মাঠের মধ্যে ম্যারাপ বেঁধে অনুষ্ঠান করার দিন শেষ হচ্ছে পুরুলিয়ার জয়পুরের শিল্পীদের। তাঁদের দীর্ঘদিনের আশাপূরণ হচ্ছে আজ শনিবার। জয়পুরে ঢোকার মুখে পুরুলিয়া-রাঁচি রাস্তার পাশে উদ্বোধন হচ্ছে ‘পরিচয়’ সংস্কৃতি ভবনের। ইতিহাস সমৃদ্ধ এই জনপদের অতীত নিয়ে একটি বইও প্রকাশ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ডিসেম্বরের মাঝেই ‘বড়দিনে’র খুশিতে মাতছেন জয়পুরের বাসিন্দারা।
কংসাবতী ও ইজরী নামের দুই পাথুরে নদীর মাঝখানের এই জনপদ জেলার লোকশিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। কিন্তু এতদিন তাঁদের অনুষ্ঠান করার মতো এখানে স্থায়ী কোনও মঞ্চ ছিল না। তা নিয়ে আক্ষেপও ছিল। জয়পুরের বিডিওর দায়িত্ব পেয়ে শিল্পরসিকদের এই খেদের কথা জানতে পারেন মেঘনা পাল। এলাকার মানুষজন জানাচ্ছেন, পরিচয় নামের ওই সংস্কৃতি মঞ্চ গড়ে ওঠার পিছনে তিনিই রয়েছেন।
মেঘনার কথায়, “জয়পুরে ঝুমুর, ছৌনাচ, নাটক থেকে গান-সহ শিল্পের বিভিন্ন ধারার চর্চা থাকলেও এখানে এতদিন তা উপস্থাপনের কোনও স্থায়ী মঞ্চ ছিল না। বিভিন্ন জায়গায় বাঁশ-কাঠের মঞ্চ তৈরি করে শিল্পীরা অনুষ্ঠান করতেন। তাই বছর দুয়েক আগে এই ব্লকে আসার পরেই একটা স্থায়ী মঞ্চ তৈরির ভাবনা মাথায় আসে।”
তিনি তৎকালীন জেলাশাসক অবণীন্দ্র সিংহের কাছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপযোগী একটি সভাঘর তৈরি করে দেওয়ার অনুরোধ জানান। জেলা পরিকল্পনা দফতর থেকে বরাদ্দ করা হয় ২৪ লক্ষ টাকা। পরে অন্য তহবিল থেকেও আরও টাকা আসে। ধাপে ধাপে ৪০ ডেসিমেল জায়গার উপর গড়ে ওঠে পরিচয়। ভবনের সামনে সারি সারি পলাশ। মঞ্চের গায়ে ম্যুরালে ছৌনাচ, ঝুমুর, নাটুয়া, টুসু, দাসাই, করম-সহ বিভিন্ন লোকশিল্পের মুর্হূতকে ফুটিয়ে তুলছেন জেলারই শিল্পী রাহুল দাস। বিডিও বলেন, “ওই ছবিই জয়পুরের সঙ্গে বহিরাগতদের পরিচয়ের সূচনা করবে বলে ভবনের নাম বাছা হয়েছে পরিচয়।” |
জয়পুরের ‘সপ্তর্ষি’ নামে সংস্থাটি গত দু’বছর রাজ্য ছাত্র-যুব উৎসবে শ্রেষ্ঠ নাট্যদলের শিরোপা পেয়েছে। ওই সংস্থার কর্ণধার সনৎ দাসের কথায়, “এতদিন মঞ্চ বেঁধে আমাদের নাটক করতে হত। এ বার সেই অসুবিধা দূর হল।” স্থানীয় বাসিন্দা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী কল্লোল শিকদার বলেন, “নতুন প্রতিভাদের এই সভাঘর অনুপ্রেবণা দেবে।”
সংস্কৃতি ভবনের দ্বারোদঘাটনের সঙ্গেই স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সহায়তায় প্রকাশিত হচ্ছে জয়পুরের ইতিহাস থেকে নানা তথ্যে ঠাসা ‘প্রেক্ষাপট গড়জয়পুর একটি আলোকসম্পাত’ নামের একটি বই। স্থানীয় কয়েকজন গবেষককে সঙ্গে নিয়ে মেঘনা এই সংকলন তৈরি করেছেন। মেঘনা জানান, “এলাকার ইতিহাস, প্রাচীন সাহিত্যচর্চা, সংস্কৃতি, লোকসঙ্গীত সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে ওই বইয়ে। এ ছাড়া এলাকার বিভিন্ন জায়গার নামকরণের পিছনে যে ইতিহাস রয়েছে, তারও উল্লেখ রয়েছে বইটিতে। থাকছে এলাকায় ছড়িয়ে থাকা কিছু প্রবাদ। জনজীবনে কী ভাবে তা ব্যবহৃত হয় তাও লেখা রয়েছে ওই সংকলনে। মেঘনা বলেন, “যাঁরা ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন বা যাঁরা বিভিন্ন বিষয় জানতে চান, তাঁদের কাছে এই সংকলন সমাদৃত হবে বলে মনে হয়।”
ওই বইয়ে এলাকার বিভিন্ন গ্রামের নামের প্রেক্ষাপট খুঁজে এনেছেন পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠের শিক্ষক শ্যামল মণ্ডল। তাঁর কথায়, “রাজা জয়সিংহের নাম থেকেই জয়পুরের নামকরণ হয়। বিভিন্ন গ্রামের নামের পিছনেও রয়েছে নানা কাহিনি। সে সব তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।” জেলার মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো বলেন, “এই সংকলন জয়পুরকে জানতে অনেক সাহায্য করবে।” পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, “অজানা গড়জয়পুরের সন্ধানে সংকলনটি তৈরি করে জয়পুরের বিডিও প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।” জেলার লোক গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামী বলেন, “শুধু ভালো উদ্যোগই নয়, অন্য ব্লকগুলির কাছে অনুসরণ যোগ্যও বটে। এটাই জেলার একমাত্র ব্লক যার ইতিহাস এ বার দুই মলাটে স্থান পেল।” |