|
|
|
|
স্মরণ ২... |
ভিজে চোখ বুজে শেষ রেকর্ডিং-এ গাইলেন মান্নাদা |
যখন তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটি নার্সিং হোমে জীবনের শেষ যুদ্ধে টালমাটাল। আশিতে পৌঁছে যেন যৌবনে ফিরে গিয়েছিলেন।
চলে যাওয়ার দু’মাস পূর্ণ হওয়ার দু’দিন আগে তাঁর প্রান্তবেলার দিনলিপি লিখলেন গীতিকার দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী। |
জানি জানি আবার দেখা হবে
চোখের জলে দিন গোনা তাই,
সেদিন আসবে কবে? |
এটুকু শুনেই মান্নাদা বললেন, “তুমি গানগুলো লিখে পাঠাও। আমি একবার হাতে নিয়ে দেখি।”
২০১২। ১৮ জানুয়ারিতে সুলোচনা বৌদি চলে যাওয়ার অল্প কয়েক দিন পরের কথা।
তখন ফোন করলেই বৌদির কথা উঠত। কেবল কান্নাকাটি করতেন। একদিন বললাম, “এখন আপনার মনের যা অবস্থা...বৌদিকে নিয়ে কতগুলো গান লেখার কথা ভাবছি... গাইবেন?” সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। তার পরেই ওই ফোন।
গান লেখা হল। সুর, ট্র্যাকের কাজ চলছিল। অ্যালবামের নামও ঠিক করে ফেললেন— ‘জানি জানি আবার দেখা হবে’। কিন্তু কাজটা আর করে যেতে পারলেন না।
অথচ শেষ চোদ্দো-পনেরোটা বছর কত কাজই না করে গিয়েছেন অক্লান্ত মান্নাদা। সারা পৃথিবী জুড়ে অনুষ্ঠান, প্রায় প্রত্যেক দিন নতুন নতুন গানের রেকর্ড করা, অন্য শিল্পীদের জন্য সুর। বাংলায় ওঁর মতো এত ব্যস্ত শিল্পী তখন একজনও ছিলেন কি না সন্দেহ। তা’ও ওই বয়সে।
আরও একটা কথা অবাক লাগে ভাবতে, তা হল গানের ক্ষেত্রে ওঁর ফ্লেক্সিবিলিটি। প্রায় আশির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মান্নাদা যে ভাবে নিজেকে ভেঙেছেন, গায়কীতে, ভাবনায়, সুরে ক’জন অমনটা পারবেন, কে জানে!
’৯৮ সালের একটা ঘটনা বলি। সুরকার মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শোনা। কিছুতেই ভক্তিগীতি গাইতে চাইতেন না মান্নাদা। বলতেন, “বুড়োদের মতো মা-মা বলে গাওয়া আমার পোষায় না।”
শেষে পুলকদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) আর মৃণালদা মিলে অনেক করে রাজি করান। ওঁরা বলেন, “মান্নাবাবু, আরে এখানে তো গর্ভধারিণী আর জগজ্জননী একাকার হয়ে গিয়েছেন। অসুবিধে কোথায়?” রাজি হলেন এ বার। আর তার পরই সেই বিখ্যাত গান
‘আমায় একটু জায়গা দাও
মায়ের মন্দিরে বসি’।
আশি পেরিয়ে মান্নাদা যেন যৌবনে ফিরে গিয়েছিলেন। প্রায় প্রতি বছর তিন-চার মাসের জন্য আমেরিকায় যেতেন। শীত কামড় বসানোর আগে ফিরে আসতেন। ঠান্ডা একেবারে সহ্য করতে পারতেন না। |
|
আমেরিকায় ওঁর লক্ষ্য থাকত দুটো। এক, অনুষ্ঠান। আর দুই, বড় মেয়ের বাড়িতে কয়েক দিন কাটানো। ওই সময়টায় প্রোগ্রামের জন্য কী যে ছোটাছুটি করতেন! ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নিউইয়র্ক, শিকাগো থেকে টেক্সাস। একের পর এক অনুষ্ঠান চলত তো চলতই।
এর মধ্যে ২০০০ সালে কিন্তু এক বড় ধরনের ওলটপালট হয়ে গেছে ওঁর জীবনে।
মুম্বইয়ে ‘আনন্দন’ ছিল ওঁর খুব সাধের বাড়ি। বার বার বলতে শুনতাম, “আমি আর সুলোচনা খুব যত্ন করে তৈরি করেছিলাম বাড়িটা। আড়ম্বর ছিল না। কিন্তু সুলোচনা যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, খুব যত্ন করে রাখত। ষাট বছরের সেই বাসের পাট চুকিয়ে বেঙ্গালুরু। ছোট মেয়ের কাছে। অত সহজ ছিল না নিশ্চয়ই। অনেকেই এ ঘটনার পর গান গাওয়া তো দূরের কথা, মনের দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু তিনি যে মান্না দে!
মান্নাদার জীবনে আরও একটা ঝোড়ো দিন ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৯। ওদিনই নিজেকে শেষ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্নাদার বহু দিনের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ।
এত বিখ্যাত সব গীতিকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, কিন্তু পুলকদার কথা উঠলেই কেমন যেন উদ্বেল হয়ে যেতেন মান্নাদা। ২০০০-এ অ্যাকোর্ড থেকে যে ক্যাসেট বেরোয় সেখানে পুলকদাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে গান করলেন ‘পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে চলে গেছে বন্ধু আমার’।
২০০০-এ এসে মান্নাদা যেন আরও ব্যস্ত মানুষ। ‘পাগল তোমার জন্য’ নামের একটা সিরিয়ালে গান করলেন তো বটেই, সঙ্গে অভিনয়ও। অ্যালবাম করা তো ছিলই।
২০০১ আর ২০০২। পর পর দুটো বছর অদ্ভুত দুটো কাজ করলেন। বাঙালির উৎসব নিয়ে অ্যালবাম ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। পরের বছর বাঙালির নস্টালজিয়াকে উসকে দিয়ে কফিহাউসের দ্বিতীয় পর্যায়। এই সময়টার পরই মান্নাদা’র সঙ্গে আমার আলাপ। ২০০৩ সালে। ওই বছরে ওঁর সঙ্গীত জীবনের ষাট বছর পূর্ণ হল। নেতাজি ইন্ডোরে অনুষ্ঠান। সস্ত্রীক কলকাতায় এসে উঠলেন ধর্মতলার একটি হোটেলে। মৃণালদা আমায় নিয়ে গেলেন মান্নাদা’র কাছে।
তখন এক মিউজিক কোম্পানির কর্তারা মান্নাদাকে খুব ধরেছেন, পুজোর অ্যালবামের জন্য। প্রথমে নিমরাজি ছিলেন। অনেক পীড়াপীড়ির পর বললেন, ‘বুঝলেন মৃণালবাবু, গিরিশ ঘোষ, স্বামীজি, অরবিন্দ ঘোষ এমন অনেক মনীষী আছেন, যাঁদের সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানে না। এঁদের নিয়ে কাজ করলে মন্দ হয় না। তবে মুশকিল কী জানেন, পড়াশুনো করতে হবে। তার পর গানের আকারে সেগুলো লিখতে হবে। কঠিন কাজ। এ সব পারতেন পুলকবাবু (বন্দ্যোপাধ্যায়)।” মৃণালদা চিন্তায় পড়ে গেলেন।
আমি শুধু ভাবছিলাম, কী অদ্ভুত আইডিয়া! কাউকে কিছু না বলে হোম-ওয়ার্ক শুরু করে দিলাম। বারোটা গানও লিখলাম। মৃণালদাকে দেখাতে উনি ভরসা দিলেন। তার পরেই প্রকাশিত হল ‘আমার প্রিয় মনীষী’। সেই প্রথম মান্না দে’র সঙ্গে আমার পথ চলা শুরু। রেকর্ডিং-এর সময় একদিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হার্টের সমস্যা। সবাই সেদিনের মতো রেকর্ডিং-এ যেতে বারণ করছেন। কিছুতেই শুনলেন না। স্টুডিয়ো, মিউজিশিয়ানদের একটা কাজের দিন নষ্ট হবে। সেটা ওঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। পার্ক স্ট্রিটের সেই স্টুডিয়োটা ছিল বেসমেন্টে। লিফট নেই। ওই ফ্লোরে ওয়াশরুমও ছিল না। অসুস্থ শরীর নিয়ে মান্নাদাকে বার বার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে-নামতে হল। কোনও বিরক্তি নেই। টানা কাজ করে গেলেন।
পরের বছর গানের কী বিষয় হবে? মৃণালদা একটা আইডিয়া দিলেন। ‘ভারততীর্থ’। ভারতের বিভিন্ন তীর্থভূমি নিয়ে গান। খুব পছন্দ হল ওঁর। গান লিখলাম। ২০০৪-এ অডিও রেকর্ডিং হওয়ার পর গানগুলো নিয়ে ২০০৫-এ ভিডিও অ্যালবামও করলেন।
এই সময়ের একটা ঘটনা। ফাইনাল এডিটিং। অরোরা স্টুডিয়োয়। তার ঠিক আগে মান্নাদা গান দেখে পরিচালক প্রদ্যোত ভট্টাচার্যকে বললেন, ‘বলবেন তো আগে, এত ভাল একটা কাজ করবেন, তা হলে শ্যুটিং-এর সময় আর একটু সেজেগুজে আসতাম।’
প্রদ্যোত থতমত। জিজ্ঞেস করল, ‘দাদা, কোনও ভুল হয়নি তো?’ মান্নাদা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘প্রচুর ভুল আছে। তবে আপনার নয়, আমার।’
একবারের টেকেই প্রায় সব ক’টা গানের লিপ মিলিয়ে ছিলেন মান্নাদা। নতুন গান, কত দিন আগে রেকর্ড করা। তা’ও। ওই সময় একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতেরও অ্যালবাম করেছিলেন মান্নাদা।
বেঙ্গালুরু থেকে প্রায়ই ফোন আসত। আমিও করতাম। একদিন বললেন, ‘অনেক তো ধর্মকর্ম হল, এবার একটু আধুনিক গান করা যাক।’ ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ঠিক কী ধরনের গান লিখব, বলবেন?’ বললেন, ‘কেন? দু’একটা ফিলজফিক্যাল, আর কয়েকটা রোম্যান্টিক।’ মনে রাখবেন, তখন কিন্তু মান্নাদা সাতাশি বছর পার করে গিয়েছেন।
একদিন বললাম, ‘কী ধরনের গান গাইতে আপনার ভাল লাগে?’ বললেন, ‘মিষ্টি, মিষ্টি। রোম্যান্টিক।’ বলেই ‘ঠিক ছবির মতো’ অ্যালবামে আমারই লেখা একটা গানের কথা আওড়ে গেলেন।
অ্যালবামের গানে সুর করার সময়টা মনে পড়ে। তখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায়। হঠাৎ একদিন ফোন। ‘মনের মধ্যে কত সুর কিলবিল করছে, এক্ষুনি গান পাঠান।’ পাঠালাম। একটা গান ছিল, ‘আকাশ দেখে মুখ সাগরের আয়নায়’। গানটায় সুর দিয়ে খুব ভাল লেগেছিল ওঁর। অনেককে জিজ্ঞেস করতেন, ‘বলো তো কী রাগ?’ কেউই বুঝতেন না। তাই দেখে বলতেন, “আমি নিজেও ঠিক জানি না। সারা জীবনে কত রাগ শিখেছি। কে যে কোথা দিয়ে ঢুকে পড়েছে।”
মনে আছে, গানটার সঞ্চারীর কথা আমাকে নতুন ভাবে লিখতে বলেছিলেন। আমি বেশ কয়েকটা সঞ্চারী লিখে পাঠালাম। তত দিনে বেঙ্গালুরু ফিরে এসেছেন। রেকর্ডিং-এর সময় দেখলাম, পুরোনোটাই রেখে দিয়েছেন। বললেন, ‘আর পাল্টালাম না। পাছে আপনি বলেন, মান্না দে সুর করতে পারেননি, তাই কথা পাল্টাতে বলেছেন।’ পরিষ্কার বুঝলাম, নতুন সঞ্চারী পছন্দ হয়নি। কিন্তু অপছন্দের কথাও এমন করে বলা যায়!
বার বার দেখেছি গীতিকারদের অসম্ভব সম্মান করতেন উনি। আমাকে যে কত বার বলেছেন, ‘কী করে যে আপনারা গান লেখেন, অবাক হয়ে যাই ভাবলে!’ কথা বলার ধরনেই বুঝতাম, শুধু বলার জন্য বলা নয়। একেবারে মন থেকে বলছেন।
আরেক বারের কথা মনে পড়ছে।
‘হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা
বাংলা থেকে সুদূর আমেরিকা’
গানটার কাজ চলছে। কিছুতেই গায়কি পছন্দ হচ্ছে না। হঠাৎ আমায় বললেন, ‘সুলু (বৌদি) কোথায়?’ আমি গিয়ে বৌদিকে ডেকে আনলাম। ওঁকে সামনে বসিয়ে রেখে মান্নাদা গাইতে শুরু করলেন। কোথা থেকে যেন অদ্ভুত একটা দমক এসে জুড়ল ওঁর গলায়। কী দরদ, কী কোমল, অসম্ভব মাদকতা! এতক্ষণে মনঃপূত হল ওঁর নিজেরও।
২০০৯। নিউইয়র্ক থেকে বাংলাদেশী গায়িকা আইরিন ঝুমুর কলকাতায় আসবেন গান রেকর্ড করতে। তাঁর দশটি গান লেখার দায়িত্ব দিলেন আমায়। পাঁচটি মৃণালদার সুর। বাকি পাঁচটি মান্নাদার নিজের।
এ দিকে রেকর্ডিং-এর আগের দিন সকালেও ঝুমুরের দেখা নেই। মান্নাদা বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতা উড়ে এসেছেন ঝুমুরের রেকর্ডিং করাতে। মিউজিশিয়ান, স্টুডিয়ো, সব বুকড। হাজার চেষ্টা করেও ঝুমুরের কোনও খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। খুব চিন্তায় পড়লেন মান্নাদা। বললেন, ‘আরে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট ক্যানসেল করতে হলে তো অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে যাবে ওদের। সেরকম হলে ভাবুন অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াবেন কি না।’
শেষে বিকেলবেলা পৌঁছলেন ঝুমুর। উঠলেন স্টেডিয়ামের কাছে একটি হোটেলে। খবর পেয়ে মান্নাদা অস্থির হয়ে উঠলেন। আমায় বললেন, ‘মেয়েটা খুব ঝক্কি করে এসেছে। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত। আপনি হোটেলে চলে আসুন।’ বলে নিজেও হারমোনিয়াম নিয়ে চলে গেলেন সেখানে।
এর পর যা দেখলাম, সে আমার সারা জীবনের সঞ্চয়। মা যেমন সন্তানকে যত্ন করে খাইয়ে দেন, ঠিক তেমন যত্ন করে ঝুমুরকে গান তুলিয়ে দিলেন মান্নাদা।
‘তোমার কথা লিখতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করে
যদি অন্তবিহীন আকাশ হত আমার লেখার খাতা
তোমার কথা লিখে যেতাম
কয়েকটা যুগ ধরে।’
আমি কেমন বিহ্বল হয়ে গেলাম!
মান্নাদা’র শেষ রেকর্ডিং ২০১০। নিউইয়র্কের বাবুল রহমান মান্নাদার খুব ঘনিষ্ঠ। তাঁর অনুরোধ, বাংলাদেশের জন্য একটা গানের অ্যালবাম করে দিতে হবে। মান্নাদা শেষ অবধি রাজি হলেন। তখনই তলব আমাকে আর মিউজিক অ্যারেঞ্জার শান্তনু বসুকে। বললেন, “আমিই গানগুলো সুর করেছি। ওদের একটাই অনুরোধ, বাংলাদেশের কবিরা গানগুলো লিখবে। বলছে, ওদেরও তো একটা ইনভলভমেন্ট থাকা দরকার।”
উত্তরে বললাম, “দাদা, ঠিকই তো বলেছে, তাই তো হওয়া উচিত।” এর পর মান্নাদা যা বললেন, তা শুনে ভেতর থেকে কেমন যেন কান্না ডুকরে উঠল, “না না তা হয় না। এটা আপনার ওপর অবিচার করা হয়ে যাবে। আমি ওদের বলেছি, অর্ধেক গান আপনি লিখবেন। শুনুন, আমার কাছে আপনার গান তো ছিল। আমার সুর করাও হয়ে গেছে। শুনুন তো কেমন সুরগুলো হল।”
গানের মিউজিক ট্র্যাক হয়ে গেল। ডাবিংটা কিছুতেই হচ্ছিল না। এত ব্যস্ত ছিলেন সে-সময়। ক্যালিফোর্নিয়ায় বসে চেষ্টা করেছিলেন। টেকনিকাল কিছু অসুবিধের জন্য ট্র্যাক মিলছিল না।
তার কিছু দিন বাদে কলকাতায় এলেন। ২০১০ সাল। বৌদি ভয়ংকর অসুস্থ। নার্সিংহোমে ভর্তি হলেন। মান্নাদা মনের দিক থেকে একেবারে বিপর্যস্ত। তার মাঝেই একদিন ওঁর ফোন পেয়ে চমকে গেলাম।
বললেন, “কাল লেকটাউনের স্টুডিয়োটায় চলে আসুন। ওদের গানগুলো গেয়ে দিই। সুলুর অবস্থা একদম ভাল না। ওকে বেঙ্গালুরুতে নিয়ে যাওয়ার পরে আর মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি আসতে পারব না।” কমিটমেন্ট! একেই বলে কমিটমেন্ট! মনটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝবে না। দু’চোখ বুজে শেষ রেকডির্ং-এ গাইলেন মান্না দে, যখন তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় মানুষটি নার্সিংহোমে জীবনের শেষ যুদ্ধে টালমাটাল। মান্নাদা গাইলেন,
‘কী চোখে তোমায় দেখি
মনই শুধু জানে
সে-কথা বলেছি কত গানে গানে....।”
শেষ অ্যালবাম। কিন্তু তখনও তো বুঝিনি এটাই শেষ! সুলুবৌদির জন্য তৈরি গানগুলো করতে কী যে আগ্রহী ছিলেন! কোনও অ্যালবামের জন্য ওঁকে এত অধীর হতে দেখিনি। প্রায়ই ফোনে কথা হত। তার বেশির ভাগই অ্যালবামটা নিয়ে। আরও কী করে ভাল করা যায়, আরও।
কথা বলতে বলতে গলা বুজে যেত। কখনও ডুকরে উঠতেন। তখন এত অসহায় লাগত! ফোনের এ-প্রান্তে দাঁড়িয়ে ওদিকে ভেঙেচুরে খানখান হয়ে যাওয়া মানুষটার ছবিটা ধরতে তো অসুবিধে হত না। ওঁর বুক ভাঙা কান্না শুনতে শুনতে শুধু অভিসম্পাত দিয়ে যেতাম ঈশ্বরকে!
এখনও চোখ বুজলে মান্নাদার একটা ছবি বারবার দেখি.... মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে মান্নাদা গাইছেন ...
“তোমার জন্য না-মেলা হিসাব সহসা মিলে যায়
তোমার জন্য বিবর্ণ ফুল রং আজও ফিরে পায়
তোমার জন্য মেঘ সরিয়ে মুঠো মুঠো আলো আসে
তোমার জন্য ফেরারি সুখ ধরা দিতে ভালবাসে...
এত স্পর্শকাতর, রোম্যান্টিক, এত মরমি মানুষটা শেষ জীবনে এতটা অবিচারের শিকার হবেন, দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করিনি। |
|
|
|
|
|