে তখন তো আমার অবাক হওয়ার বয়স!
তবে নেরুদার যে লেখাটা পড়ে সবচেয়ে আলোড়ন পড়ল আমার মনে, সে কিন্তু কবিতা নিয়ে লেখা কবিতা। কী ভাবে কবিতা এসে এক জনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, কী ভাবে কাজ শুরু করছে, সেই অভিজ্ঞতার ঘটনাক্রম, যা সত্যি অবর্ণনীয়। কবিতা যার মধ্যে কাজ শুরু করছে, তাকে প্রায় সে কিছু না জানিয়েই শুরু করে দিচ্ছে নিজের খেলা। লেখক কিছুটা-কিছুটা ধরতে পারছে। বেশির ভাগই তার না- বোঝার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। হঠাৎ সে একটা ঘোরের দ্বারা গৃহীত হল। সেটা যেন এক রকম জ্বর বা ভুলে যাওয়া ডানা। জ্বর পর্যন্ত ভাবতে পারি আমি, কিন্তু ভুলে যাওয়া ডানা? এই তো অপ্রত্যাশিতের আবির্ভাব। ‘... I wrote the first faint line...’। ফার্স্ট লাইনটা কী রকম? না, faint line. এই ‘faint’ কথাটার বিকিরণ তার পরের কথাগুলিতেও আলো ফেলছে। ‘Faint, without substance, pure wisdom of someone who knows nothing.’ সত্যি তো, কবিতা রচনার একেবারে অন্তঃস্থলে গেলে আলাদা করে কি কিছু বোঝা সম্ভব হয়? সেই জন্যই তো রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ, আমাদের দুই মহাকবিকেও রচনাকালে বারংবার কাটাকুটিতে ছিন্নভিন্ন করতে হয়েছে পাণ্ডুলিপিকে। কবিতা লেখার আগে ও পরে এঁরা বহু কিছুই বলেছেন কবিতা সম্পর্কে। কিন্তু লেখার মুহূর্তে দুজনের কেউই কোনও দিন নিশ্চিত থাকেননি নিজেদের লেখা নিয়ে। তার প্রমাণ ওই প্রবল কাটাকুটি। এখানে আমার মনে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা ও আমার জীবন’ প্রবন্ধটির কয়েকটি কথা— ‘... কবিতার জন্মকথা সম্পূর্ণ ভাবে অনাবৃত হয় না কখনও। তার একটা অংশ চিরকাল গোপন থেকে যায়... প্রক্রিয়াটি ঘটে সচেতন ও অচেতন মনের সীমান্তরেখায়— কবি তার কিছুটামাত্র টের পান, বাকিটা অর্ধালোকে প্রচ্ছন্ন থাকে।’
এই যে বুদ্ধদেব বসুর ‘কিছুটামাত্র’, নেরুদা একে কী কী ভাবে টের পাচ্ছেন, তার একটু উদাহরণ এই ‘পোয়েট্রি’ কবিতায় রয়েছে। যেমন ‘Suddenly I saw, the heavens unfastened and open’. এই ‘unfastened’ কথাটা একেবারে অন্য রকম একটা অনুষঙ্গ আমার মনে নিয়ে এসেছিল। নারীর পোশাক, হাউসকোট বা বাথরোব জাতীয় পোশাক, যা একটা দড়ি টানলেই খুলে যায়— তা-ই যেন খুলে দিল কেউ আর মাথার ওপর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল আগুনজ্বলা অজস্র জ্যোতিষ্ক সহ সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড। ‘Drunk with the great starry void...’ এই জায়গাটা ভাবলে এখনও আমার প্রথম দিনের মতো শিহরন হয়। মদ এবং মাতাল— এই দুই রকম জিনিসই কাব্যসাহিত্য জগতের সূত্রে অতি বিশেষ ভাবে সকলের জানা। কিন্তু জ্যোতিষ্কময় সমগ্র মহাশূন্যকে তরল সমুদ্রের মতো পান করে মাতাল হতে পারে কেউ? তার পর কী হল? ‘... felt myself a pure part of the abyss, I wheeled with the stars.’ তারাদের সঙ্গে চাকার মতো গড়িয়ে চলল লোকটা? না লোকটার মন? মহাশূন্যের ওই যে ‘abyss’, ওই যে ‘bottomless hole’— তার মধ্যে চলে গিয়েছে তো লোকটা!
আর্থার সি ক্লার্ক-এর ‘২০০১ দ্য স্পেস ওডিসি’ নামের কল্পবিজ্ঞানের বই— যা নিয়ে স্ট্যানলি কুব্রিক ছবি বানিয়েছিলেন— সে বই তো নেরুদার এই কবিতার অনেক পরে লেখা। সে বইতে (ফিল্ম নয়) একটি সংলাপ আছে নভশ্চর ডেভিড বোম্যান-এর মুখে: ‘ওহ্ মাই গড! দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফুল অব স্টারস্!’ এইটাই তার শেষ সংলাপ। তার পর সেই নভশ্চর নেমে চলতে থাকে অন্য আর এক রকম রিয়ালিটির মধ্যে। সেও আর এক রকম মহাগর্তই বলা চলে। আবার, ফিল্মটিতে ডেভিড শেষ পর্যন্ত ফিরে যান ভ্রূণ অবস্থায়। ভ্রূণটি তার বন্ধ চোখ খোলে, ছবিটি শেষ হতে থাকে। ছবি দেখে, নেরুদার কবিতাটি মনে পড়েছিল। বিরাট ও অন্তহারা গহ্বরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে এ রকম কবিতা মানুষের মনকে ব্রহ্মাণ্ডের একটি ক্ষুদ্র অথচ সচেতন, সূক্ষ্ম অণু করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সে অণুুর মনঃশক্তি আছে।
এখানে বলা দরকার, নেরুদার কবিতার মূল প্রবণতার সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই বললাম না। নেরুদার কাব্যের যে জায়গাগুলি আমায় বশীভূত করে— তা হয়তো ভুল ভাবে করে। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছোট্ট ছোট্ট লেখাও নেরুদার পরিচয় তুলে ধরেছে বাঙালিদের কাছে। মানববাবুর একটা লাইন দিলেই তা অনেকটা পরিষ্কার হবে। ‘... মাচু-পিচু’র শিখরে পৌঁছে (এই) উৎকাঙ্খা প্রকাশ করেছিলেন পাবলো নেরুদা, যে, তাঁরই গলায় যেন কথা বলে ওঠে সব মানুষ।’ ‘আলো করে দাও সব কুঠার যা চকচক করে উঠেছে তোমার রক্তে।’ আমি হয়তো নেরুদার একটি খণ্ডাংশ নিয়েই আছি। হয়তো এই খণ্ডাংশের মধ্যেই আছে খুলে যাওয়া অবচেতন, আছে আকাশভরা মহাজগৎ।
|
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। |
|
|
|
|
|