|
|
|
|
|
সাহেবিয়ানার নেশা মাখা শহরে ‘মাংসের ময়রা’রা
এই বড়দিনের বাজারে এ শহরের অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা বাঙালি ক্রিশ্চান
গিন্নি এমন বন্ধুর দৌলতেই বাড়িতে পরিশ্রমের ঝক্কি থেকে রেহাই পান।
লিখছেন
ঋজু বসু |
|
মন দিয়ে তাল-তাল অক্স টাং স্লাইস করা দেখতে দেখতে ঘাড় নাড়লেন ধবধবে পাকা চুলের সালওয়ার কামিজধারিণী। “শুধু কলকাতা কেন, দিল্লি-ফিল্লি সব আমার দেখা! এমন ঠিকানা ভূভারতে মিলবে কি না সন্দেহ!” কেন্দ্রীয় সরকারের আমলা, বরের চাকরির দৌলতে ইতিমধ্যেই গোটা দেশ চষে ফেলেছেন সেই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গিন্নি।
ব্যবসার কাজে মাসের পর মাস ইউরোপে পড়ে থাকা গৈরিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিমত আরও জঙ্গি। লন্ডনেও তো ইদানীং ইন্ডিয়ান বাজার-দোকানেরই ছড়াছড়ি। সসেজ-সালামি-হ্যাম-বিফের ঠান্ডা মাংসের এমন সম্ভার বরং অস্ট্রিয়া-জার্মানিতে সহজে মিলবে। সন্ধেয় পছন্দসই কোল্ডকাটের বাজার সারতে এসে পেট চুঁই চুঁই করছে বুঝে কাগজে মুড়ে ১০০ গ্রাম বিফ কলার আলাদা চেয়ে নিলেন গৈরিক। কলার মানে পাঁজরার নীচের অঞ্চলের হাড়বিহীন মাংস। একদম ‘রেডি টু ইট’। ঠান্ডা ঘর থেকে বার করে একটু রয়ে-সয়ে নিলে বা হাল্কা গরম করলে আরও স্বাদ খোলে। ঝাল ঝাল মশলার ছোঁয়ায় নিখাদ ভারতীয় মেজাজ। সেই মাংসের ফালি চিবুতে চিবুতে বেরিয়ে গাড়িতে উঠলেন গৈরিক।
|
|
বিফ-পর্ক-ডাক-চিকেন—নানা রকমের ঠান্ডা মাংসের স্বাদ নিতে ক্রেতাদের লাইন। |
আমরা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কালম্যানের কথা বলছি। কোল্ডকাটকে বোধহয় মাংসের মোরব্বা বলা চলে। বিফ-পর্ক-ডাক-চিকেনের নানা কিসিমের ঠান্ডা মাংস বা মোরব্বার বৈচিত্র্যে কালম্যানের সঙ্গে টক্কর দিতে হাই ফাই শপিংমলের ফুডস্টোরও ডাহা ফেল মারবে। স্পেন-ইতালি-জার্মানির প্যাক করা সসেজ-সালামি কলকাতায় বয়ে আনলেও এই দেশি ঘরানার আলাদা মহিমা। খানদানি মাংস-রসিকদের মুখে নামী কোম্পানির প্রসেস্ড মিট রোচে না। তার থেকে কালম্যান ঢের নির্ভরযোগ্য। কালম্যানের কাছেই আর একটা ঠিকানা, নিউমার্কেটের পিছনের কালিঝুলিমাখা গলিতে টার্কির ঠেকের পাশের ইউপি স্টোর্স। তারা অবশ্য গোমাংস এড়িয়ে চলে। সসেজের বৈচিত্র্য, তুলতুলে পর্কবেলির ঝাল ঝাল পর্ক কলার থেকে শুরু করে বড়দিনের সাকলিং পিগরোস্ট— সবেতেই লড়ে যাচ্ছেন।
আর একটা কলকাতা
আজকের কলকাতায় মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখতে গেলে সাধ্যসাধনা করে চিকেনের দেখা মেলে। আমাদের উন্নয়নের সৌধ আখাম্বা ফুডকোর্ট অভিজাত পাড়ায় সাবধানে আমিষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে গজিয়ে উঠেছে। রেস্তদার শাকাহারীদের কথা ভেবে মেনু নিয়ে রেস্তোরাঁওলাদের নিত্যি গবেষণা চলছে। বহুজাতিক ফুডচেন অবধি নিজেদের ভোল পাল্টে ভেজ আইটেমের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এই পটভূমিতে কালম্যান বা ইউপি সত্যিই অন্য গ্রহের প্রাণী। রেড মিট নিয়ে স্বাস্থ্যবিধির চোখরাঙানির মুখে ছাই দিয়ে তারা বেঁচেবর্তে আছে। বা বহু যথার্থ রসিক খাইয়েকে প্রাণ ভরে বাঁচতে সাহারা দিচ্ছে।
এই বড়দিনের বাজারে এ শহরের অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা বাঙালি ক্রিশ্চান গিন্নি এমন বন্ধুর দৌলতেই বাড়িতে পরিশ্রমের ঝক্কি থেকে রেহাই পান। অন্তত দিন সাতেক ধরে গরম মশলা, নুন-লেবুর রসে মজানো তুলতুলে গোমাংসের সল্টমিট, মাখন-মখমলী অক্সটাং, উৎকৃষ্টতম স্যান্ডউইচের প্রাণভোমরা সালামি-হ্যাম-মিটলোফে কালম্যান খুঁতখুঁতে অবিশ্বাসীকেও হাঁটু গাড়তে বাধ্য করে। অনেকেই খবর রাখি না, ক্রিসমাস বা নতুন বছরে ক্লাবে কি রেস্তোরাঁয় জিভে জল আনা যে টার্কি বা ডাকের রোস্ট সাঁটিয়ে চলেছি, তা আদতে কালম্যানের সৃষ্টি। |
|
আহার-বাহার। |
এ সব বিলিতি খাবারের মহিমার সঙ্গে কিন্তু ইংরিজি কেতার সম্পর্ক নেই, তা মালুম হবে কালম্যানে ঢুকলেই। এইটুকুনি খুপরি দোকানঘর। ইংরিজিতে যাকে বলে ব্লিঙ্ক অ্যান্ড মিস্, মানে পলক পড়লেই সাইনবোর্ডটা চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই দোকানে ঢোকার সময়টা সাবধানে খেয়াল রাখতে হবে। ঢুকেই দেখবেন, কালম্যানের এখনকার অন্যতম কাপ্তেন জয় ঘোষের সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, গোয়ান বা অন্য যে কোনও ভিন ভাষার ক্রেতাগণ কেমন গড়গড়িয়ে বাংলা বলছেন।
পুরানো সে দিনের কথা
জয়ের জামাইবাবু বিষ্ণুপদ ধর ছিলেন এই ঠেকের আদি কর্ণধার কালম্যান কোহারির ডান হাত। সাহেবদের মাংসের মোরব্বার আর্টটা তিনিই শিখেছিলেন। হাঙ্গেরিয়ান সাহেব কালম্যানকে নিয়ে নানা মিথ। তিনি না কি সার্কাসের ট্র্যাপিজের খেলা দেখাতে ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে এখানেই পাকাপোক্ত ঘাঁটি গাড়েন। ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের কালম্যানেরও তখনই জন্ম। ’৬৯ সাল নাগাদ কালম্যান সাহেবের বউ-বাচ্চারা অস্ট্রেলিয়া চলে গেলে বিষ্ণুপদকে দোকান দিয়ে গিয়েছিলেন। বিষ্ণুপদবাবু সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী রুমা, মেয়ে আগমনীর সঙ্গে শ্যালক জয় কালম্যানকে টেনে নিয়ে চলেছেন।
নিউ মার্কেটের ইউপি স্টোর্স অবিশ্যি পুরোপুরি দেশি। লখনউয়ের দুলিচাঁদ সোনকার শুরু করেছিলেন, বছর ৪৫ আগে। দুলিচাঁদের পুত্র রাজীব, নামী কোম্পানির ব্র্যান্ডের সসেজ একটু-আধটু নিতে শুরু করলেও বাপের কাছে শেখা শিল্পের ধারা বজায় রেখেছেন।
সৃষ্টির উল্লাস
কালম্যান প্যাকিংয়ের কেতার পরোয়া করে না। কিন্তু কাজের যত্নে খামতি নেই। সাত-সকালে আগরপাড়া থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে হাজির হয়ে গণেশের ছবিটায় নমো করা ইস্তক জিরোনোর ফুরসত নেই জয়ের। খদ্দেরদের বিচিত্র আবদার মিটিয়ে নিজে হাতে মাংস কেটে দিতে দিতে হাজারো ক্লান্তিতেও তাঁর মুখের হাসিটা টাল খায় না। কাজ করতে করতেই বোঝান, কী ভাবে রোজ বিকেলে দোকানে মাংস কিউরিংয়ের মশলাজল তৈরি হবে বা ঠিকঠাক ম্যারিনেশনের স্বার্থে মাংসের গায়ে বঁটিছুরি ঠেকিয়ে খোঁচাখুঁচি করে নিতে হবে। হ্যাঁ, নুন ও নানা কিসিমের গরম মশলা ভরপুর পিকল্ড ওয়াটারকে পাতি বাংলায় মশলাজলই বলেন জয়। এর মধ্যেই সানি পার্কের চেনা মাসিমা হাজির। চিকেন হ্যাম পাইয়ের মাংস কিনে-টিনে আবদার, কী গো, আমার মাছটা একটু স্মোক করে দিতে হবে তো...
এই দোকান ছাড়াও বেলেঘাটার কারখানাতেও কর্মযজ্ঞ লেগে আছে। সেখানে সসেজ-সালামি-মিটলোফ-হাঁসের লিভারপেস্ট তৈরি ছাড়াও স্টিলের আলমারির আদলে স্মোকিং চেম্বার। লালচে হাঙ্গেরিয়ান সসেজগুলো সেদ্ধ করা হয় না। দেড় দিন ধরে কাঠ ও কাঠের গুঁড়োয় ধোঁয়া খাইয়ে খাইয়েই স্মোক্ড হয়। সানি পার্কের মিসেস গুপ্তর মাছটাও সুবিধেমতো সে-ঘরেই স্মোক করে দেবেন জয়। ঘণ্টা চার-পাঁচই যথেষ্ট। তবে বছরশেষের পার্টির চাপে এ সব আবদার সামলানো এখনই সম্ভব হচ্ছে না। কথা বলতে বলতেই চেনা খদ্দেরদের কাকে ফোনে সান্ত্বনা দিলেন, অর্ডারের চাপে এখন না-পারলেও জানুয়ারিতে পেটে পর্ক-বেক্ন ঠাসা দারুণ ডাকরোস্ট বানিয়ে দেবেন।
|
|
জয়ের মুখস্থ, খদ্দেরদের কে ফ্যাটবিহীন লিন বেক্ন পছন্দ করেন, কার জন্য স্পাইসি ককটেল সসেজ রাখতে হবে। আগে শুধু পর্ক কলার মিলত কালম্যানে, এখন বাড়তি পর্ক ফ্যাট খদ্দেরদের কারও কারও না-পসন্দ দেখে স্পাইসি বিফ কলারও চালু হয়েছে। নিজেকে ময়রার সঙ্গে তুলনা করতে ভালবাসেন এই মাংস-শিল্পী। জয় বলেন, “ময়রারা দুধ-ছানা নিয়ে যা করেন, রকমারি পাকের সন্দেশ, রসগোল্লা, পান্তুয়াটুয়া, আমরাও মাংস দিয়ে সেটাই করছি।”
হোয়্যার ইজ দা পার্টি টুনাইট
সঙ্গীত পরিচালক নীল দত্ত কালম্যানের গোঁড়া সমর্থক। নীলের বাবা অঞ্জন ও মা ছন্দার থেকেই সংক্রামিত এই ভালবাসা। তাঁর স্কুলে পড়ার বয়সে সিঁথির মোড় থেকে ছন্দারা আসতেন কালম্যানে। এখনও সে-ধারা অটুট আছে। নিজে রন্ধনপটিয়সী হয়েও চিকেন, পর্ক বা টার্কি রোস্টে কালম্যানকে কুর্নিশ জানাতে দ্বিধা নেই ছন্দার।
এমনিতে কোল্ড কাট বলতে লোকের পর্ক-বিফের কথা আগে মনে পড়লেও চিকেন সসেজের রকমারিতেও কালম্যান কম যায় না। ধর্মতলায় বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা গোয়ান প্রৌঢ় হিউবার্ট রবিন গোমেজ যেমন কালম্যানের স্পাইসি চিকেন সসেজের অন্ধ ভক্ত।
কালম্যানে টার্কি আসে টালিগঞ্জের সরকারি খামার থেকে, ক’মাসের শূকরশিশু বা সাকলিং পিগ নদিয়ার খামারজাত। পিগ রোস্টের পেটে ক্রেতার চাহিদা মতো চিকেন, পর্ক, বিফের কুচি ঠাসা হয়। ১০ জনে মিলে ভাগ করে খেতে খরচ ২৭০০ টাকা। ভাল ডাক রোস্ট, চার-পাঁচ জনে পেট ভরে খেতে হলে খান দুয়েক নেওয়া ভাল। এক-একটির দক্ষিণা ৩৬০ টাকা। হাঁসে বেশি পালক হলে রোস্ট জমবে না। দক্ষিণে জয়নগর, উত্তরে বনগাঁয় ভাল হাঁসের সন্ধানে কালম্যানের জাল ছড়ানো আছে। টার্কির এ সময়ে একটু দাম বেশি (৫০০ টাকা কেজি)। সাড়ে তিন কিলোর একটি টার্কি রোস্টের পরে পাঁচ-ছ’জনে খেতে পারবে। তবে কালম্যান-ইউপি-র বেশির ভাগ আইটেমের দামই সহনীয়।
সল্টমিট, অক্সটাং, রোস্ট স্যান্ডউইচে ভরে খেতেই বেশ। ডাকলিভারের পেস্ট চাখতে চাখতে মহার্ঘ ফরাসি পদ ফোয়া গ্রাকে মনে পড়বে। সাহেবি কায়দায় ওয়াইনযোগে খেলেই জমবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মাংসের কোফতাও বেড়ে বানায় কালম্যান। বাড়িতে রান্না করে মাখো মাখো ঝোলের বলকারিও তাতে দৌড়বে।
বাড়িতে এমন কোল্ড মিট রাখা থাকলে শীতের সকালে আড় ভাঙতে সুবিধে হয়। বছর শেষের হইচই, রঙিন আড্ডার অনুপান হিসেবেও সে থাকবেই। এই সাহেবিয়ানার নেশায় শক্তি চাটুজ্জের লাইন আওড়াতে গিয়ে হয়তো বা একটু ভুল হয়ে গেল! রাতের কল্লোল বুঝি বলে যায়, আমি ম্লেচ্ছাচারী...
|
ছবি: শুভেন্দু চাকী। |
|
|
|
|
|