|
|
|
|
করিমনগরের কোটেশ্বর রাও ও মন্ত্রমুগ্ধ বাংলা মিডিয়া |
সুরবেক বিশ্বাস
|
মাটির কয়েকটি কুঁড়েঘর নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট গ্রামটির অবস্থান আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্স শহরের পশ্চিমে, প্রায় দু’শো কিলোমিটার দূরে। সেখানে ইসলামিক সালভেশন আর্মি-র একটি গোপন ডেরায় যখন গিয়ে পৌঁছলেন ইংরেজ সাংবাদিক ফিল রিজ, জঙ্গি সংগঠনটির স্থানীয় কমান্ডার তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এই বলে, “এই যে দেখ, আমরাই হলাম সন্ত্রাসবাদী। আচ্ছা, তোমার ভয় হচ্ছে না এটা ভেবে যে, একটু পরেই আমরা তোমাকে মেরে ফেলব?” ঘণ্টা কয়েকের খোলামেলা সাক্ষাৎকার শেষে অক্ষত দেহে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে রিজ সেই জঙ্গি নেতাকে জিগ্যেস করেছিলেন, “কই, তোমরা তো আমাকে খুন করলে না?” একটুও না-হেসে সন্ত্রাসবাদী নেতা জবাব দেন, “আমাদের রাজনৈতিক গুরুরা নির্দেশ দিয়েছিলেন, তোমার যাতে কিছু না-হয়। না-হলে তুমি বাঁচতে না।”
তাঁর ‘ডাইনিং উইথ দ্য টেররিস্টস’ গ্রন্থে কসোভো থেকে কাশ্মীর, আফগানিস্তান থেকে আলজিরিয়া, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকার ও কী ভাবে তিনি ওই সাক্ষাৎকার পেলেন, তার অসাধারণ ও রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা দিয়েছেন রিজ। তাঁর মতো সাংবাদিকের এহেন অভিজ্ঞতার পাশে আমাদের এই রাজ্যের সাংবাদিকতার তুলনা করাই বাতুলতা। কিন্তু জঙ্গি সংক্রান্ত খবর করার ক্ষেত্রে আমরা, মানে এই রাজ্যের সংবাদমাধ্যমও হঠাৎ করে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছি। কারণ, আমরা কিষেণজি নামে এক জনকে পেয়েছিলাম।
পঞ্চাশোর্ধ্ব সেই ব্যক্তি একটা সময়ে রোজ নিয়ম করে বিভিন্ন সাংবাদিককে নিজের মোবাইল থেকে ফোন করছেন, সাংবাদিকদের খবর দিচ্ছেন ও তাঁদের কাছ থেকে খবর নিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে গভীর জঙ্গলে সাংবাদিক বৈঠকও করছেন স্বয়ংক্রিয় রাইফেল কাঁধে নিয়ে, পুলিশ কিংবা আধাসামরিক বাহিনীর উপর মারণ আঘাত হানার কয়েক মিনিটের মধ্যেই টেলিভিশন চ্যানেলে লাইভ ‘ফোন ইন’ দিচ্ছেন, চ্যানেলের মাধ্যমেই কনফারেন্স কল-এ কথা বলে আশ্বস্ত করছেন অপহৃত পুলিশ অফিসারের বিপন্ন মা-কে— এমন অভিজ্ঞতা বিশ্বের সন্ত্রাসবাদের ইতিহাসেই বিরল।
২০০৯-এর মার্চ থেকে ২০১০-এর মার্চ (শালবনির হাতিলোটের জঙ্গলে সংঘর্ষের পরে আর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হননি কিষেণজি, ফোনেও যোগাযোগ রাখেননি), এই এক বছর সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যে-ভঙ্গিতে যোগাযোগ রেখেছিলেন মাওবাদীদের ওই পলিটব্যুরো সদস্য, তাতে মহারাষ্ট্র-দিল্লি-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তীসগঢ় কিংবা অসম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির তুলনায় এই রাজ্যের অনেকটাই নিস্তরঙ্গ ও ‘নিরামিষ’ সাংবাদিকতায় হঠাৎ করে এক তুমুল ঝাঁকুনি পড়েছিল। আসলে আমরা কেউ এমন অভিজ্ঞতার জন্য তৈরি ছিলাম না তো! এমনকী, যাঁদের দেখানো পথে কিষেণজিরা হেঁটেছেন, গত শতাব্দীর ছয় ও সাতের দশকের নকশালপন্থীরাও কিন্তু এমনটা করতে পারেননি। শহর ও শহরাঞ্চলে তাঁদের লাগাতার গুপ্তহত্যা, নকশাল দমন ও সেই দমনের নামে প্রশাসনের হাতে পাল্টা রাজনৈতিক শত্রুও নিধন এই সব মিলিয়ে তখন খবরের বাজার ফুটন্ত ছিল, এই যা। কিন্তু চারু মজুমদার-অসীম চট্টোপাধ্যায়রা মিডিয়া কভারেজ পাল্টে দিতে পারেননি। |
|
শেষ লড়াই। বুড়িশোলের জঙ্গলে।—ফাইল চিত্র। |
এমনিতে কী ছিল এখানকার তথাকথিত ক্রাইম রিপোর্টিং-এ? আদতে যা পুলিশ-রিপোর্টিং ছাড়া কিছুই নয়! কারণ, অপরাধ সংক্রান্ত খবরের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা অফিসারদের মুখ থেকেই আমরা বরাবর ঝাল খেতে অভ্যস্ত। অন্য পক্ষ, অর্থাৎ অভিযুক্তকে হয় বলতে দেওয়া হয় না, কিংবা সুযোগ থাকলেও সেই অন্য পক্ষ মুখে কুলুপ এঁটে থাকে।
অপরাধের খবর বলতে ছিল খুন, অপহরণ, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, জালিয়াতি। মাঝেমধ্যে টুকটাক আইএসআইয়ের খবর, উত্তরবঙ্গে কামতাপুরি জঙ্গিদের নাশকতার খবর। এমনকী, উত্তরবঙ্গের সেই কেএলও জঙ্গিরা আমাদের ভূমিপুত্র হলেও কখনও তাঁরা সামনা-সামনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হননি, ফোনও করেননি। আর মাঝে এক বার কেশপুর, আর এক বার নন্দীগ্রাম। যে-দু’টি মূলত দু’পক্ষের রাজনৈতিক সংঘর্ষ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
এই ধারা কিছুটা বদলাল ২০০১-এর জুলাই মাসে খাদিম-কর্তা পার্থ রায়বর্মনের অপহরণের পর, আরও ঠিক করে বললে খাদিম-কর্তার মুক্তিপণের টাকার বড় অংশ ৯/১১-র জঙ্গি হানার পাণ্ডা মহম্মদ আটার কাছে গিয়েছিল, তা জানার পর। কিন্তু খবরের ঘনঘটা শুরু আর কয়েক মাসের মধ্যেই, ২০০২-এর ২২ জানুয়ারি কলকাতায় আমেরিকান সেন্টারের সামনে জঙ্গি হানার কারণে। ওই একই দশকে জঙ্গলমহলে ধীরে ধীরে বাড়ছিল মাওবাদী নাশকতা। কিন্তু তখনও মাওবাদীরা মূলত তাদের গোপন ক্যুরিয়র বা বাহকের মাধ্যমে প্রেস বিবৃতি ছেড়ে সে সব ঘটনার দায় স্বীকার করত। লালগড় আন্দোলনের আগে কালেভদ্রে কলকাতার জনা কয়েক সাংবাদিককে মাওবাদীরা পুরুলিয়া কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে ডেকে নিয়ে গিয়ে দেখা করত, কিন্তু সেই নেতৃত্বের নাম লেখা বা সেই গোপন সাক্ষাৎকারের সবিস্তার বিবরণ লেখায় নিষেধাজ্ঞা ছিল।
লালগড় আন্দোলনের উত্তুঙ্গ-পর্ব থেকে এই রাজ্যের সংবাদমাধ্যমের এই ধরনের কাজের ধারাটাই বিলকুল পাল্টে গেল কিষেণজির সৌজন্যে। গামছা দিয়ে মুখের দু’ধার ঢেকে তিনি সাংবাদিক বৈঠক করছেন এবং সেই সময়ে সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমকে তাঁর ছবি নিতে হবে পিছন থেকে, যে-ছবির ফ্রেমে ধরা থাকবে তাঁর কাঁধে ঝোলা কালাশনিকভ রাইফেলের নল কিংবা বাট। পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া জগতে এক শিহরণ এল, সঞ্চারিত হল এক ভয়ঙ্কর-সুন্দর রোমান্টিসিজমের। তেলুগু টানে তাঁর জনগণ (কিষেণজি উচ্চারণ করতেন জ্যানগ্যণ) শব্দটি উচ্চারণের ভঙ্গি আমাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া প্রকাশ ঝায়ের ছবি ‘চক্রব্যূহ’-তে মাওবাদী কমান্ডার রাজনকে (ভূমিকায় মনোজ বাজপেয়ী) হুবহু দেখানো হয়েছে কিষেণজির আদলেই।
আসলে মিডিয়া গপগপিয়ে কী খেতে ভালবাসে, তা বিলক্ষণ বুঝতেন কিষেণজি। সাঁকরাইল থানা আক্রমণ, দু’জন পুলিশকর্মী খুন এবং ওসি-কে অপহরণ করার পর সাংবাদিককে ফোন করে সেই রুদ্ধশ্বাস অপারেশনের নাম জানালেন ‘অপারেশন গুডউইল’। অপহৃত ওসি অতীন দত্তকে রাতের অন্ধকারে লালগড়ের জঙ্গল ঘেরা গ্রামে সাংবাদিকদের হাতে সঁপে দিয়ে মুক্ত করার সময়ে তাঁর বুকে ঝুলিয়ে দিলেন ‘যুদ্ধবন্দি’ পোস্টার। গ্রিন হান্ট-এর বদলা হিসেবে শিলদার ইএফআর শিবিরে ভয়ঙ্কর আঘাত হেনে ২৪ জন জওয়ানকে হত্যা করে বললেন, “চিদম্বরম দেখুন, এটা আমাদের অপারেশন পিস হান্ট।”
গেরিলা যুদ্ধ ও তার এমন মারকাটারি প্রচারের স্বাদ পেয়ে উত্তেজনায় থর থর করে তখন কাঁপছে এই রাজ্যের গোটা সংবাদমাধ্যম জগৎ। সাংবাদিক ও চিত্র-সাংবাদিকদের শিরা-উপশিরা, রোমকূপে তখন বিদ্যুৎঝলক। সশস্ত্র বিপ্লব ও রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে এক যুদ্ধকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাচ্ছি আমরা। সব সময়ে প্রস্তুত থাকতে হচ্ছে, এই বুঝি জঙ্গলমহলে কোনও ঘটনা ঘটে যাবে আর কিষেণজি ফোন করে ডেকে নেবেন সাংবাদিকদের। তিনি যেন তখন হ্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালা, তাঁর মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট-এর অনবদ্য কৌশলে মোহাবিষ্ট আমরা পিল পিল করে তাঁর পিছনে সদা ধাবমান তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে, ‘বাইট’ সংগ্রহ করতে। অভূতপূর্ব ওই সব অভিজ্ঞতার অভিঘাতে তখন চুর চুর হয়ে ভেঙে যাচ্ছে আমাদের পেশার অতীতের যাবতীয় জাড্য, পেশাগত রীতিনীতি, ধ্যানধারণা। সাধারণত রিপোর্টারদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী, শীর্ষ আমলা, শীর্ষ পুলিশকর্তাদের সঙ্গে যার যোগাযোগ বেশি, তার কদরও অফিসে বেশি হয়। কিন্তু সেই সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্টারের দক্ষতার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াল, কিষেণজি কার ফোন একবারে ধরেন কিংবা কাকে তিনি নিয়মিত ফোন করেন।
এ সবের পাকাপাকি অবসান গত বছরের ২৪ নভেম্বর বুড়িশোলের জঙ্গলে। পর দিন সকালে উইঢিপির পাশে পড়ে থাকা বিপ্লবী নেতার চাপ চাপ রক্ত তখন মাছির খাদ্য।
অন্য কয়েকশো মানুষের রক্ত ঝরানো কিষেণজির সেই খতমের রাজনীতির মূল্যায়ণ ভাবীকাল করবে, হয়তো মানুষ ইতিমধ্যে কিছুটা করেও ফেলেছেন। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশের করিমনগর জেলার কোটেশ্বর রাও নামে এক জন নেহাতই রাজনীতির খাতিরে এই রাজ্যে বছরের পর বছর ঘাঁটি গেড়ে থেকে শেষমেশ এখানকার মিডিয়াকে এক ঝটকায় কিছুটা পরিণত ও সাবালকও করে দিলেন না কি? হয়তো সে জন্যই ভবিষ্যতের আরও কঠিন কোনও দিনের জন্য তৈরি হয়ে রইলাম আমরা। ইচ্ছাকৃত হোক কিংবা অনিচ্ছাকৃত, ব্যক্তি স্বার্থে হোক কিংবা ‘জ্যানগ্যণের’ কল্যাণে, কিষেণজির অবদান এ ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য।
|
|
|
|
|
|