পরনে ধোপদুরস্ত পোশাক। পায়ে দামি কোম্পানির জুতো। কাঁধে লেদার ব্যাগ। সঙ্গে একটি ঝাঁ-চকচকে মোটরবাইক। সিঙ্গল স্ট্রোকে বাইক স্টার্ট দিয়ে ওই যুবকরা চষে বেড়াতেন এক এলাকা থেকে অন্য এলাকা। পেশায় ওঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন কোনও না কোনও অর্থলগ্নি সংস্থার এজেন্ট বা কর্মী। কথাবার্তায় তুখোড়। অমায়িক ব্যবহার। সহজেই ঢুকে পড়তেন বাড়ির রান্নাঘরে। আর ওই যুবকদের সৌজন্যেই গতি পেয়েছিল মফস্সলের বাইক ব্যবসা। সে কথা কবুল করে ব্যবসায়ীরাও জানাচ্ছেন, “গত কয়েক বছরে হু হু করে বাড়ছিল মোটরবাইকের বিক্রি। দ্রুত ব্যবসা বেড়ে যাওয়ায় খোলা হয়েছিল বহু শো-রুম এবং সার্ভিসিং সেন্টার। বাইক ব্যবসার সে বড় সুখের সময় ছিল!”
কিন্তু ২০১৩-র প্রথম দিকেই ছবিটা গেল বদলে। বাইক বিক্রির গতিও আচমকা শ্লথ হয়ে গেল। প্রকাশ্যে চলে এল একের পর এক অর্থলগ্নি সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারি। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কেতাদুরস্ত অফিসগুলোতে রাতারাতি ঝুলে গেল তালা। অর্থলগ্নি সংস্থার রাঘববোয়াল থেকে চুনোপুঁটিরা ধরা পড়ল পুলিশের হাতে। যারা ধরা পড়ল না তারা গা-ঢাকা দিল জনরোষের ভয়ে। আর এ সব কিছুরই একটা মিলিত প্রভাব এসে পড়ে বাইক ব্যবসার উপর। |
কিন্তু কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল মোটরবাইকের ব্যবসা? নবদ্বীপের এক মোটরবাইকের শো-রুমের মালিক দীপক কুণ্ডু বলেন, “গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভাল সময় গিয়েছে ২০১০-২০১১। বছরে সে সময় ৩৫০টি বাইক বিক্রি করেছি। গড়ে মাসে ৩০-৩৫টি। খেয়াল করুন, ওই সময়ে সারদা সহ অন্য কোম্পানির রমরমা বাজার ছিল। আর এখন বাইক বিক্রি হচ্ছে মাসে ১৫ থেকে ১৮টি। ২০১২-তেও এই সময়টায় বিক্রি ছিল মাসে গড়ে ২৫টি।”
দীপকবাবুর কথায়, “আসলে ওই সব কোম্পানির এজেন্ট ও কর্মীদের সৌজন্যে সে সময় প্রচুর বাইক বিক্রি হয়েছে। সারা দিনে নানা জায়গায় ছোটাছুটির কাজে বাইকই ছিল ওদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের। রোজদিনই বাড়ছিল এজেন্টের সমখ্যা। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বাইকের বিক্রিও।” জেলা সদর, কৃষ্ণনগরের এক বাইক শো-রুমের মালিক সৌম্যজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, “বেথুয়াডহরী, পলাশি, দেবগ্রামের মতো এলাকায় বাইক বিক্রির হার খুবই বেড়ে গিয়েছিল। জেলা সদর তো বটেই, পলাশির মতো জায়গায় ২০১২-র এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত মোট ২২৩টি বাইক বিক্রি হয়েছিল। চলতি বছরে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৮২টি। প্রায় ৩০ শতাংশ হারে বিক্রি কমছে।”
বাইক ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এই বিক্রি আরও কমে যাবে। করিমপুরের বাইক বিক্রেতা রণেন্দু বিশ্বাস বলেন, “একটা সময়ে আমাদের কোম্পানি একটা সার্ভে করে দেখেছিল প্রতি বছর গড়ে ৩০ শতাংশ হারে বাইকের বিক্রি বাড়বে। তেমনটাই হয়েছিল। তবে পলাশি, দেবগ্রাম, করিমপুরের মতো এলাকায় প্রতি বছর বাইক বিক্রির হার ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়।” রণেন্দুবাবু বলেন, “ এজেন্ট বা কর্মীদের বাইক কেনার জন্য ওই সব লগ্নিসংস্থা নানা সুযোগ, সুবিধাও করে দিত। ২০১২ সালে ৯৯২টি মোটরবাইক আমার এলাকায় বিক্রি হয়েছে। ২০১৩ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৫২৯-এ।”
একই ছবি মোটরসাইকেল সার্ভিসিং সেন্টারগুলিতেও। নবদ্বীপের দীপক কুণ্ডু বলেন, “বাইক কেনাই শুধু কমেনি, কেনা বাইকও আর সার্ভিসিং-এ তেমন আসছে না। পেশার তাগিদেই লগ্নিসংস্থার এজেন্টদের গাড়ি চালাতে হত অনেক বেশি। ফলে দেড় থেকে দু’ মাস পরেই তাদের গাড়ি সার্ভিসিং করাতে হত। এখন সে বাইকও নেই, নেই বাইকওয়ালাও! ফলে সার্ভিসিং করাতে আসা বাইকের সংখ্যাও আগের থেকে অনেক কমেছে।” কৃষ্ণনগরের সৌম্যজিৎবাবু বলেন, “বছরে গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ বাইক সার্ভিসিং করতাম আমরা। সেই সংখ্যাটাও প্রায় ৩০ শতাংশ কমেছে।” বিক্রি দূরে থাক, ফাইন্যান্সে বিক্রি করা মোটরবাইকের বকেয়া টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সংস্থার লোকজন। না মিলছে টাকা, না মিলছে গাড়ি। আর যিনি বাইক কিনেছিলেন বা যিনি গ্যারান্টার হয়েছিলেন হেমন্তের কুয়াশায় তাঁরাও যেন মিলিয়ে গেছেন! |