গানটা রাজেশ খন্নার ‘লিপে’ ছিল ঠিকই। কিন্তু টয়ট্রেনে বসে থাকা শর্মিলা ঠাকুরের কানে আগে ভেসে এসেছিল হারমোনিকার ডাক। জিপের স্টিয়ারিংয়ে নায়কের বন্ধুর হাতে ঝকমক করছে কালোপানা খুদে ধাতব যন্ত্র। ‘আরাধনা’-র ‘মেরে সপ্নো কি রানি’র- ইন্টারল্যুডে সে বেজে না-উঠলে গানের মেজাজটা যেন জমতই না।
কিংবা শোলে-র সেই কালজয়ী দৃশ্য। জয়া ভাদুড়ি ঘুরে-ঘুরে প্রকাণ্ড বাড়িটায় লণ্ঠন নেভাচ্ছেন। ঈষৎ আড়চোখে সে-দিকে তাকিয়ে হারমোনিকায় ঠোঁট ছোঁয়ালেন অমিতাভ বচ্চন। রাতের নৈঃশব্দ্য চিরে হারমোনিকার আকুতিই তখন একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।
বলিউডের পর্দায় এই হারমোনিকা বা মাউথঅর্গ্যান-প্রীতির নেপথ্যে উজ্জ্বল ভূমিকা বাংলার। রাহুল দেব বর্মণ স্বয়ং তাঁর নিজের ও শচীন দেব বর্মণের সুর দেওয়া কিছু গানে হারমোনিকায় ফুঁ দিয়েছেন। কারও কারও মতে, শোলে-র হারমোনিকার দৃশ্যটিতে বাজিয়েছিলেন বাংলারই আর এক নামী শিল্পী ভানু গুপ্ত।
গোটা দেশে হারমোনিকাকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে অবশ্য আর এক বঙ্গসন্তানের নাম ইতিহাসে লেখা। তিনি মিলন গুপ্ত। জনৈক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুর সূত্র ধরে তাঁর হাতে এসেছিল জার্মানির হনার সংস্থার এক জোড়া ক্রোম্যাটিক হারমোনিকা। মিলন দেখলেন, যে কোনও গানের সুর ধরে ফেলতে যন্ত্রটির জুড়ি নেই। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে কলকাতার এক তরুণের কাছে জীবনের মানেটাই পাল্টে দিয়েছিল যন্ত্রটা। মিলনের প্রয়াণের দু’দশক বাদে এ বার তাঁকে সামনে রেখেই জোট বাঁধছেন সারা দেশের হারমোনিকা-পাগলেরা।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘হ্যায় অপনা দিল’-এর হারমোনিকা অংশটুকু মিলনবাবুরই কীর্তি। শোনা যায়, ওপি নাইয়ার, মজরুহ সুলতানপুরীদের সঙ্গে আড্ডায় কলকাত্তাইয়া মিলনবাবুর দৌলতেই ‘ইয়ে হ্যায় বম্বে মেরে জান’ গানটিরও জন্ম। আমেরিকায় উনিশ শতকের জনপ্রিয় গান, ‘ওহ্ মাই ডার্লিং ক্লেমেন্টাইন’-এর সুর হারমোনিকায় বাজাচ্ছিলেন মিলন। তা শুনতে শুনতেই ঝটপট ‘ইয়ে হ্যায় বম্বে’-র কথা বসিয়ে ফেলেন মজরুহসাহেব।
আজকের ফিল্মি গানায় ইলেকট্রনিক মিউজিকের রমরমার দিনে অনেকটাই ব্রাত্য খুদে যন্ত্রটি। একটা সময়ে যে কোনও গানের সুর তুলতে হারমোনিকার দ্বারস্থ হতেন সঙ্গীতপ্রেমীরা। এখন সান্ধ্য জলসাতেও প্রায় দেখা নেই তার। |
মিলন গুপ্তের স্মরণ অনুষ্ঠানে হারমোনিকা বাজাচ্ছেন কাজল চক্রবর্তী।—নিজস্ব চিত্র। |
সেই হারিয়ে যাওয়া সুরের খোঁজেই শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, প্রয়াত মিলনবাবুর ৮১তম জন্মদিনে কলকাতার সঙ্গেই মেতেছিল হায়দরাবাদ ও পুণে। মিলনবাবুর সাক্ষাৎ ছাত্র ও সহশিল্পী কাজল চক্রবর্তী বা অনুপম পালদের মতোই হারমোনিকা-প্রেমী হায়দরাবাদের ওষুধ কোম্পানির কর্মী রামানা কোমানাপল্লি বা পুণের দীপক পাটিল। রামানার কথায়, “হারমোনিকা খায় না মাথায় দেয় জানার আগেই অল ইন্ডিয়া রেডিওয় মিলন গুপ্তের অনুষ্ঠান নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল।” এখন হায়দরাবাদে নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত তাঁরা। সেখানে ইন্দিরা পার্কেও প্রতি রবিবার হারমোনিকায় তালিম দেন।
কলকাতায় হারমোনিকা-আবেগ উস্কে দেওয়ার পিছনেও শুধু বাঙালিরা নেই। মিলনবাবুর জন্মদিনে ‘ইন্ডিয়ান হারমোনিকা ডে’ উদ্যাপনে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন বাদ্যযন্ত্র বিপণী রেনল্ড্স মিউজিক ইন্ডিয়া-র কর্তারা এগিয়ে এসেছেন। জ্ঞানমঞ্চের অনুষ্ঠানে অজস্র চেনা গানের সুরে ঝড় তুলেছেন শহরের নবীন-প্রবীণ হারমোনিকা-শিল্পীরা। আগে নিউ মার্কেট-পাড়ার দোকানগুলোয় বিশ্বমানের হারমোনিকা মিলত। মাঝে কিছু দিন তা পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছু চিনে যন্ত্র দিয়েই কাজ চালানো হচ্ছিল। এখন জার্মানির হনারের ক্রোম্যাটিক হারমোনিকা ফের হাজির কলকাতায়। তবু প্রশ্ন দানা বাঁধছে, হারমোনিকার সেই সুদিন এ শহরে কি ফিরবে?
অনুষ্ঠানের সংগঠক হিসেবে পরিচিত তোচন ঘোষ খুব আশাবাদী নন। আলাদা করে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের চলটাই যে ধাক্কা খেয়েছে। তোচনবাবুর আক্ষেপ, পিয়ানোয় ভি বালসারা বা বাঁশির হিমাংশু বিশ্বাসের মতো শিল্পীরা কই? এখন বড়জোর শ্রেয়া ঘোষালরা গান শুরু করার আগে তাঁর সহশিল্পীরা একসঙ্গে কোনও সুর বাজিয়ে নেন। আগে গিটার নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বটুক নন্দীদের মতোই মিলন গুপ্তর নেতৃত্বেও থাকত হারমোনিকা-র আইটেম।
বাংলায় হারমোনিকার এই জনপ্রিয়তার নেপথ্যে বাংলা ছবির ভূমিকাও ভোলার নয়। লালু-ভুলুর কথায় আজকের ষাটোর্ধ্বরা অনেকেই নস্ট্যালজিয়ায় আক্রান্ত হবেন। প্রতিবন্ধী দুই বন্ধু, মাস্টার সুখেন ও মাস্টার পরেশের একজন গাইতেন, আর একজন হারমোনিকা বাজাতেন। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘সূর্য তোমার সোনার তোরণ খোল’-এর ভোরের আবাহন বা ‘প্রাণ ঝর্না জাগল’-র উচ্ছলতায় অঙ্গাঙ্গী হারমোনিকা। বাজিয়েছিলেন, সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের ভাই পরিমল দাশগুপ্ত।
গত শতকের শেষ থেকে গানের অনুষঙ্গে হারমোনিকাকে বিশিষ্ট মর্যাদা দিয়েছেন কবীর সুমন। তাঁর অনুষ্ঠানে গলায় আঁটা ক্যারিয়ারে রাখা ব্লুজ হার্পে মাঝেমধ্যেই ফুঁ দিতেন সুমন। মজা করে ডাকতেন খুড়োর কল বলে। কিন্তু হারমোনিকা ও অন্য যন্ত্রসঙ্গীতের চর্চা এ কালের অনুষ্ঠানে কমে গেল কেন? সুমনের ব্যাখ্যা, “আগে সঙ্গীতের মধ্যে একটা সামাজিক চরিত্র ছিল। যন্ত্রশিল্পীরা এক সঙ্গে জড়ো হতেন। শিল্পীদের মধ্যে বিনিময়ের জায়গা ছিল। এখন সেটা কমে আসছে। হারমোনিকা-চর্চাও তাই ধাক্কা খাচ্ছে।”
কিন্তু সহজেই হিপ পকেটে পুরে ফেলা যায় এমন হারমোনিকা তো একলা মানুষেরও সঙ্গী। সুমনের লিরিকেই উঠে এসেছে, ‘বাঁশী নেই আছে মাউথঅর্গ্যান, এ কালের শ্যাম একলা বাজান’। হারমোনিকা ডে-র অনুষ্ঠানের শরিক তরুণ হারমোনিকা-শিল্পী সুমন্ত বসুও মনে করেন, ইন্টারনেটের যুগে কিন্তু হারমোনিকা-চর্চারও নতুন দিক খুলে যাচ্ছে। অনেকেই হারমোনিকা পরিবেশনের টুকরোর ভিডিও তুলে ইউ টিউবে ছেড়ে দিচ্ছেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন শহরের হারমোনিকা-প্রেমীদের যোগাযোগ বাড়ছে।
অনুপম পালেদের চেষ্টায় পর পর দু’বছর কলকাতা, দিল্লিতে হারমোনিকা-শিল্পীরা জড়ো হয়েছেন। হারমোনিকায় তালিমের নোট্স বিনিময় করেছেন সক্কলে। সঙ্গীতশিক্ষার স্কুল বাণীচক্রর হারমোনিকা শিক্ষক সুকান্ত ঘোষালের দাবি, নেটের মাধ্যমে খোঁজখবর করেও অনেকে শিখতে আসছেন। রেনল্ডস্-কর্তা পিটার রিবেইরোরও ঘোষণা, ডিসেম্বরেই শহরে নতুন হারমোনিকা স্কুল চালু করছেন তাঁরা। শহরের স্কুলগুলোতেও সে খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র বা নীল দত্তও হারমোনিকাকে নিয়ে হাল ছাড়তে রাজি নন। সুমন-অঞ্জন দত্তদের গানের মতোই দেবজ্যোতি-র ‘মেঘপিওনের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা’ বা নীলের ‘চলো লেট্স গো’-র সুরে হারমোনিকা মিশেছে। দেবজ্যোতির কথায়, “যতই ইলেকট্রনিক কি বোর্ড থাকুক, কিছু ক্ষেত্রে হারমোনিকা এখনও অমোঘ।” আর নীল বলছেন, “আজকের কলেজপড়ুয়ারা অনেকেই কিন্তু ফিউশন, কান্ট্রি, ব্লুজ, ফোকের ঘরানায় ঝুঁকছেন। আমি নিশ্চিত, তাদের হাত ধরেই হারমোনিকাও ফিরে আসছে।”
সে-যুগের পকেটে হারমোনিকা-রাখা প্রেমিকটিও হয়তো এ বার বলে উঠবে, আবার সে এসেছে ফিরিয়া!
|
নির্বাচিত ‘কুশ’
সংবাদ সংস্থা • লস অ্যাঞ্জেলস |
ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের মাথায় নতুন পালক। ‘শর্ট ফিল্মস অ্যান্ড ফিচার অ্যানিমেশন ব্রাঞ্চ’-এর সদস্যরা অস্কারে মনোনয়নের জন্য যে ১০টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি বেছে নিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ছবি ‘কুশ’ও। ১০টি ছবির মধ্যে তিনটি বা পাঁচটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি অস্কারের জন্য মনোনীত করা হবে। ‘কুশ’ ছবিটির পরিচালক শুভাশিস ভুটিয়ানি। প্রযোজনা করেছেন শুভাশিসের বাবা সঞ্জয় ভুটিয়ানির সংস্থা রেড কার্পেট মুভিং পিকচার্স। ২৫ মিনিটের ছবিটি ১৯৮৪-র শিখ দাঙ্গার উপর নির্মিত। ছবির গল্প এগোয় একটি স্কুল পিকনিককে কেন্দ্র করে, যেখানে এক শিক্ষক কুশ নামে এক মাত্র শিখ বাচ্চাকে হিংসার হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। নিউ ইয়র্ক’স স্কুল অফ ভিজুয়াল আর্ট-এ স্নাতক পড়ার সময় পাঠ্যক্রমের অঙ্গ হিসেবে ছবিটি বানান শুভাশিস। তাঁর বাবা সঞ্জয় বলেন, “ছবিটি বেশ কিছু চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে। বেশ ভাল সাড়াও পাওয়া গিয়েছে।” ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও জিতে নিয়েছে ‘কুশ’। ডিসেম্বরে ‘শর্ট ফিল্মস অ্যান্ড ফিচার অ্যানিমেশন ব্রাঞ্চ’-এর রিভিউ কমিটি ছবিগুলি দেখবেন। তার পর অস্কারে মনোনয়নের জন্য হবে ভোটাভুটি। এখন শুধুই প্রতীক্ষা। |