কথাগুলি বলার সময়ে বৃদ্ধের চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল।
নাম ইতো মেলেইন। বয়স ৭৫। পরনে ফুলহাতা সোয়েটার। কালো ট্রাউজার্স। পায়ে জুতো। বেঁটেখাটো চেহারা। কিন্তু যখন বড় বড় পা ফেলে হাঁটেন, অনেক যুবকও দৌড়ে তাঁর নাগাল পাবেন না। নিজেকে বলেন, “আমি নেলসন ম্যান্ডেলার ‘স্পিয়ার অব দ্য নেশন’-এর এক জন সদস্য। জেলের বাইরে যখন ছিলাম নেতার কথাতেই আমরা সশস্ত্র আন্দোলনের স্বপ্ন দেখতাম।” আমরা কথা বলছিলাম রবেন আইল্যান্ডের জেলখানার মধ্যে। ১৯৯৪-এর পরে জেলখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওই কারাগার এখন একটা সংগ্রহশালা। ম্যান্ডেলা যে সেলটিতে ১৮ বছর কাটিয়েছেন তার বন্ধ দরজার বাইরে আফ্রিকার কালো মানুষেরা আজও দু’দণ্ড দাঁড়ান।
|
চোখের জল ফেলেন। একসঙ্গে অনেকগুলি আবেগমথিত গলায় “আমাদের শ্রদ্ধেয় ম্যান্ডেলা” গানে গোটা পরিবেশটাই ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কঠিন চরিত্রের মানুষ মেলেইনের চোখের কোনা তখন দেখি চকচক করছে। সোয়েটারে চোখ মুছে নেন ৭৫ বছরের যুবক।
আমাদের দেশে যেমন আন্দামান, তেমনই দক্ষিণ আফ্রিকায় রবেন আইল্যান্ড। তবে আন্দামান থেকে মূল ভারতীয় ভূখণ্ড যেমন বহু দূরে, রবেন আইল্যান্ড কেপটাউন থেকে মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের পথ। দুপুরে কেপটাউন থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে আসা যায় কেপটাউনে। আন্দামান গেলে সেলুলার জেল না দেখলে যেমন সফর সম্পূর্ণ হয় না, তেমনই কেপটাউনের ভ্রমণ তালিকায় রবেন আইল্যান্ড থাকবেই।
৭৫ বছরের মেলেইনের কাছে রবেন আইল্যান্ড সব থেকে বড় তীর্থক্ষেত্র। এই মেলেইন কিন্তু আদতে দক্ষিণ আফ্রিকার লোকই নন। দক্ষিণ আফ্রিকার পাশের দেশ বতসোয়ানায় জন্ম মেলেইনের। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ম্যান্ডেলার সংগঠিত আন্দোলনে গা ভাসাতে স্কুলের গন্ডিই আর পেরনো হয়নি দরিদ্র পরিবারের ছেলেটির। মেলেইনের কথায়, “তখন নেলসন তাঁর স্পিয়ার অব দ্য নেশন নামের বাহিনী তৈরি করে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন। আমরা কয়েকজন সেই সময় সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম দক্ষিণ আফ্রিকায়। যোগ দিলাম স্পিয়ার অব দ্য নেশন-এ। আমাদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেই সময় ধরা পড়ে গেলাম সেনাবাহিনীর হাতে। আমার ঠাঁই হল রবেন আইল্যান্ডের কারাগারে।”
“জেবার্গ (জোহানেসবার্গ) থেকে ট্রেনে কেপটাউন। সেখান থেকে জাহাজে চেপে রবেন আইল্যান্ড। সে সময় দেশদ্রোহীদের ঠাঁই হত এই পাথুরে দ্বীপের জেলখানায়। নির্বাসন বলতে পারেন। কালাপানি পেরিয়ে ওই জেলে আসার সময়ে আমার এতটুকুও খারাপ লাগেনি। বরং আমি ভাবছিলাম কত ক্ষণে ওই দ্বীপে গিয়ে দেখতে পাব আমাদের সর্বাধিনায়ককে।”
বলতে বলতে চুপ করে যান মেলেইন। গলায় সোনার চেনের সঙ্গে লাগানো লকেটে চুমু খেয়ে নিলেন এক বার। লকেটের ছবিটা নেলসন ম্যান্ডেলার।
ওই জেলেই মেলেইন প্রথম দেখেন তাঁর দেবতাকে। এ ছাড়া আর কোনও ভাবে তিনি ভাবতে পারেন না নেলসন ম্যান্ডেলাকে। জেলে ওঁর সান্নিধ্যে এসে তাঁর জীবনদর্শনটাই বদলে গেল। জঙ্গি আন্দোলনের এক জন কমান্ডো থেকে তিনি হয়ে গেলেন অহিংসার পুজারী। ১৯৯০-এ মুক্তি পাওয়ার পরে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিলেন মেলেইন। ফের ফিরে এসেছেন তাঁর তীর্থক্ষেত্রে। এখন রবেন আইল্যান্ডের কারাগারের গাইড হিসেবে কাজ করেন। আর দ্বীপ জুড়ে রেখে যাওয়া ম্যান্ডেলার স্মৃতি
হাতড়ে বেড়ান। |
এখানেই কেটেছে ১৮ বছর। পাশে ইতো মেলেইন। —নিজস্ব চিত্র। |
ম্যান্ডেলা এই জেলের যে কুঠুরিতে বন্দি ছিলেন সেখানে তাঁর ব্যবহৃত থালা, বাটি, কম্বল সংরক্ষণ করা হয়েছে। ওই কুঠুরি দেখতে যাওয়ার জন্য অবশ্য আমাদের গিয়ে দাঁড়াতে হল বিশাল একটি লাইনের একেবারে শেষে। লাইনটা জেলের মধ্য দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গিয়েছে কুঠুরির কাছে। আমাদের ঠিক আগে ছিলেন জাম্বিয়া থেকে আসা মহিলাদের একটি দল। ম্যান্ডেলার স্মৃতি বিজড়িত সেলের কাছে যে চলে এসেছি তা বুঝতে পারলাম ওই মহিলা পর্যটকদের গানে। ওই গানে কয়েকবার ম্যান্ডেলা নামটা শুনতে পেলাম।
জেলের বাইরে একটা পরিত্যক্ত খাদানের কাছে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল। আমাদের গাইড বললেন, “এখানকার কড়া রোদে পাথুরে মাটি খুঁড়তে হত। আর খননের ফলে যে পাথরের টুকরো মিলত সেগুলিকে লাগানো হত কারাগারের মেরামতি, চার্চের মেরামতি কিংবা দেওয়াল তৈরির কাজে।” খাদানের একটি দিকে খাড়া পাড়ের মধ্যে একটা বড় গর্ত। পাহাড়ের গুহার মতো। আমাদের গাইড বললেন, “প্রচণ্ড গরমে বিধ্বস্ত কয়েদিরা ওই গর্তকেই আংশিক বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতেন। এখানেই ম্যান্ডেলা তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেতেন। সেখানেই পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে নির্দেশ দিতেন।” ওই পরিত্যক্ত খাদানের একটি অংশে পাথরের টুকরো দিয়ে সাজানো রয়েছে একটি ছোট স্তূপ। সেটা কী? আমাদের গাইড বললেন, “রবেন আইল্যান্ডের জেলখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে এখানে পুরনো বন্দিদের পুনর্মিলন অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সঙ্গীরা প্রত্যেকে একটি করে পাথর রেখে নিজেদের বন্ধন জোরদার রাখার অঙ্গীকার করেন। স্তূপের প্রথম পাথরের টুকরোটি
রাখেন ম্যান্ডেলা।”
রবেন আইল্যান্ডের জেলখানা ঘুরতে ঘুরতে আমার সেলুলার জেলের কথা মনে পড়ে গেল। ব্রিটিশ শাসকেরা আন্দামানের ওই জেলে নির্বাসনে পাঠাতেন ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধাদের। তবে সেলুলারে বন্দিদের উপরে অত্যাচারের যে সব উপকরণ এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে, ম্যান্ডেলার স্মৃতিবিজড়িত জেলে কিন্তু সে রকম কিছু খুঁজে পেলাম না। এখানকার সেলগুলি অনেক প্রশস্ত, সেখানে আলোবাতাসও ঢোকে।
মেলেইন অবশ্য সেলুলার জেলের কথা শোনেননি। তাঁর চোখে রবেন আইল্যান্ডের ওই কারাগারই বিশ্বের নিকৃষ্টতম জায়গা। |