মিষ্টি জলের হ্রদ। মঙ্গলের সেই হ্রদে হয়তো ঘুরে বেড়াত ছোট্ট ছোট্ট ব্যাকটেরিয়া। নাসার মঙ্গলযান কিউরিওসিটির পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে অন্তত এমনটাই জানাচ্ছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। তাঁদের সেই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স’ জার্নালে।
ভীষণ রুক্ষ সে প্রান্তর। যে দিকে চোখ যায় শুধু ধুলো আর মাঝে মধ্যেই ঝোড়ো হাওয়া। তারই মধ্যে এক মনে খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে মিস কৌতূহল। গত ১৬ মাস ধরে মঙ্গলের মাটির বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে সেই সম্পর্কে তথ্য পাঠাচ্ছে নাসার জেট প্রোপালশান গবেষণাগারে। নাসা সেই তথ্য আবার তাদের নিজস্ব এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে পাঠিয়েছিল বিশ্লেষণের জন্য। সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়ায় ‘আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন’-এর একটি সমাবেশে কিউরিওসিটির পাঠানো তথ্য নিয়ে বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞানীরা।
সেই আলোচনাচক্র আর জার্নালের লেখা থেকে জানা গিয়েছে, আজ থেকে প্রায় ৩৬০ কোটি বছর আগে রীতিমতো মিষ্টি জলে ভরে ছিল মঙ্গলের হ্রদ। এখন যে জায়গায় গেল ক্রেটার নামে একটা গভীর রুক্ষ খাদ রয়েছে, সেখানেই ছিল এই হ্রদ। কিউরিওসিটির পাঠানো সেই হ্রদের মাটির উপাদান সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং সালফার পাওয়া গিয়েছে। আগেই ওই খাদের মধ্যে কাদার খোঁজ মিলেছিল। মানে সেখানে যে জল ছিল তা আগেই জানা গিয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক জন গ্রটজিঙ্গার বলেন, “এটা অনেকটা পৃথিবীর প্রথম দিকের অবস্থার মতো। মঙ্গলের মাটিতে যে উপাদানগুলো পাওয়া গিয়েছে, তাতে খনিজ লবণ খাদ্য এমন ব্যাকটেরিয়া অর্থাৎ কেমোলিথোঅটোট্রফরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। অন্তত পৃথিবীতে তো থাকে। আমার মতে, পৃথিবী থেকে এ রকম কিছু ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গিয়ে মঙ্গলের ওই হ্রদের জলে রাখতে পারলে দিব্যি বেঁচে থাকত তারা!”
লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের গবেষক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সঞ্জীব গুপ্তর কথায়, “এই প্রথম মঙ্গলে প্রাণ থাকার এত জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেল। এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় খবর।” অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জিম বেল বলেন, “আমার তো সব থেকে আশ্চর্যের ঘটনা লাগছে ওই হ্রদের জল মিষ্টি ছিল। মানে আমরা রীতিমতো পান করতে পারতাম!” কিউরিওসিটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত জিম এর আগে নাসার পাঠানো আরও দু’টি মঙ্গলযান, স্পিরিট আর অপরচুনিটি প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, এর আগে যে সব তথ্য পাওয়া গিয়েছে সব ক্ষেত্রেই জানা গিয়েছিল মঙ্গলের জল বেশ আম্লিক ছিল। “কিন্তু এই মিষ্টি জলের তথ্য বেশ উল্লেখযোগ্য” মন্তব্য জিমের। নাসার গড্ডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের ভূরসায়নবিদ জেনিফার এইজেনব্রড বলেন, “যদি বেশ কিছু সময়ের জন্য মঙ্গলে এই হ্রদ টিকে থাকে, তা হলে তো লাল গ্রহে প্রাণ থাকার সম্ভাবনাও অনেকটাই বেড়ে যায়।”
কিন্তু এখন প্রশ্ন, কত দিন স্থায়ী ছিল এই হ্রদ? আর কী ভাবেই বা মিলিয়ে গেল সে? লাল গ্রহে কী আদৌ প্রাণ ছিল?
এখন এই প্রশ্নগুলোই পাক খাচ্ছে বিজ্ঞানীদের মনে। কিন্তু উত্তর খোঁজাটাও যে খুব একটা সোজা কাজ নয়, তা মানতে বাধ্য হচ্ছে নাসাও। কিউরিওসিটি প্রকল্পেই খরচ হয়ে গিয়েছে ভারতীয় মুদ্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকা। নাসা জানাচ্ছে, প্রাণ ছিল কি না তা চিহ্নিত করার মতো কোনও যন্ত্রপাতি দিয়ে পাঠানো হয়নি কিউরিওসিটিকে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, প্রাণ ছিল কি না জানতে মঙ্গলের মাটি আনতে হবে পৃথিবীতে। তার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর তিনটে মহাকাশযান পাঠাতে হবে। তাতে যা খরচ হবে তা কল্পনা করেও আঁতকে উঠছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। ২০১৮ আর ২০২০ সালে লাল গ্রহের মাটি ছোঁয়ার কথা দু’টো মঙ্গলযানের। আপাতত তাই সে দিকেই তাকিয়ে বিজ্ঞানীরা। |