ঘুমের মধ্যে জোরে চিৎকার শুরু করে দিল চিঙ্কি। চিঙ্কিকে চেনো না তোমরা? যে চিঙ্কির মাথায় ভূত চেপেছে সে পৃথিবীটাকে উদ্ধার করেই ছাড়বে!
যা-ই হোক, ওর চিৎকার শুনে মা-বাবা ছুটে এলেন। ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে তুলতে চোখ কচলে চিঙ্কি বলল, ‘উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরুর সব বরফ গলে গিয়েছে! সারা পৃথিবী ভেসে যাচ্ছে। কলকাতা জলের তলায় ডুবে যাচ্ছে! সেই জল আমাদের বাড়িতে ঢুকেছিল। উফ্, কী ভীষণ ঠান্ডা সেই জল!
মা শুনে বললেন, ‘সব সময় ওই সব ভেবে ভেবে মেয়েটার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!’ ওর দাদা ওকে ভালবেসে ‘জল পুলিশ’ বলে ডাকে, কারণ কাজের মাসি কল খুলে বাসন ধুলেই চিঙ্কি ছুটে গিয়ে কল বন্ধ করে দেয়!
মাসি হাঁ হাঁ করে বলে, ‘কল বন্ধ করে দিলে বাসন ধোবো কী করে?’ চিঙ্কির উত্তর, ‘না, মোটেই জল নষ্ট করা চলবে না!’ বাবা দাড়ি কাটতে গিয়ে কল খোলা রাখলে বাবারও ওই একই দুর্দশা! দাঁত মাজার সময়ও কারও কল খুলে রাখা চলবে না! কেউ যদি ভুল করে ঘরে আলো পাখা জ্বালিয়ে বেরিয়ে যায় তা হলে আর রক্ষে নেই। চিঙ্কি চেঁচিয়ে পাড়া মাত করবে!
ওর তাড়নায় এখন বাবাকে মেট্রো করে অফিস যেতে হয়। পেট্রল নাকি পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ বছর লাগে এই এতটুকু পেট্রল তৈরি হতে। তা ছাড়া পেট্রল পুড়লে যে সব ধোঁয়া বা গ্যাস বেরোয় সেগুলো দিয়ে দূষণ ছড়ায়। প্রথম প্রথম বাবা একটু গাঁইগুঁই করেছিলেন, অনেক সময় লাগে ইত্যাদি বলে। তবে এখন অবশ্য বলেন মেট্রো করে যাতায়াত করে ভালই হচ্ছে, গাড়ি চড়ে চড়ে নাকি ভুঁড়ি বেড়ে যাচ্ছিল।
পাশের বাড়ির বোসদাদু বাগানের একটা গাছ কাটাবার জন্যে লোক ডেকেছিলেন। খবর পেয়েই চিঙ্কি সেখানে গিয়ে হাজির। সে গাছটায় উঠে বসে রইল। লোকগুলো যত বলে, ‘খুকি নেমে এসো আমরা গাছ কাটব,’ চিঙ্কির কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বলল, ‘তোমরা কুড়ুল চালালেই আমি পুলিশে খবর দেব!’
লোকগুলো কী করবে বুঝতে না পেরে শেষে বোসদাদুকে ডেকে নিয়ে এল। দাদুকে দেখেই চিঙ্কি বলল, ‘দাদু আপনি গাছ কাটাতে চান কেন? জানেন না গাছের জন্যেই আমরা বেঁচে আছি? গাছ যদি কার্বন ডাই অক্সাইডগুলোকে অক্সিজেন না করে দিত, তা হলে আমাদের বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেন থাকতই না, আমরা সবাই মরে ভূত হয়ে যেতাম। সেই রকম উপকারী এক বন্ধুকে কেটে ফেলে দিতে আপনার লজ্জা করে না?’
দাদু মাথা চুলকালেন, ‘কিন্তু বড্ড পাতা পড়ে যে! পাতা পড়ে পড়ে নর্দমা আটকে যাচ্ছে! আমি বুড়ো হয়েছি আমার পাতা তুলতে কষ্ট হয়।’
‘ও এই ব্যাপার। গাছ থাকলে পাতা তো পড়বেই। আমাকে বলবেন, আমি আর সুমি এসে পাতা পরিষ্কার করে দিয়ে যাব।’ সেই করে গাছ কাটা থামানো হল। |
চিঙ্কির মামার চেনা এক ভদ্রলোক মিস্টার ট্যাননের একটা খামারবাড়ি আছে। তাই মামার পরিবার আর মামার অফিসের ক’জন মিলে ঠিক করল ওখানে বেড়াতে যাবে। তখন ডিসেম্বর মাস বলে স্কুলের ছুটি, তাই চিঙ্কিরাও চলল সঙ্গে। মামাতো দিদি মোমের সঙ্গে খুব ভাব চিঙ্কির।
ওরা যখন খামারবাড়িতে পৌঁছল তখন সকাল দশটা। মিস্টার ট্যানন প্রথমে বলেছিলেন উনিও আসবেন, কিন্তু তার পর কী একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় আসতে পারেননি, কিন্তু কেয়ারটেকার বাবু রাওকে সব বলে রেখেছিলেন। ঢুকতে গিয়ে দেখা গেল গেটের বাইরে কিছু লোক আর মহিলা প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাতে লেখা রয়েছে ‘রূপসা নদীকে বাঁচাও’ ইত্যাদি।
বাড়িটা খুব সুন্দর সাজানো। বাইরের ঘরে একটা গোটা দেওয়াল জুড়ে বিশাল একটা অ্যাকোয়ারিয়াম, তাতে রকমারি সব রঙিন মাছ।
মামার বন্ধু তমালকাকুর অ্যাকোয়ারিয়াম আছে। উনি দেখে বললেন, ‘বাবা, এত বড় অ্যাকোয়ারিয়ামটাকে পরিষ্কার করতে তো মনে হচ্ছে ডুবুরি নামাতে হয়!’
কেয়ারটেকার বাবু রাও ওদের একটা লম্বা মই দেখাল যেটাতে করে উঠে রোজ মাছদের খেতে দেয় সে। পরিষ্কার করতে বলল কোম্পানির লোক আসে।
ঠিক হল দিনেরবেলাটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়া হবে। এ দিকে চিঙ্কির মাথায় তো অন্য ফন্দি ঘুরছে। সে বাবু রাওকে গিয়ে ধরল, ‘চাচাজি, বাইরে ওই সব লোকজন হল্লা করছে কেন?’
বাবু রাও মুখ ভেংচে বলল, ‘আরে ওরা সব পাগল লোকের দল! মিছিমিছি সাহেবের পিছনে লেগেছে।’
‘ও আচ্ছা!’ বলল বটে চিঙ্কি কিন্তু ওর মন শান্ত হল না। সে গেটের বাইরে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের কাছে গিয়ে হাজির হল মোমদিদিকে নিয়ে। ‘আপনারা এখানে প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করছেন কেন? কী হয়েছে রূপসা নদীর?’
ওদের মধ্যে এক জন বলল,‘মিস্টার ট্যানন রূপসা নদীর ধারে একটা কারখানা খুলেছেন। সেই কারখানার যত হাবিজাবি আবর্জনা সব নদীতে ফেলা হচ্ছে! মেশিনের তেল, পেট্রল, গাছের সার, পোকা মারার ওষুধ, সাবান জল, লোহালক্কড় আরও যে কত কী! নদীর সব মাছ মরে যাচ্ছে! ওই নদীর ধারে কিছু জেলে পরিবার আছে, যাদের পেট চলে মাছ ধরে, তাদের এখন মাথায় হাত! তাই, কিছু লোক এখানে আর কিছু কারখানার সামনে প্রতিবাদ করছি!
চিঙ্কি শুনে বলল, ‘ও এই ব্যাপার! ঠিক আছে!’
কিছুক্ষণ পর মি. ট্যাননকে বাবু রাও ফোন করলেন, ‘এক্ষুনি আসুন। সর্বনাশ হয়ে গেল!’
কেন কী হয়েছে?
আপনার অ্যাকোয়ারিয়াম নষ্ট করে ফেলছে! ওই যাদের আপনি এখানে থাকতে পাঠিয়েছেন, তারা!
মিস্টার ট্যানন কোথায় ছিলেন কে জানে, কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে খামারবাড়িতে এসে হাজির হলেন। ততক্ষণে অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের রং কালচে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে, মাছগুলো সব মরে ভাসছে। মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে চিঙ্কি আর নীচে প্ল্যাকার্ড ধরা বড়রা!
ভীষণ রাগে ফেটে পড়লেন মিস্টার ট্যানন, ‘ছি ছি মিস্টার গুপ্ত! আমি আপনাকে ছুটি কাটাবার জন্যে আমার বাড়ি দিলাম আর আপনি এ কী করলেন? লক্ষ লক্ষ টাকার দামি মাছ ছিল ওখানে! তার খেসারত কে দেবে? আর বাবু রাও কোথায়? বাবু রাও?
‘বাবু রাও বড্ড বিরক্ত করছিল, তাই ওকে আমাদের বেঁধে রাখতে হয়েছে’, চিঙ্কি উত্তর দিল।
‘আমি এখন পুলিশ ডাকছি।’ মিস্টার ট্যানন বলল।
‘ডাকুন, পুলিশ ডাকুন, আমরাও ডেকেছি! এখানকার এম এল এ আর এম পি এই এলেন বলে! আমরাও বলব আপনি রূপসা নদীকে এই রকম কালো করে ফেলেছেন। এখানে তো মোটে কয়েকটা মাছ, ওখানে নদীতে হাজার হাজার মাছ মরছে, তার খেসারত কে দেবে? আপনি দেবেন? না দিতে পারলে কিন্তু আপনার কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে!’ প্রতিবাদীদের এক জন বলল।
মিস্টার ট্যানন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
চিঙ্কি বলল, ‘তাও তো ঠিক জিনিসগুলো ছিল না, তাই অন্য জিনিস ব্যবহার করতে হয়েছে। মেশিনের তেল, রাসায়নিক দ্রব্য, সার আর পেট্রলের বদলে আমরা নুন, লঙ্কা, গোলমরিচ আর হলুদ ঢেলেছি। লোহালক্কড় নোংরার বদলে কাগজের কুঁচি ফেলা হয়েছে। শুধু সাবান জলটা একই রাখা হয়েছে। তবে কিনা ফল একই রকম হয়েছে! কালো বিশ্রী জলে সব মাছ মরে গিয়েছে!’
গল্পটা স্কুলের বন্ধুদের বলছিল চিঙ্কি। সব শুনে ওরা বলল, ‘এ মা, তা হলে তো তোরা ওই সব ভাল ভাল মাছগুলোকে মেরে ফেললি! তোরাও তো তা হলে মিস্টার ট্যাননের মতনই কাজ করলি! ওঁকে শিক্ষা দিতে মিছি মিছি নির্দোষ মাছগুলোকে মারলি!’
চিঙ্কি মুচকি হাসল, ‘আমরা মাছ মারিনি! তমালকাকু বড় নেট দিয়ে মাছগুলোকে ধরে বাথটবে জল ভরে রেখেছিলেন। সেই জন্যেই তো বাবু রাওয়ের মুখ বেঁধে রাখতে হয়েছিল, যাতে ও কিছু না বলে। ট্যাঙ্কের মধ্যে ভাসছিল এক রাশ প্লাস্টিকের মাছ! সেগুলো ওই প্রতিবাদীদেরই এক জন কিনে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু জলটা এতটাই কালো আর নোংরা হয়েছিল যে, আসল মাছ না নকল মাছ বোঝাই যাচ্ছিল না! ওখানকার এম এল এ, এম পিকে মিস্টার ট্যানন লিখে দিয়েছেন যে, তিনি রূপসা নদীকে তার আগের রূপে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন! মোক্ষম শিক্ষা হয়ে গিয়েছে ওঁর!
|