রুপোর গাছ তো কারিগরকে দিলেই বানিয়ে দেবে, কিন্তু গাছে রুপো ফলানো! এমন গাছের খোঁজ দিয়েই কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছেন এক বঙ্গসন্তান।
|
বিজ্ঞানী সৌগত ঘোষ। |
নাম সৌগত ঘোষ। সম্প্রতি এই বাঙালি বিজ্ঞানীর গবেষণার কথাই প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যানোমেডিসিন’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকায়। ‘এয়ার পোট্যাটো’ নামে একটি গাছের কন্দে রুপোর ন্যানোপার্টিকলের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। যা থেকে তৈরি করা যেতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা ডায়াবেটিসের ওষুধ।
চন্দননগরের সৌগতবাবু বর্তমানে পুণে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পরেই তিনি ডাক পেয়েছেন ইউনেস্কোর ‘ন্যানো বায়ো মেড-২০১৩’ সম্মেলনে। ইতিমধ্যেই স্পেন, ইতালিতেও নিজের গবেষণার কথা জানিয়ে এসেছেন তিনি। এ ছাড়াও সুযোগ পেয়েছেন ‘বায়ো মাইক্রো ওয়ার্ল্ড-২০১৩’য়।
কিন্তু কী আবিষ্কার করেছেন তিনি, যার জন্য এত হইচই?
বিষয়টা খোলসা করে জানালেন সৌগতবাবু নিজেই। জানালেন, এক বার তিনি বেড়াতে যান নাসিকের কাছে ত্র্যম্বকেশ্বর মন্দিরে। সেখানে গিয়ে সৌগতবাবু এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্পর্শে আসেন। তখনই তাঁর নজরে পড়ে একটি বিশেষ ধরনের গাছ। যা আদিবাসীরা রেখেছেন নিজেদের খাদ্য-তালিকায়। গাছটির স্থানীয় নাম ‘বরাহিকন্দ’। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘এয়ার পোট্যাটো’। বিজ্ঞানসম্মত নাম ডাওসকোরিয়া বুলবিফেরা। এই গাছের ফল দেখতে আলুর মতো। মাটির উপরে জন্মায়, তাই গাছের নাম এয়ার পোট্যাটো। প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে এর ব্যবহার ছিল, জানতেন সৌগতবাবু। কেন তা অবশ্য তিনি তখন জানতেন না।
আদিবাসীদের কাছেই জানা যায় গাছটির বিশেষত্ব। এই বরাহিকন্দ রান্না করে খেলে দুই থেকে তিন দিন তাঁদের আর খিদে পায় না। সৌগতবাবু বলেন, “গবেষণাগারে বরাহিকন্দ পরীক্ষা করে আমি জানতে পারি ওর মধ্যে থাকা বিশেষ উপাদানের কথা। যা দিয়ে তৈরি করা যায় অ্যান্টি-ডায়াবেটিক ওষুধ। আমরা যখন কোনও খাবার খাই, আমাদের রক্তে বাড়তে থাকে গ্লুকোজের পরিমাণ। কিন্তু আমি দেখলাম, যাঁদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি, তাঁরা যদি খাবারের সঙ্গে এই কন্দের তৈরি কোনও পদ খান, তা হলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়বে না। বরং কমতে থাকবে গ্লুকোজের মাত্রা।” |
এই সেই এয়ার পোট্যাটো গাছ। |
কেন? সৌগতবাবু বলেন, “পরীক্ষা করে দেখি বরাহিকন্দর নির্যাসে প্রচুর ফ্ল্যাবোনয়েডস, ফেনোলিকস, দুর্লভ স্যাপোনিন রয়েছে। আর আছে প্রচুর সিলভার ন্যানোপার্টিকলের উপস্থিতি। এগুলি আসলে ১-১০০ ন্যানোমিটার দৈর্ঘ্যের কণা (১ ন্যানোমিটার হল ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ)। ওই কণা নিয়ন্ত্রণ করছে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ। শুধু তাই নয়, আমরা দেখেছি অন্তত ১৪টি ব্যাকটেরিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে রুপোর ন্যানো পার্টিকেল। ওই ব্যাক্টেরিয়াজাত রোগ রুখে দেয় ন্যানো পার্টিকেল।”সৌগতবাবুর দাবি, “আজকাল বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার ফলে, জীবাণুদের মধ্যে প্রতিরোধশক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে রোগ প্রতিরোধে একটি বিরাট বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। মূলত উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করার জন্যই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আমরা রুপোর ন্যানোপার্টিকলের সাহায্যে কম মাত্রার এমন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করেছি, যা ওই রকম প্রতিরোধক্ষম ১৪টি ব্যাকেটেরিয়াকে মেরে ফেলতে পারে।”
সৌগতবাবুর গবেষণার কথা জেনে তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে দেশের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন আইআইটি (বম্বে)-র শিক্ষক জয়েস বেল্লারে। সৌগতবাবুর গবেষণায় যোগ দিয়েছেন ডিফেন্স ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স টেকনোলজি-র সঙ্গীতা কালের মতো অনেকেই। সঙ্গীতা যেমন বললেন, “সৌগতর গবেষণার বিষয় এতটাই অভিনব যে, আমরা ঠিক করি ওঁকে সাহায্য করব। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উপকৃত হবে এই নয়া গবেষণায়।”
কী বলছেন কলকাতার গবেষকরা? কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক অঞ্জন দাশগুপ্তর কথায়, “কাজটা যে ভাল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ওঁরা যে ভাবে ন্যানোপার্টিকলের ব্যবহার করেছেন, প্রশংসনীয়।” তবে ব্যাকটেরিয়া বিনাশে শুধু ন্যানোপার্টিকল, নাকি সিলভার আয়নেরও ভূমিকা রয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক করে দিয়েছেন, এই প্রশ্নে সৌগত-র গবেষণার গুরুত্ব এতটুকু কমে না।
কলকাতার ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “কেমোথেরাপিতে ন্যানোপার্টিকলের ব্যবহার রয়েছেই। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অন্য ওষুধের থেকে ভাল ফলও দেয়।”
সম্প্রতি বহিরাকন্দের নির্যাসে সোনার ন্যানোপার্টিকলেরও খোঁজ পেয়েছেন সৌগতবাবুরা। ওই বাঙালি বিজ্ঞানীর দাবি, “প্রাথমিক গবেষণায় আমরা জেনেছি স্তন ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এই সোনার ন্যানোপার্টিকল। যে দিন এই গবেষণার পুরো ফল আমরা পাব সে দিন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরও একটা ধাপ অতিক্রম করব।” |