|
|
|
|
নতুনগ্রামের পেঁচা ডানা মেলছে আসবাবে |
বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য |
চেয়ারের হাতলে কাঠের প্যাঁচা। পায়ায় রাজা-রানির কাঠমূর্তি। দরজার পাল্লাজোড়া দুর্গার মোটিফ। বুকসেল্ফের গায়ে গণেশ জননী। কাঠের পুতুলের ব্যবহারটাই যেন বদলে গিয়েছে। পরিচিত কাঠের প্যাঁচা হোক বা রাজা-রানি এখন এগুলি ব্যবহার করা হচ্ছে দরজার ফ্রেম, ডাইনিং টেবল, সোফাসেট, সেন্টার টেবল, আয়না এমনকী খাটেও। সদ্য শুরু হওয়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় চোখে পড়ল এমনই পরিবর্তন। |
|
কাঠের পুতুলের জন্য বিখ্যাত বর্ধমান জেলার নতুনগ্রাম। কী ভাবে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যায় সে বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে বছর দশেক আগে এখানকার শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আর পরিবর্তনের শুরুটা তখন থেকেই। এ বারের হস্তশিল্প মেলায় শিল্পসামগ্রী নিয়ে এসেছেন বর্ধমানের অজিত সূত্রধর। এই শিল্পের সঙ্গে তিনি বংশপরম্পরায় যুক্ত। অজিতবাবু বললেন, “পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের উদ্যোগে নতুনগ্রামের শিল্পীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল প্রায় দশ বছর আগে। সেখানে শেখানো হয়, নতুন মাধ্যমে কী ভাবে কাজ করে এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তখন থেকেই একটু একটু করে বদল। আসবাবপত্রে ফুটিয়ে তোলা হতে থাকে রাজা-রানি, রাধা-কৃষ্ণ, কিংবা পেঁচার অবয়ব। তার উপর দেওয়া হয় উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ।”
ইদানীং কালে থিম পুজোর দৌলতেও নতুনগ্রামের কাঠের পুতুলের রমরমা বেড়েছে। কখনও পেঁচার আকারে মণ্ডপ, কখনও বা পুতুলের আকারে দুর্গা প্রতিমা। শহুরে নাগরিকের কাছে তাই নতুনগ্রামের এই শিল্প বেশ পরিচিত। শুধু পরিচিত নয় জনপ্রিয়ও বটে। কাজেই সে শিল্প যখন বাড়ির আসবাবপত্র-সহ দৈনন্দিন ব্যবহারের অন্যান্য সামগ্রীতেও ফুটে উঠছে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ক্রেতাদের মধ্যে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। শিল্পী মেঘনাদ সূত্রধর বললেন, “গত কয়েক বছরে নতুনগ্রামের এই শিল্প ভালই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কলকাতায়। আর দামও মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে।” |
|
শুধু কলকাতায় নয় মফসসলেও নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল ও আসবাবের চাহিদা বেড়েছে। মেলায় আসা আর এক শিল্পী গৌর সূত্রধর বললেন, “শুধু পুতুল তৈরি করে তো সারা বছর শিল্পীদের পেট চলে না। তাই আসবাবপত্রও তৈরি করতে হয় তাঁদের। তাতেও আজকাল নানা রকম পুতুল ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এর পাশাপাশি ঐতিহ্যশালী কাঠের পুতুলও আমরা তৈরি করি।”
মেলায় পুতুলের পাশাপাশি নতুনগ্রামের শিল্পীরা বিক্রি করছেন চেয়ার, বুকশেল্ফ, কর্নার এমনকী আয়নাও। তাতে রয়েছে নানা আকৃতির পুতুলের মোটিফ। মেলায় পছন্দের একটি আয়না দরদাম করতে ব্যস্ত অঞ্জনা চৌধুরী বললেন, “আয়নায় এমন কাঠের পুতুলের ব্যবহার অসাধারণ লেগেছে। ঘর সাজাতে এমন এথনিক জিনিসের জুড়ি কোথায়?” আবার ডাইনিং টেবল ও চেয়ারের সেট কিনতে এসে অজয় ঘোষ বললেন, “খুব সাধারণ কাঠের চেয়ার-টেবল। কিন্তু পায়াতে এবং হাতলে কাঠের পুতুলের ব্যবহার অদ্ভুত আকর্ষণীয় করে তুলেছে।” |
|
লোকশিল্পের গবেষকদের মতে, নতুনগ্রামের এই কাঠের পুতুলে আজও রয়েছে সাবেকি ছোঁয়া। পুতুলের গড়ন থেকে টানা বাঁশ পাতার চোখ সবেতেই তার প্রমাণ মেলে। প্রয়াত লোকশিল্প গবেষক তারাপদ সাঁতরা নতুনগ্রামের পুতুলের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘অধুনা বিলুপ্ত কালীঘাটের কাঠের পুতুলের সঙ্গে নতুন গ্রামের পুতুলের বেশ কিছু সাদৃশ্য রয়েছে।’ বাংলার লোকশিল্পের বহু নমুনাই আজ বিলুপ্ত। এমন একটা আশঙ্কা নতুনগ্রামের পুতুলের ক্ষেত্রেও করেছিলেন তিনি। তবে সুখের কথা এটাই যে, প্রাচীন এই শিল্প এখনও হারায়নি। উল্টে খুঁজে পেয়েছে নতুন এক দিক।
|
ছবি: লেখক। |
|
|
|
|
|