কিষেণজি নেই, হিংসাও না
জঙ্গলমহলে তবু মাওবাদী
য়তো কাকতালীয়। কিন্তু অদ্ভুত সমাপতন। দিল্লিতে দেশের তাবৎ শীর্ষ পুলিশকর্তাদের তিন দিন ব্যাপী বার্ষিক সম্মেলনের শেষ দিন, শনিবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সাফল্য পাওয়ার জন্য পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও আধা সামরিক বাহিনীকে বাহবা দিয়েছেন। আর তার পরের দিন আজ, রবিবার-ই মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজির মৃত্যুর দু’বছর পূর্তি।
যৌথবাহিনীর হাতে কিষেণজি মারা যান এই রাজ্যেই। সংগঠনের শীর্ষনেতার মৃত্যুদিনকে স্মরণে রেখে ‘শহিদ সপ্তাহ’ পালনের উদ্দেশ্যে শুক্রবার রাতেও বেলপাহাড়ির ঘাগরা এলাকায় মাওবাদীদের একটি স্কোয়াড ঝাড়খণ্ডের দিক থেকে ঢুকেছে বলে গোয়েন্দারা জেনেছেন।
২০১১-র ২৪ নভেম্বর শরীরে খান তিরিশেক ক্ষত (বুলেট ও ধারালো অস্ত্র মিলিয়ে) ও দু’পায়ে একাধিক পোড়া চিহ্ন সমেত কিষেণজির দেহ ঝাড়গ্রামের কাছে বুড়িশোল জঙ্গলের উইঢিপির পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। তার পর হঠাৎই ঝপ করে পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী হিংসার ঘটনা যে কমে গেল, সেটা সরকারি নথিই বলছে। ২০১১-তেও মাওবাদীদের হাতে জঙ্গলমহলে ৩৮ জন সাধারণ মানুষ ও দু’জন নিরাপত্তারক্ষী খুন হয়েছিলেন। কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেণজি-সহ নিহত মাওবাদীদের সংখ্যা সে বছর ছিল পাঁচ। ২০১২ ও ২০১৩-র এখনও পর্যন্ত মাওবাদীদের হাতে জঙ্গলমহলে সাধারণ মানুষ কিংবা নিরাপত্তারক্ষী কারও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
কিষেণজির মৃত্যু কি তা হলে সত্যিই জঙ্গলমহলকে বদলে দিল?
রাজ্য পুলিশের এক আইজি-র বক্তব্য, “জঙ্গলমহলে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। পুলিশ তথা যৌথবাহিনী যত্রতত্র ঘোরাফেরা করতে পারছে। কিন্তু কিষেণজি মারা না গেলে আমরা এই অবাধ যাতায়াত করার সাহসই পেতাম না। কিষেণজি এখন থাকলে ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ারেরাও কাজ করতে ভয় পেত।”
কী রকম ছিল সেই ভয়ের স্বরূপ?
কিষেণজির ‘আমলে’, ২০১০ সালে মাওবাদীদের হাতে জঙ্গলমহলে ২২৫ জন সাধারণ মানুষ ও ৩৫ জন নিরাপত্তারক্ষী খুন হন। নিহত মানুষের সংখ্যার নিরিখে এই রাজ্যে মাওবাদী হিংসা চরমে পৌঁছেছিল সে বছরই। তা ছাড়া, সে বছর মাওবাদীরা জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত করায় মারা যান আরও প্রায় দেড়শো মানুষ। সম্প্রতি প্রকাশিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা দেশে এ যাবৎ মাওবাদীদের হাতে সব চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ খুন হন ওই ২০১০ সালেই। সংখ্যাটা ৭২০। এর মধ্যে রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের অবদানই ছিল সব চেয়ে বেশি।
সেই তুলনায় জঙ্গলমহলে এখন হিংসার কোনও ঘটনাই নেই। তা ছাড়া, কথায় কথায় বন্ধ নেই, অবরোধ নেই, মাওবাদী পোস্টার নেই। মাওবাদীরা বন্ধ ডাকলেও কার্যত সাড়াই দেন না জঙ্গলমহলের মানুষ। মাস পাঁচেক আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন।
কিন্তু রাজ্য গোয়েন্দা শাখার (আইবি) এক শীর্ষকর্তা সতর্ক করে দিচ্ছেন, “জঙ্গলমহল এখন শান্ত আর মাওবাদীরা পুরোপুরি শেষ হয়ে গিয়েছে--দু’টো কিন্তু এক জিনিস নয়। মাত্র তিন বছর আগেও এই সময়ে জঙ্গলমহলের গ্রামের পর গ্রাম মাওবাদীদের নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে যাওয়ার নয়। জঙ্গলমহলে এখনও মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মানুষের অভাব নেই।” রাজ্য পুলিশের এক কর্তা স্বীকার করে নিচ্ছেন, “কিষেণজি মারা যাওয়ার পর দু’বছর কেটে গেলেও বিকাশ, আকাশ, রঞ্জিৎ পাল, মদন মাহাতো, জয়ন্ত, শ্যামল মাহাতো, তারা, জবার মতো এ রাজ্যের অ্যাকশন স্কোয়াডের নেতা-নেত্রীদের গ্রেফতার না করতে পারাটা অদূর ভবিষ্যতে যে কোনও সময়ে বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।”
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংহভূম জেলা লাগোয়া বেলপাহাড়ির জামাইমারি, শাঁকাভাঙা ও পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে ওই মাওবাদী নেতা-নেত্রীরা নিয়মিত আনাগোনা করছে। শুধু তা-ই নয়, জঙ্গলমহলের কোনও কোনও তল্লাটে আদিবাসী মেলায় গিয়ে সেখানে যোগ দেওয়া মানুষের মধ্যে সংগঠনের আদর্শ সুকৌশলে পার্টির নাম না করে ছড়ানোরও চেষ্টা করছে তারা।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদমণ্ডলীর সদস্য ও বাঁকুড়ায় পার্টির জেলা সম্পাদক অমিয় পাত্র বলেন, “কিষেণজি মারা যাওয়ার পর জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা কোণঠাসা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের পার্টি তো উঠে যায়নি। উপস্থিতি তেমন ভাবে জানান না দিয়েও মাওবাদীরা ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা জঙ্গলমহলের এলাকাগুলিতে ক্যাডার নিয়োগের কাজে নেমেছে।” সিপিএমের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক প্রবীণ সদস্যের কথায়, “ঝাড়গ্রাম, জামবনি, বেলপাহাড়ি থেকে বেকার যুবকদের একাংশকে ঝাড়খণ্ডে নিয়ে গিয়ে মগজধোলাই করছে মাওবাদীরা। হয়তো অস্ত্র প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়ার নাম করে ওই যুবকেরা বাড়ি থেকে বেরোচ্ছে।”
কেন এই রাজ্যে মাওবাদী কার্যকলাপ পুরোপুরি শেষ হচ্ছে না?
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাসংস্থার এক অফিসারের মতে, পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী ভাবে মাওবাদী সমস্যার সমাধান হওয়া মুশকিল। তার কারণ, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার মতো দুই প্রতিবেশী রাজ্য। যেখানে মাওবাদীরা অনেকটাই শক্তিশালী। ওই দু’টি রাজ্য থেকে স্কোয়াড এনে এই রাজ্যে নাশকতা ঘটানো মাওবাদীদের পক্ষে সমস্যার নয় বলে মনে করেন তিনি। তাঁর কথায়, “পশ্চিমবঙ্গকে পুরোপুরি বাদ রেখে মাওবাদী কার্যকলাপ হওয়া মুশকিল। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থানই এর মূল কারণ। মাওবাদীরা নেপালের পশুপতি থেকে দক্ষিণ ভারতের তিরুপতি পর্যন্ত যে রেড করিডর তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে, তার মধ্যে অবধারিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গ পড়ে যাচ্ছে। এই রাজ্যকে তারা বাদ দেবে কী ভাবে?”
শাসকদল তৃণমূলের এক সাংসদও মনে করেন, “মাওবাদীরা যে দিন চাইবে, সে দিনই নাশকতা ঘটাতে পারে। আসলে আমাদের সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য এই মুহূর্তে জনসমর্থন ওদের দিকে তেমন নেই বলে ওরা কিছুটা ইতস্তত করছে।”
পুলিশের বক্তব্য, মাওবাদীরা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। এখন জঙ্গলমহলে প্রায় ৪২০০ কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান ও ১০০০ রাজ্য পুলিশ রয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তারক্ষী, বিশেষত কেন্দ্রীয় বাহিনী কোনও কারণে সরানো হলে সেই সুযোগ নিয়ে বড়সড় আঘাত হানতে পারে মাওবাদীরা।
রাজ্য পুলিশের এক আইজি-র কথায়, “আমরা মাওবাদী সমস্যাকে ঠেকিয়ে রেখেছি মাত্র। যেমন ভাবে ওষুধ দিয়ে কিছু রোগকে সাময়িক চাপা দেওয়া হয়। কিন্তু মাওবাদী সমস্যা পুরোপুরি নিরাময় হয়নি। কিষেণজির মৃত্যুর দু’বছর পরেও না।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.