বাহির পানে: দক্ষিণের টান
পশুরাজের দরবারে
পুকুর পাড়ে ওরা দু’জন যে ভাবে পা ঝুলিয়ে বসেছিল তাতে মনে হওয়াই স্বাভাবিক যে সাত সকালে ওরা মুক্ত বায়ু সেবন করতে এসেছে।
ব্যস্ততা নেই। মাঝে মাঝে হাই তুলছে। একে অপরের দিকে চেয়ে দেখছে, আর গলা দিয়ে অদ্ভূত এক শব্দ বের করছে। একজন এক সময় গড়িয়েই পড়ল মাটিতে। রাস্তার ধারে এই দৃশ্য দেখতে তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছে দু দু’টি ল্যান্ডরোভার। ঠান্ডা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে এই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে হুড়োহুড়ি। ওরা কম বয়সী দুটি সিংহ। সবে কেশরগুলি ফুলে ফেঁপে উঠতে চলেছে।
কিন্তু এ বয়সেই ওদের দল থেকে বের করে দিয়েছে মা-মাসিরা। কারণ, দলের একেবারে কচিকাঁচাদের ক্ষেত্রে ওরা দু’জন বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। ওরা দু’জনেই প্রজননক্ষম হয়ে উঠেছে। তাই দলের কিশোরীদের সম্ভ্রম রক্ষায় ওরা বিতাড়িত। সুখে নেই ওই দুই ভাই। কারণ, দল থেকে বের করে দেওয়ার খবর পৌঁছে গিয়েছে ওদের বাবা কাছে। দলের পুরো নারী বাহিনীর স্বামী সে। দুই ছেলে রীতিমতো ডাগরডোগর হয়ে উঠেছে শুনে বাবা ইতিমধ্যেই ওদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। তাই দুই ভাইয়ের বিপদ আসতে পারে বাবার কাছ থেকেও। একটানা সিংহচরিত বুঝিয়ে কিছুটা থামলেন থিও। আমাদের গাড়ির চালক।
ওরা এ ভাবে আলাদা বসে কেন? থিওর ব্যাখ্যা, ওরা দু’জন এখন কিছু দিন একসঙ্গে শিকার ধরবে। সিংহীদের কোনও দলের কাছাকাছি পৌঁছে ওরা দু’জন গলা থেকে অদ্ভূত এক আওয়াজ বের করবে। সেই আহ্বানে কোনও সিংহী যদি দলছুট হয়ে এসে পড়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে ওরা। তারপরে ওই দুই ভাই ওই সিংহীর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাকিয়ে তাকে বউ বানাতে চাইবে।
আমাদের সামনে যে সিংহ ভাইয়েরা হাঁটু মুড়ে বসেছিল তাদের ডাক শুনে এক সময়ে জঙ্গলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল এক সিংহী। একেবারে ওদের কাছে শুয়ে পড়ল। দুই ভাই উঠে দাঁড়াতে সিংহীটা এক লাফে উঠে দাঁড়াল। তারপরে ঢুকে গেল জঙ্গলের মধ্যে। দুই ভাই চলে গেল তার পিছে পিছে। এমন সময় বুক কাঁপানো এক হুঙ্কারে বুক কেঁপে উঠল। সিংহ ভাইয়েরা লাফ দিয়ে বেরিয়ে এল। সিংহীটা ছুটে গেল অন্য দিকে। থিও বললেন, “ওদের বাবা জানতে পেরেছে সব। তাই তার এই সতর্কবার্তা। এই একটা হাঁকেই কেমন কাজ হয়ে গেল দেখলেন তো?”
দুই দিন ধরে ঠান্ডার জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটি সিংহীদের পরিবার চোখে পড়েছে দ্বিতীয় দিন সকালেই। দলের মধ্যে একটি সিংহী অন্তঃসত্ত্বা। থিও বললেন, “আর কয়েক দিনের মধ্যেই ওর বাচ্চা হবে। এই অবস্থায় ওরা শিকার ধরার ধকল নিতে পারে না। তাই অন্যেরা শিকার করে প্রথমেই ওকে তা খাওয়ার জন্য ডাকে। অন্তঃসত্ত্বা সিংহী নিজের ভাগটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে এক দিকে নিয়ে যায়। তার পরে ভাগ নিয়ে অন্যেরা ঝগড়া করে। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা সিংহীকে কেউ গোলমালে জড়াতে দেয় না।” এ দিন যে সিংহীটি দুই ভাইয়ের আকর্ষণে ছুটে এসেছিল থিও-র অনুমান, সেটি ওই দলেরই।
কিন্তু পালের গোদাটি কোথায়? অতএব ওই সিংহের খোঁজে এ বার শুরু হল জঙ্গল সফর। বুকটা ধুক ধুক করছিল। এই বুঝি বাদামি শন গাছের ঝোপ থেকে লাফ মারে পশুরাজ। তার গায়ের রঙের সঙ্গে শনের জঙ্গল একেবারে মিশে গিয়েছে। আমাদের পক্ষে তার হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়। তবে আশ্বস্ত করলেন থিও, “ভয় পাবেন না। বাদামি ঘাসের জঙ্গলে ওর দেখা না পেলেও ওর গন্ধ আমাদের নাকে আসবেই। আমরা আগে থেকেই সতর্ক করে দেব।”
কিছুটা ঘোরাঘুরির পরে নাক টেনে কীসের গন্ধ নিলেন থিও। তার পরে কাঁটা গাছের ঝোপের মধ্যে দিয়েই চালিয়ে দিলেন গাড়ি। শুকিয়ে যাওয়া জলার মধ্যে এক বার গাড়ির চাকা আটকেও গেল। বুঝতে পারছিলাম না এত তাড়াহুড়োর কী দরকার ছিল। জঙ্গলের মধ্যে বন্যপ্রাণী দেখার সময় এমন কিছু করা যায় না যাতে জোর শব্দ হয়। বিনা শব্দেই আমাদের গাড়ি উঠে এল। আর তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমরা যেখানে পৌঁছে গেলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। রাস্তার ধারে শন ঘাসের উপরে শুয়ে আছে সে। দেখে মনে হচ্ছে কোনও সাড়-ই নেই পশুরাজের।
একটা গাড়িতে আমরা ১০ জন। পশুরাজকে দেখে সবাই উত্তেজিত। এক সঙ্গে অনেকগুলি ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক আওয়াজ। কিন্তু ওর কোনও হেলদোল নেই। পাশে এসে দাঁড়ালো আরও একটি গাড়ি। বুঝলাম এখানে যে পশুরাজ বিশ্রাম নিচ্ছেন সেই খবর পৌঁছে গিয়েছে জঙ্গলময়। চার দিক থেকে এত আওয়াজে শেষ পর্যন্ত আড় ভাঙল সিংহের। সে হঠাৎ করে উঠে বসল। বুকটা ধক করে উঠল। আর তখনই চোখে পড়ল তার পুরো চেহারাটা। বিশাল কেশর। জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটি। মনে হচ্ছে এই বোধ হয় ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে দেবে।
কিন্তু তা হল না। পশুরাজ আমাদের দিকে কিছু ক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তার পরে ফের শুয়ে পড়লেন ঘাসের উপরে। আমাদের প্রায় ৩০ জনের উপস্থিতিকে কোনও পাত্তাই না দিয়ে।
কলকাতার চিড়িয়াখানায় সিংহ দেখেছি। সিংহ দেখেছি গুজরাতের গির অরণ্যেও। সেগুলি কেমন রোগা রোগা। পশুরাজের চোখে রাগ রাগ ভাবটাই নেই। আওয়াজে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায় না। কিন্তু দুই ছেলেকে শাসন করার জন্য এই সিংহটির যে প্রবল গর্জন কিছু ক্ষণ আগে শুনেছিলাম তাতে আমরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। এই আওয়াজটা যে মুখ দিয়ে বেরিয়েছে তার আসল চেহারাটা দেখার বাসনা ছিল। ৫০ মিটারেরও কম দূরত্ব থেকে সেই আওয়াজের মালিককে দেখে মন ভরে গেল। সব গাড়ি থেকে একটাই আওয়াজ উঠল, ‘ম্যাজেস্টিক’।



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.