শনিবারের নিবন্ধ
চায়ের ঠেক
সিগারেট-সুরা-সঙ্গীত-প্রেম-মিছিল আর মৃত্যুর কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই শহর কলকাতায়। এবং অবশ্যই চায়ের। ২৪x৭চা-সময়! ক্রিকেট থেকে কূটনীতি, রকেট সায়েন্স থেকে বাজেট কলকাতা কত কিছু জানে!
কলকাতা মানে আম বাঙালি। সঙ্গে অবশ্যই প্রিয়তম পানীয় চা। এবং তা অবশ্যই হতে হবে কোনও ঠেক। চায়ের দোকান।
চেনা চেনা চায়ের গ্লাসে নার্গিস-পিলিন-হেলেন না-হলেও চড়া গলায় কিঞ্চিৎ ঝড় উঠবেই। চায়ের ঠেক-ই ঠিকঠাক জানাবে, ব্যাটে বিরাট কোহলির কোথায় ভুল হচ্ছে, সুইং-এ মহম্মদ শামির, অভিনয়ে অমিতাভ-র, অর্থনীতিতে অমর্ত্য-র!
আর চায়ের দোকানের মালিক মানেই পাক্কা এক-একটা নাটকের চরিত্র। ওঁরা কমবেশি তিন গোত্রের।
একদল আছেন বয়েস নির্বিশেষে, সাক্ষাৎ সক্রেটিস। মহাজ্ঞানী এবং কম কথার মানুষ। শেষ মন্তব্যটি তিনিই করবেন এক অবিশ্বাস্য উচ্চতা থেকে। বিষয়টা বনলতা থেকে বোমারু বিমান অথবা বিদেশ নীতি হলেও!
আরেক দল সানাইবাদকের শাগরেদ যেমন। খদ্দের লক্ষ্মী যা বলেন, তিনি সেই সুরে বাজেন।
অন্য আরেক দল অত কথকতায় নেই। দেখলে মনে হয়, ল্যাবরেটরির ঝানু গবেষক। দুধ-চিনি-জলের অনুপাতটাই তাঁদের ধ্যান, জ্ঞান, জীবনের চৌহদ্দি।
সিঁথি থেকে শিবপুর। বেলেঘাটা থেকে বারুইপুর। পাটুলি থেকে পোস্তা। বৃহত্তর কলকাতায় অন্তত বারোশো বাইশটা বাজার বসে। শুধু এ ক’টা বাজার ধরলেও মাথা পিছু অন্তত তিনটে চেনা চায়ের দোকান। এ ছাড়া স্টেশন-বাস স্ট্যান্ড-হাসপাতাল-মল-লেক-গলি-তস্য গলি সর্বত্র চায়ের ঠেক। পাশাপাশি জুড়লে দিল্লি ইস্তক চলে যায়।
রাবণের চিতার মতো উনুনে আগুন, জ্বলছে তো জ্বলছেই। ইদানীং শুধু উনুনে কেলে কুচ্ছিত কেটলিটা কিছুটা অমিল, জায়গা নিয়েছে অ্যালুমিনিয়ামের বড় পাত্র। সর-ভাসা দুধ, বড় প্যানে গুঁড়ো চা-চিনি-দুধ পড়ছে। নড়বড়ে বেঞ্চি-চেয়ার-টেবিল। একখানা খবরের কাগজ। এক একটা পাতা এক এক জনের হাতে। সকাল থেকে সন্ধে, নেতিয়ে পড়েছে খবরের কাগজের পাতা। তবু নিস্তার নেই।
চায়ের দোকান এবং খবরের কাগজ মধ্যবিত্তের বিশ্ববিদ্যালয়! আদতে সব বিদ্যার বুঝি লয় হয় সেখানে। কামদুনি-কাটোয়া-গেদে-গাইঘাটার ধর্ষণ-কাণ্ডই শুধু নয়, কাকদ্বীপ থেকে কালনার অনেক সংলাপ-সাহিত্য-হালহকিকতের খবরও চায়ের দোকানে কান পাতলে এখনও শোনা যায়।
শক্তি-সুনীল-শরৎ-সন্দীপন-কমল কুমারের কল্যাণে ওয়েলিংটনের খালাসিটোলা বা এস এন ব্যানার্জি রোডের বারদুয়ারির বাংলা মদের ঠেক নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে, কলকাতার বহু চায়ের দোকান, কিছু আলোচনার জোরালো দাবিদার হলেও, লক্ষ্মণের বৌ-ই থেকে গিয়েছে। উপেক্ষিতা ঊর্মিলা! অথচ চরিত্রে দম নেই, কে বলবে!
লেক মার্কেটে আশি বছরের পুরোনো রাধুবাবুর চায়ের দোকান যেমন! লিকার-ফ্লেভার চা তো বটেই, চাইলে কবিরাজি, ফিশ ফ্রাই, কাটলেট, মটন স্টু বা কোর্মাও মেলে। এক সময় কিমা কারি, পুডিং পাওয়া যেত। ভোর ছ’টা থেকে দশটা, বিকেল তিনটে থেকে সাড়ে আটটা, আজও শুধু চায়ের বিক্রি এখানে কম সে কম এক হাজার কাপ ছাড়ায়।
শোনা যায়, রাধুবাবু, রাধাকিশোর দত্ত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। আদি বাড়ি পুরুলিয়ার বলরামপুর। সেখান থেকে বাঁকুড়া হয়ে কলকাতা। পূর্বপুরুষের গালার ব্যবসা। উনি হয়ে গেলেন চায়ের দোকানি।
রাধুবাবুর দোকানের পাশের বাড়িতে থাকতেন অভিনেতা দীপঙ্কর দে। উল্টো পারেই সঙ্গীতকার সুধীরলাল চক্রবর্তী। এ দোকানের চা না খেলে ওঁদের দিন মূর্ছা যেত।
হঠাৎ হঠাৎ হাজির হতেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বাজার করতে এসে এই চা-দোকানেই আটকা পড়তেন অভিনেতা সুখেন দাস কিংবা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়। নিয়ম করে আসতেন পি সি সরকার। কীসের টানে? অভ্যাস? নাকি অতীত-প্রিয়তা? গোদা বাংলায় নস্টালজিয়া?
“চা-এর সঙ্গে টা-টাই বেশি টানত। পরিবেশটাও বেশ শান্ত-শান্ত! অল্প দূরেই লেক, টিমটিমে ল্যাম্পপোস্ট, তার নীচে শুয়ে থাকা ফুটপাথ। দাঁড়িয়ে, বসে কত আড্ডা দিয়েছি। যখন সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনলাম, তার বনেটটা হয়ে যেত আমাদের টেবিল। আশুতোষ কলেজে পড়েছি। আশপাশের কলেজের বন্ধুরা তো আসতই, শিবপুর থেকেও অনেকে চলে আসত,” বলছিলেন জাদুসম্রাট।
ভাই বিজনবিহারীর হাত ঘুরে এখন রাধুবাবুর দোকানের দেখভালে তাঁর ভাইপোরা। সত্যসুন্দর আর সোমনাথ। শোনা গেল, এ দোকানে এখনও নিয়মিতদের দলে আছেন অভিনেতা-গায়কদের অনেকেই। অর্জুন চক্রবর্তী, লোপামুদ্রা, শ্রীকান্ত আচার্য, ইন্দ্রনীল সেন, মনোময় ভট্টাচার্য...।
সাদার্ন অ্যাভিন্যুর সর্বমঙ্গলা মন্দিরের একটু পরেই দু’টো চায়ের দোকান। গুঁড়ো নয়, পাতা চায়ের লিকার।
কাক-ডাকা-কুয়াশা-মাখা সকালে রবীন্দ্র সরোবর লেক-এ চক্কর মারার পর কত মানুষ যে দোকান দু’টোতে জমা হন!
ওই চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে ক’দশক আগে অনিমেষ প্রেমে পড়েন মনির্ং কলেজের শাশ্বতীর। “সকালে বাজারের থলি নিয়ে বেরিয়ে এক কাপ চা না হলে চলত না। তখন সদ্য যৌবন। যেতে আসতে ওকে দেখে চায়ের টানটা যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল, তার পর অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে বিয়ে,” পুরনো কথার মৌতাত এখনও অনিমেষের গলায়।
প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটের মুখেই আই এফ এ অফিসের আগে গোষ্ঠ-র চায়ের দোকান। একটু পোড়া পোড়া দুধ-চায়ের টান সেখানে আজও অম্লান। আনন্দবাজারের উল্টো দিকে গোপাল-ভোলার চায়ের ঠেক। অদূরেই মহাদেবের দোকান। কিংবা ম্যাঙ্গো লেন-এর মুখেই ট্রাম কোম্পানির অফিসের উল্টো দিকে এক ফালি চায়ের দোকান। অফিস-বাবুদের পরিচিত ঠেক। এখানে পাতা চায়ের ব্যবহার বহু দিনের। হাল্কা দার্জিলিং-গন্ধী।
অফিস পাড়া চা-দুনিয়ায় এক অন্য পৃথিবী। স্বাদেগন্ধে সবেতেই সাবেক কলকাতা থেকে আলাদা। চায়ের চুমুকে, আড্ডার ভাষায়, দমকে ফারাক আসমান-জমিন। এজেন্ডা? প্রেম-পিরিতির বদলে পথচলতি গলদঘর্ম কেজো মানুষের রুখাশুখা শাপশাপান্তে ঠাসা। টার্গেট কখনও অফিসকাছারি তো কখনও নেতা-আমলা। আজ আমেরিকা, তো কাল চিন।
সত্তর-আশি-নব্বই দশকের চায়ের দোকান বলতে খুব জনপ্রিয় ছিল বৌদি কিংবা ঠাকুরের ঠেক। উত্তর কলকাতার বিবেকানন্দ রোড, হাতিবাগান কি বিডন স্ট্রিট, বিধান সরণি জুড়ে সার সার অমন দোকান এক সময় ছিল কলেজ পড়ুয়াদের সদরদফতর। প্রেমপত্র-ক্লাস নোটস্ থেকে তরাইয়ের দলিল, গাঁজার পুরিয়া। দোকানিকে ফাঁকি দিয়ে চালাচালিতে বাদ যেত না কোনও কিছুই।
হেদুয়ার আশেপাশের চত্বরে কলেজজীবন, অথচ আখওয়ার্ট স্কোয়্যারের মুখে বৌদির ঠেকে ব্যাটারির খোলে বসে কামু-কাফকা-মার্কস-এঙ্গেলস আওড়ায়নি, এমন শান্তশিষ্ট ‘আলুভাতে’ বলতে গেলে তখন সোনার পাথরবাটি। ঠেকের বড় আদুরে ছিল দোকানি লীলা বৌদির অসুস্থ গোলগাল খর্বকায় মেয়ে লক্ষ্মী। দেড় হাত লক্ষ্মীর বয়স বোঝা ভার। উনুন তাতে বসে বসেই দিন কাটাত তার। বছর কুড়ি আগে জনডিসে ভুগে হঠাৎই চলে গেল সে। তখন কী হা-হুতাশ বৌদির অনাত্মীয় খদ্দেরদের। চোখের জল রাখা দায়।
বৌদির দোকানে আশির দশকের গোড়ায় নিয়মিত আসতেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের অলকেন্দু। অলকেন্দু নাগ। সাদা ফতুয়া শার্ট। মালকোঁচা মারা সাদা ধুতি। গায়ে উড়নি। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা। খোঁচা দাড়ি। চেহারায় যাই হোক, স্বভাবে টেনিদা কি ঘনাদা। বলে বলে রাজা-উজিড় মারতেন। তখনই বয়েস সত্তরের কোঠায়। গল্পের অফুরন্ত স্টক। তাতে গাঁধীজির ডান্ডি অভিযানে অলকেন্দুর অংশ নেওয়া থেকে ’৪৬-এর দাঙ্গা হয়ে ইডেন গার্ডেনস-এ আগুন লাগার প্রত্যক্ষ বর্ণনা, কী ছিল না। ওঁর দাবি ছিল, সেদিন যদি অলকেন্দু না থাকতেন আগুন জ্বলা ইডেন থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে যাওয়া ওয়েসলে হলের প্রাণসংশয় হতে পারত!
বৌদি-ঠাকুরের লিস্টের পরের নাম ‘অমুক-তমুক’ দাদার চায়ের দোকান। মানিকতলার এমনই এক দোকানে সন্ধেবেলা এক ভাঁড় চায়ে গলা ভিজিয়ে ‘কিশোরকুমার’ ধরত দীনেন্দ্র স্ট্রিটের কেলো। ওর স্বপ্ন ছিল সোনালি শিবিরের গোলকিপার হবে।
বিকেলবেলা বাগমারি মাঠে গা ঘামিয়ে ভিজে জার্সি কাঁধে ফেলে তারস্বরে শিস দিয়ে কেলো গাইত, ‘মেরে নয়না শাওন ভাদো...’। পুরো হ্যামলিন! পাড়া ঝেঁটিয়ে কেলোর পায়ের কাছে লেজ নাড়ত এক পাল নেড়ি। ওদের লেড়ো খাওয়াত কেলো।
দিন কয়েক আগে সে-দোকানের খোঁজে গিয়ে দেখা গেল লেড়ো হাওয়া। বদলে বড়জোর টোস্ট বিস্কুট। তা’ও নামমাত্র। বাকিটা ‘ক্রিস্পি’ চিপস, ‘ক্রাঞ্চি’ স্ন্যাকস্-এ ভরা। কেলোই বা কোথায়, কেউ জানে না। আর তার আসরে চেয়ার বাজানো সাদা পাজামা, খেটো লুঙ্গির ভিড়টাও পুরো ভোক্কাট্টা। কালু-ভুলুরা কি ধরা পড়ল কর্পোরেশনের খাঁচা গাড়িতে?
শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ে দু’হাত দূরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কেদারদা আর মধুদার দোকান। লোকে বলে, প্রথমটা যদি হয় হাউস অব লর্ডস, দ্বিতীয়টা নিশ্চয় করে হাউস অব কমনস। এদের বয়স? হিসেব করুন ১৯১৯ সাল থেকে।
লর্ডসের টেবিলে একসময় ভিড় জমাতেন কলকাতার ডাকাবুকো সাংবাদিক, ডকু ফিচারের ডিরেক্টর কি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, বড় ছোট কলমবীর। কমনসের ভিড় বরাবরই গড়পড়তা, পাঁচমিশালি। এলআইসি-র এজেন্ট, হরিপদ কেরানি কি পাড়ার নবকুমার মায় কেষ্টুবিষ্টুর দল।
ভুপেন বসু অ্যাভিনিউ দিয়ে রাজবল্লভ পাড়ায় পড়লেই বিশুর চা। পাশাপাশি দুটো বেঞ্চ পাতা। সামনেই দোকানি দাঁড়িয়ে চা বানান, কী এগ-টোস্ট বা ঘুঘনি। বিশুর দোকান অনেকের কাছেই ‘হাওড়া স্টেশনের বড় ঘড়ি’র মতো। ‘অ্যাপো’ করার ঠেক। সোমবারের সকাল দশটাতেও সেখানে মিনি জমায়েত। ঘড়ঘড়ে কাশির বৃদ্ধ থেকে ওষুধ কোম্পানির ‘বেচুবাবু’।
এ দোকানে ছত্রিশ বছর ধরে নিয়মিত কমার্শিয়াল আর্টিস্ট সুনীল মিত্র। বাড়ি ঠিক উল্টো পারে। সেদিন তিনি কারও অপেক্ষায়। চায়ের পেয়ালা হাতে বলছিলেন, “এক সময় আজিজুল হক, কাকাদের সঙ্গে জেল খেটেছি। ’৭৬-এ বেরিয়ে থিয়েটার করতাম। বিভাস চক্রবর্তী, শ্যামল ঘোষ..। এখনও করি। তবে ছোট দলে। অনেক অদলবদল তো দেখলাম, কিন্তু এ নেশা বদলাবার নয়। দু’বেলা না এলে ভাল লাগে না। কী যে মোহ, কেন যে, বুঝি না। আমি তো বিশুর বাবা অটলদার সময় থেকে আসি।”
এ বার সিঁথিতে চলুন। কালীচরণ ঘোষ রোডে বুদোর চায়ের দোকান। সকাল ছ’টা থেকে রাত সাড়ে দশটা। কত মানুষের ভিড়। অক্লান্ত বুদো। পাঁচ ‘হেল্পার’ও। বেশির ভাগই চেনা মুখ। সাংবাদিক-ব্যাঙ্ক অফিসার-নেতা-পুরপিতা-বেকার যুবক— সবার আনাগোনা বুদোর ঠেক-এ।
পাড়ার লোকে বলে, সিঁথি চেনা যায় কী দিয়ে? না বুদোর দোকান দিয়ে। সকাল ছ’টা থেকে বেলা বারোটা দশ কেজি ঘন গরুর দুধ লাগে বুদ্ধদেব, মানে বুদোর!
বছর শেষে বুদো বৌ-মেয়ে নিয়ে কাশ্মীর-কন্যাকুমারী বেড়াতে যায়। লোকনাথ ব্রহ্মচারীর জন্মদিনে তার এলাহি আয়োজন। বড় বাজেট। সব ওই চায়ের দোকানের কল্যাণে।
দেশপ্রিয় পার্কের কোণের বহু দিনের চেনা চায়ের দোকান। সেই ঠেক-এ নিত্য অনেক চেনা মুখের ভিড়। অভিনেতা থেকে আইনজীবী! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এক চা, এক স্বাদ। কিন্তু আড্ডার অধ্যায় একটু ভেঙে গুছিয়ে নিলে এক-এক দিনে এক-একটা স্বাদের উপন্যাস জন্মে যায়।
কুঁদঘাটে রাজভোগ আর সাদা কাজু দইয়ের জন্য বিখ্যাত মিষ্টির দোকানের ঠিক উল্টো পারে দু’টো চায়ের ঠেক। সাতসকাল থেকে রাত দশটা, কত প্রৌঢ়-যুবকের ভিড়। এখনও তিন টাকায় গেলাস ভর্তি চা! চিতা বহ্নিমান! দুটো দোকানের আগুন নেভে না। সত্যনারায়ণের ছোট্ট শিঙ্গাড়া আর ওই লাল চা। কলকাতা পুলিশের ওয়্যারলেস সদর দফতরের গায়ে, পুরসভার পার্কের উল্টো দিকে চারটে চা-ঘুগনির দোকান। মনে হবে রোজই বুঝি কোনও রাজনৈতিক দলের জমায়েত। বেঁটে-লম্বা, রোগা-মোটা, কালো-ফর্সা, সফল-অসফল-- মানুষের মেলা। বড় গ্লাসে ৭০ শতাংশ ভর্তি চা তিন টাকা! ওই চার জনের এক জন প্রভাস দাশ। স্ত্রী পূর্ণিমা। সুখী সংসার। ছেলে প্রতিষ্ঠিত। প্রভাসের দোকানেই ‘মাতাল’ কবি স্বপন দাসকে এক শরৎ-সন্ধ্যায় বলতে শুনেছিলাম: ‘মান্না দে-র বন্দি-জীবন চাই না। আমি শক্তি হতে চাই।’
বেহালার মহোৎসব তলায় কেঠোর চায়ের দোকান। সকাল-বিকেল-সন্ধে-রাত বেশ ভিড়। বিকেলের পর বাড়তি আকর্ষণ চায়ের সঙ্গে ঘুগনি-মুড়ি। দশ টাকা! অথচ এরা সবাই সাহিত্য-সংবাদমাধ্যমে-উপেক্ষিত। ব্যতিক্রম অবশ্যই দক্ষিণাপণে ডলির চা বা ফ্লুরিজ বা শর্মা টি স্টল বা ডেকার্স লেন-এ চিত্তর দোকান। অবশ্য এদের সেই অর্থে নিখাদ চায়ের দোকান বলা যায় কি না তা নিয়ে তেমন ধন্দ বা বিতর্ক না-থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
চায়ের ঠেকে আরেক কিসিম চরিত্র পাবেন শ্মশান চত্বরে। নিমতলার ইলেকট্রিক চুল্লির উলটো পারে মিহিরের দোকান। তেমন দিন হলে নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকে না। চব্বিশ ঘণ্টা এমনিতেই খোলা। দিনে কম করে ছ-সাতশো ভাঁড় চা। দু’ভাই মিলে শিফট খাটেন দোকানে। আশপাশের খান চোদ্দো দোকান। সারাদিনই কারও চুলা নেবে না।
রাতদিন ‘বলহরি হরিবোল’, ভাল লাগে? রোগাটে মিহির কাজের ফাঁকে মুখে হাসি টেনে জবাব দেন, “সয়ে গেছে দাদা। তাছাড়া কী’বা করি। নইলে যে মারা পড়ব।” ঠিক এই কথার প্রতিধ্বনি সিরিটি শ্মশানের শ্যামল কী কেওড়াতলার বাবুর মুখে। শ্মশানপাড়ায় যাঁরাই কাটান, তাঁরাই কি একটুআধটু দার্শনিক?
হাসপাতালের লাগোয়া চা-ঠেকের মেজাজটা আবার এক্কেবারে আলাদা। মুখগুলোয় কখনও আশা, কখনও আশঙ্কা ল্যাপা। পায়ের গতি কখনও ত্রস্ত, কখনও অ্যালানো। কথাতেও মেঘ-রোদের আসা-যাওয়া পাহাড়কে হার মানায়। তবু তার মধ্যে অদ্ভুত এক ছবি পাবেন পিজি-র কাছে।
পিজি হাসপাতালের অল্প দূরে গুরুদ্বারের পাশে পাঞ্জাবি চায়ের দোকানে ঘন দুধে এলাচ-লবঙ্গ-তেজপাতা দেওয়া চা না-খেয়ে বাড়ি যান না এমন মানুষ কম নেই। অনেকে বেশ দূর থেকেও আসেন।
রাত যত বাড়ে, তত বাড়ে ভিড়। মানুষের আর বড় বড় বিলাস-গাড়ির। মহার্ঘ মোটরবাইকেরও। মাঝে মাঝেই বাধে খুচরো অশান্তি। পুলিশ আসে। ভিড় কিন্তু কমে না। মাঝারি, বড় আর বেশ বড় ভাঁড়ে চা। দশ-বিশ-তিরিশ টাকার ভাঁড়।
কাট টু...সল্টলেক। সাদার্ন অ্যাভিনিউ। পার্ক স্ট্রিট। আনোয়ার শাহ্ রোড।
রাস্তাটা যে নামেই হোক, কিচ্ছু এসে যায় না। শুধু এ বার আর বেঞ্চির সারি নয়। ক্যাতরানো টোল খাওয়া ভাঁড়, কি গনগনে উনুন তাত নয়। মোটা কাচের দরজা ঠেলে ঠান্ডা ঘরে সেঁধিয়ে যাওয়া। ঘন ফ্যানাওয়ালা কাপুচিনো। ক্রিমে মাখা ডোনাট। চকোলেট মুজ, ব্রাউনি। এগ র্যাপ। শেক। হাওয়ায় ভাসছে শব্দব্রহ্ম। এনরিকে, ব্ল্যাক সাবাথ, জাস্টিন টিম্বারলেক। ম্যাট ফিনিশ দেওয়ালে ম্যুরাল কী পেন্টিং। সোফা, চেয়ার, টেবিল। আশেপাশের মুখগুলোও ঝকঝকে-সাফাসুফো। চায়েরই ঠেক। এবং কলকাতায়।
রাজারহাটে এমনই একটি ক্যাফেতে হ্যাজেলনাট ফ্লেভারের দার্জিলিং টি নিয়ে বসেছিলেন সদ্য তিরিশ পেরোনো কাপল্ সুপ্তি আর অংশু সেন। সুপ্তি বলছিলেন, “আমরা প্রায়ই চলে আসি। এটা বলতে পারেন এক্সটেনডেড ফর্ম অব কফি হাউস। বরকে নিয়ে তো আসিই। বন্ধুদের সঙ্গেও। অংশু এখানে ক্লায়েন্টের সঙ্গে বিজনেস ডিল-ও করে। যেতে আসতে প্রেমের কত উত্থান-পতন দেখি। মানভঞ্জন পালা শুনি। গিটার-টিটার নিয়ে লোকজন গান গায়। জাস্ট লাভ ইট।”
শুধু কাচের দেওয়ালের স্বচ্ছ বেড়া। তার ঠিক ওপারে ধীর লয়ে যেখানে বয়ে যায় সাবেককালের কলকাতা... এ পারে দাঁড়িয়ে ও ধারে তাকালে ঝাঁ করে মনে হতেই পারে...ঠিক কতটা দূরে সে-দেশ...? গ্রহান্তরে কি?

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
অলংকরণ: শেখর রায়।
সহ প্রতিবেদক: দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.