মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গ দান এবং অন্যের দেহে তা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এ রাজ্যে ইতিহাস গড়ার দাবিটা উঠেছিল যাঁদের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে, চিকিৎসার অভাবে সেই দুই যুবকই এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি।
আর্থিক সামর্থ্য নেই ছিটেফোঁটা। সরকারি সাহায্যও কার্যত নেই। ফলে অস্ত্রোপচারের পরে প্রতি মাসে যে মোটা অঙ্কের অর্থ স্রেফ ওষুধ কিনতে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে খরচ হয়, তার সিকিভাগও তাঁরা জোগাড় করতে পারছেন না। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই জানিয়ে দিয়েছেন, এ ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই কোনও চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে যেতে পারে।
|
পিন্টু মণ্ডল |
|
শঙ্কর মণ্ডল |
রোগীর মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গ দান নিয়ে সচেনতা বাড়ানোর কাজ এ রাজ্যে শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। কিন্তু পরিবারের লোককে রাজি করানোর ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছিল। শেষে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মধ্য কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালের এক নিরাপত্তাকর্মীর মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে তাঁর পরিবারের লোকেরা অঙ্গ দানে রাজি হন। সেই মতো তড়িঘড়ি তাঁর কিডনি দু’টি সংগ্রহ করে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি থাকা রেনাল ফেলিওর হওয়া দুই যুবকের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। স্বাস্থ্যকর্তারা ঘোষণা করেন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিহাস রচিত হল রাজ্যে! সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দেন তাঁরা।
কিন্তু বছর ঘোরার পরে সেই ইতিহাসের খবর কেউ রাখে না। দুই পরিবারের লোকেরই বক্তব্য, “এমন জানলে ওই অস্ত্রোপচারে রাজি হতাম না। অস্ত্রোপচার না করালে হয়তো মৃত্যু অনিবার্য ছিল, কিন্তু করিয়েও ওষুধের অভাবে পরিণতি সেই একই দিকেই যাচ্ছে।”
উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে থাকেন ৩৫ বছরের শঙ্কর মণ্ডল। স্ত্রী সুলেখা মণ্ডল অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। আপাতত তিনিই সংসারের একমাত্র রোজগেরে। অস্ত্রোপচারের পর থেকে ওষুধ আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা মিলিয়ে মাসে প্রায় সাত হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে প্রায় না খেয়ে থাকার অবস্থা সুলেখাদেবীর। বললেন, “যেটুকু জমি ছিল সেটাও বেচে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ও সুস্থ হলে আবার সব হবে। তখন জানতামই না অপারেশনের পরে মাসে মাসে এত টাকা খরচ। জানলে কিছুতেই রাজি হতাম না। এখন তো গোটা পরিবার মিলে না খেতে পেয়ে মরতে হবে।”
দক্ষিণ ২৪ পরগনার চম্পাহাটির পিন্টু মণ্ডলের বয়স ২০ বছর। বাবা ক্ষেতমজুর। মাসে চিকিৎসা বাবদ পিন্টুরও খরচ লাগছে হাজার ছয়েক টাকা। কোথা থেকে জোগাড় হবে এ সব? পিন্টু বললেন, “ডাক্তার বাবুরা বলছেন, সারা জীবনই ওষুধ খেয়ে যেতে হবে। আমি জানি তা হওয়ার নয়। শীঘ্রই ওষুধ বন্ধ করে দিতে হবে। ধার করে এতদিন বাবা কোনও মতে টাকার জোগাড় করেছেন। এখন গলা পর্যন্ত ঋণে ডুবে।”
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সাফল্য ঘোষণার পরে কেন সরকারি তরফে আর কোনও সাহায্য করা হল না? স্বাস্থ্যকর্তারা মেনে নিয়েছেন, এসএসকেএমে নিখরচায় অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভবন থেকে দুই পরিবারকে ১৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছিল। তার পরে আর কোনও সহায়তা করা হয়নি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সমস্ত রোগীকে নিখরচায় ওষুধ দেওয়া তো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ওঁরা লিখিত আবেদন করলে ‘স্পেশ্যাল কেস’ হিসেবে বিবেচনা করার কথা ভাবা হতে পারে। এ বিষয়ে সর্বোচ্চ স্তর থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরে আজীবন এমন একটি ব্যয়বহুল চিকিৎসার ভার যে ওই দুই পরিবারকেই নিতে হবে, সেটা কি ওঁদের জানানো হয়েছিল? স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে উত্তর মেলেনি। অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে রাজ্যে বহু বছর ধরেই কাজ করছেন সমাজকর্মী ব্রজ রায়। তাঁর কথায়, “ডাক্তারদের এত চেষ্টা, এত সাফল্য সব বৃথা যাবে, যদি ওষুধের ব্যবস্থা করা না যায়। ন্যায্য মূল্যের দোকানে ওই সব ওষুধ পাওয়া যায় না। তাই বাড়ির লোকের পক্ষে প্রতি মাসে মোটা টাকা জোগাড় করা অসম্ভব।”
কেন ওই সব ওষুধ ন্যায্য মূল্যের দোকানে পাওয়া যায় না? স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, ওষুধগুলি খুবই মূল্যবান বলে এখনও সরকারি তালিকায় রাখা যায়নি। ক্যানসার, হিমোফিলিয়ার মতো রোগের দামী ওষুধগুলি সবে রাখা শুরু হয়েছে। ধাপে ধাপে কিডনির ওষুধগুলিও রাখার পরিকল্পনা রয়েছে।
অঙ্গ প্রতিস্থাপন আন্দোলনের কাজে অনেক দিন ধরে যুক্ত ইউরোলজিস্ট অমিত ঘোষ। তিনি বলেন, “কিডনি প্রতিস্থাপন একবার হয়ে গেলে তা জীবনভর কাজ করবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কিছু বছর পরে ফের প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। অন্যের কিডনি প্রতিস্থাপনের পরে শরীর তা প্রত্যাখান করতে শুরু করে। তা ঠেকাতে ‘ইমিউনো সাপ্রেসিভ ড্রাগ’ প্রয়োজন, যা খুবই ব্যয়বহুল এবং আজীবন খেয়ে যেতে হয়।”
তাঁর মতে, যদি আর্থিক সাহায্য জোগানোর কেউ না থাকেন, তা হলে কোনও গরিব মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন আক্ষরিক অর্থেই ‘শাঁখের করাত’ হয়ে দাঁড়ায়।
|
হাসপাতালে পরিদর্শন
নিজস্ব সংবাদদাতা • বালুরঘাট |
কেন্দ্রের অনুমোদন পেতে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা ও পরিকাঠামোর কাজে গতি বাড়াতে তৎপর হল রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। দক্ষিণবঙ্গের তিনটি হাসপাতালের সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা হাসপাতাল, শিলিগুড়ি সদর হাসপাতাল এবং বালুরঘাট জেলা হাসপাতালকে কেন্দ্রের কোয়ালিটি ইমপ্রুভমেন্ট প্রোগ্রামের অধীণে বেছে নিয়ে দু’মাস আগে কাজ শুরু করা হয়েছিল। বৃহস্পতিবার কাজের অগ্রগতি খতিয়ে দেখতে বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে পরিদর্শনে আসেন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের দুই সদস্যের এক প্রতিনিধি দল। রাজ্য হাসপাতাল প্রশাসনিক শাখার অতিরিক্ত অধিকর্তা কল্যাণ মুখোপাধ্যায় এবং পরিকল্পনা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ঝুমা ওঝা এ দিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও চালু প্রকল্পগুলির কাজ দেখেন। হাসপাতাল চত্বরে অতিথি নিবাসে তাঁরা হাসপাতাল ও জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্মকর্তা নিয়ে বৈঠকও করেন। পরে সাংবাদিকদের কল্যাণবাবু বলেন, ‘‘হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে যাবতীয় পরিষেবা ত্রুটিমুক্ত করার লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ।” হাসপাতালের যাবতীয় বিভাগের মানোন্নয়নের কাজে সমন্বয় রক্ষার জন্য চিকিৎসক এবং কর্মীদের নিয়ে ৯ জনের একটি দল গঠন করা হয়েছে। দক্ষিণ দিনাজপুরের ডেপুটি সিএমওএইচ অশোক বিশ্বাস বলেন, “বর্হিবিভাগের রোগীদের সুষ্ঠু পরিষেবা, শিশু ও প্রসূতি সহ সমস্ত বিভাগের পরিকাঠামো এবং চিকিৎসা পরিষেবার মানোন্নয়নের কাজ শুরু হয়েছে।” বালুরঘাট হাসপাতালে ওই কর্মসূচির অধীন সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট, কেমো থেরাপি ইউনিট, ডেঙ্গি নির্নয়ে ম্যাকঅ্যালাইজা পরীক্ষা ইউনিট, পুষ্টি বিভাগ, পিপিপি মডেলে সিটি স্ক্যান যন্ত্র, স্বল্প মূল্যের ওষুধের দোকান চালু হয়েছে। ডায়ালেলিস ইউনিটের কাজ চলছে। হাসপাতালের নিরাপত্তা ও সাফাই কাজের উপরও কর্মসূচি নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। |