বাহির পানে: দক্ষিণের টান
নীলিমায় নীল কেপটাউন
পরে আকাশ ঝকঝকে নীল। মনে হয় যেন হাত দিয়েই ছোঁয়া যাবে। নীচে আরও নীল অতলান্তিক মহাসাগর। এতটাই নীচে যে তার জল ছুঁতে মনে হয় নামতে হবে পাতালে।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি দক্ষিণ আফ্রিকার হেরিটেজ শহর কেপটাউনের সব থেকে উঁচু জায়গা টেবল মাউন্টেনের উপরে। নীচে যে অতলান্তিক মহাসাগর দেখা যাচ্ছে তার থেকে ১০৮৬ মিটার উচ্চতায়। উচ্চ গতি সম্পন্ন কেবল কার মাত্র ১০ মিনিটে আমাদের ওই উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
ওঠার পথে কেবল কার ঘুরতে ঘুরতে উপরে উঠেছে। তাই চোখ ধাক্কা খেয়েছে কখনও পাথরের দেওয়ালে, কখনও বা নীচের গাঢ় নীল সমুদ্রে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেই দৃষ্টি গিয়ে ঠেকেছে আরও নীল আকাশে। তখনই বোঝা গিয়েছিল আমরা পৌঁছে গিয়েছি পাহাড়ের একেবারে চূড়ায়। তখনই খুলে গেল কেবল কারের দরজা। আমাদের সামনে তখন এক পাথুরে প্রান্তর। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো ক্যাকটাস জাতীয় গাছ। তাতে রং-বেরঙের ফুল ফুটে রয়েছে। তবে সবার দৃষ্টিই একেবারে নীচে। যেখান থেকে কেপটাউন শহরটাকে দেশলাই বাক্সের মতো মনে হচ্ছে। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ মিলিয়ে পুরো শহরটাকেই জরিপ করে নেওয়া যায়।
উপর থেকে সমুদ্রের মাঝখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটি দ্বীপ। নাম রবেন আইল্যান্ড। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষের কাছেই নয়, ইতিহাসেও উল্লেখযোগ্য ওই দ্বীপ। সেখানেই দীর্ঘ ১৮ বছর বন্দি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার জাতির জনক নেলসন ম্যান্ডেলা। আর এক দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে কেপ পয়েন্টের কাছে লাইট হাউসটিকে। আমরা গত চার দিন ধরে কেপটাউনের যে এলাকাগুলি ঘুরে দেখেছি আমাদের গাইড আবদুল লতিফ সেই এলাকাগুলিকেও দেখানোর চেষ্টা করছিলেন পাহাড়চূড়া থেকে। কোনটা হাউট বে, কোথায় আমাদের হোটেল, কোথায় ওয়াইনের কারখানা তা ঠাহর করতে পারিনি আমরা।
পাহাড়ের এত উপরে উঠব তাই আমাদের জ্যাকেট কিংবা ফুলহাতা সোয়েটার নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। আমরা গলা পর্যন্ত চেন টেনে প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু পাহাড়ের উপরে পৌঁছে দেখলাম রীতিমতো ঘাম হচ্ছে। কুয়াশার চিহ্নমাত্র নেই। আমাদের গাইডের দিকে কটমট করে তাকাতেই আবদুল বললেন, “সাধারণত বছরের এই সময়টায় পাহাড়ের উপরে তীব্র হাওয়া বয়। আকাশও এতটা পরিষ্কার থাকে না। তাই জ্যাকেট, সোয়েটার না পরলে সমস্যা হয়। আপনারা ভাগ্যবান তাই এতটা পরিষ্কার আকাশ পেলেন।”
টেবল মাউন্টেনকে ঘিরে ছড়ানো রয়েছে একটি বিশাল সংরক্ষিত বনাঞ্চল। তার নাম টেবল মাউন্টেন বনাঞ্চল। উত্তরে সিগন্যাল হিল থেকে দক্ষিণে কেপ পয়েন্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে এই বনাঞ্চল। তার মধ্যে সিমন্স টাউনের মতো কিছু শহরাঞ্চলও রয়েছে। টেবল মাউন্টেন তো একেবারে কেপটাউন শহরের গায়েই। কেপটাউনে আসার আগে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছিলাম ফলস বে থেকে তিমি মাছের যাতায়াত প্রত্যক্ষ করা যায়। আর অক্টোবর মাসটা হল তিমি দেখার আদর্শ সময়। আমরা যে সময়টায় কেপটাউনে ঘুরছিলাম সেটা অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। তাই তিমি দেখার আগ্রহটা চেপে রাখতে পারিনি আমাদের গাইড আবদুলের কাছে।
আবদুল কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর সিমন্স টাউন যাওয়ার পথে, পাহাড়ি পথের এক ধারে আমাদের গাড়ি দাঁড় করালেন। অনেকটা নীচে অতলান্তিক মহাসাগর। সমুদ্রের তীরে সাদা বালিয়াড়ি, সেখানে ঢেউ এসে ভেঙে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমেই আবদুল নীচে সমুদ্রের একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের দিকে আমাদের লক্ষ রাখতে বললেন। প্রথমে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। মনে হচ্ছিল সমুদ্রের বুকে একটা পাথর ভেসে রয়েছে। আবদুল বললেন, “একটানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকুন। বুঝতে পারবেন।”
আবদুলের কথা শুনেই একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম ভেসে থাকা পাথরটা এগিয়ে যাচ্ছে, তার গায়ে লাগানো আর একটা ছোট পাথর। মাঝে মাঝে ফোয়ারার মতো জল উঠছে বড় পাথরটার সামনের দিক থেকে। উত্তেজিত আবদুলের মন্তব্য, “সন্তানকে নিয়ে মা তিমি জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। আগে জানলে বায়নোকুলার নিয়ে আসতাম। অনেক পরিষ্কার দেখা যেত।”
ইচ্ছে করছিল নেমে যাই সমুদ্রের তীরে। তীরের একেবারে কাছ দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল তিমিরা। কিন্তু আবদুলের কড়া নির্দেশ, “ওই সমুদ্রতটে নামা বারণ। তিমিরা এই অঞ্চলে তীরের খুব কাছ দিয়ে যাতায়াত করে। তাই ওই সমুদ্রতটে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।” একেবারে কাছ থেকে সিল দেখেছি, পেঙ্গুইন দেখেছি কিন্তু তিমি আর দেখা হল না। আবদুল পিঠে হাত রেখে বললেন, “তাও তো আপনারা দেখতে পেলেন। বেশির ভাগ পর্যটকের সেই ভাগ্যটাও হয় না।”
কেপ টাউনের একেবারে দক্ষিণপ্রান্ত কেপ পয়েন্টে এসে কিন্তু মন ভরে গেল। রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অস্ট্রিচ। সামনে সমুদ্র। পাথরের উপরে বসে আছে নানা ধরনের সামুদ্রিক পাখি। সুমদ্রের ধারে বোল্ডারের উপরে বসে থাকতে থাকতে কখন যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। উঠে পড়তে হল আবদুলের ডাকে।
আমরা ফিরে চললাম কেপটাউনের দিকে। রাস্তার এক দিক আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে টেবল মাউন্টেন। অন্য দিকে সমুদ্র। গাড়ি চালাতে চালাতে আবদুল বললেন, “গাড়ির জানলা কেউ দয়া করে খুলবেন না। গাড়ি এক বার দাঁড়ালে বেবুনরা ছুটে আসবে। হাতে যা থাকবে তা ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। বাধা পেলে আঁচড়ে-কামড়ে দেবে।” পথের ধারে বিশাল বেবুনদের কয়েকটিকে বসে থাকতে দেখলাম। নিরীহ মুখ করে ঘাস থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল।
বেবুনদের দুষ্টুমির কথা শুনে আমার কাশী, বৃন্দাবনের কথা মনে পড়ল। বাঁদররা পৃথিবীর সব জায়গাতেই বোধ হয় বাঁদরামিতে একই রকম।



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.