পুস্তক পরিচয় ১...
লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই সমস্যা
কিল মারার গোসাঁই, অশ্রুকুমার সিকদার। দীপ, ২৫০.০০
মিউনিস্ট পার্টির আমলাতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার দরুন নানা দেশে নানা সময়ে শিল্পী সাহিত্যিক ও অন্য মেধাজীবীরা কী ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, এই বইটির আলোচ্য বিষয় মূলত সেটাই। যেখানে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে সব দেশে তো বটেই, যেখানে কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হয়নি, সে সব ক্ষেত্রেও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এই নির্যাতন চলেছে। নির্যাতনের ফলে কিছু মেধাজীবীর জীবনহানি হয়েছে, দল ও দেশত্যাগ করে বেঁচেছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ সে সব করেননি, কিন্তু ‘কিল মারার গোঁসাই’দের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রকাশ্যে বা গোপনে। সব কিছু ঠিকঠাক চলেছে, এ কথা প্রায় কেউই বলেননি। ‘কিল মারার গোঁসাই’দের দিন শেষ হবার পর কী ঘটেছে এই কমিউনিস্ট ভাবধারা আশ্রিত শিল্পী-সাহিত্যিকদের, সে নিয়েও একটা আলোচনা আছে বইটার শেষ দিকে। লেখকের মতে, ইডিয়োলজির দায়মুক্তি এই মেধাজীবীদের সৃজনক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়কই হয়েছে।
বইটি সুলিখিত এবং সম্ভবত সে কারণেই সুখপাঠ্য। বিষয়বস্তুর উপস্থাপনার মুন্সিয়ানা এক কথায় অসাধারণ। বইটির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে দেশি-বিদেশি নানা উৎস থেকে। বহু ক্ষেত্রে একটা বড় লেখার নির্যাসটুকু কাজে লাগানো হয়েছে লেখকের প্রতিপাদ্য বিষয়ের কোনও একটা বিশেষ অংশকে প্রতিষ্ঠিত করতে। কিন্তু কোথাও তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে লেখা তার গতি হারিয়ে ফেলেনি, কিংবা তা দিক্ভ্রান্ত হয়ে পড়েনি। তথ্যসূত্রগুলোর ওপর অসামান্য দখল এবং নিজের প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকলে চারশো পৃষ্ঠার একটা বই এত স্বচ্ছন্দে লেখা যায় না।
কিন্তু সমস্যা আছে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই। সোভিয়েত রাষ্ট্রটি ‘কিল মারার গোঁসাই’ ছিল এবং সে রাষ্ট্রনেতাদের মতাদর্শ-অনুপ্রাণিত অন্যান্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টিও নিজস্ব ক্ষমতাবৃত্তে স্রেফ কিল মারার গোঁসাই হয়েই বসে ছিল বা বসে আছে— বইটিকে দাঁড় করানো হয়েছে এই আদি সিদ্ধান্তের ওপর। সোভিয়েত রাষ্ট্রটির কথাই ভাবা যাক। কিল সে রাষ্ট্র মারত সন্দেহ নেই। কিন্তু লেখক সম্ভবত এটা ভেবে দেখেননি যে, কিল আসলে সব রাষ্ট্রকেই মারতে হয় তার ক্ষমতা রক্ষার তাগিদে। প্রয়োজন ভেদে তার পাত্র ও মাত্রার তফাত ঘটে মাত্র। যে ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে এত চিৎকার, খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সেটাকে নিয়ে এত আহ্লাদের কারণ হল, ওই ব্যবস্থায় শাসকরা, শিবরাম চক্রবর্তীর ভাষায়: ‘বর্বরতার একটা সভ্য রকম রূপ দিতে পেরেচে, অত্যাচারকে শান্তি ও শৃঙ্খলার নামে চালাতে পেরেচে এবং শোষণের ফলে শোষিতের মনে অবিমিশ্র আনন্দ দান করতে পেরেচে। এই রকম অসাধারণ প্রয়োগনৈপুণ্য আছে বলেই পৃথিবীতে তারা অষ্টম আশ্চর্য।’ (মস্কোবনামপণ্ডিচেরি শূদ্র না ব্রাহ্মণ)। সোভিয়েত ব্যবস্থা যাঁরা গড়তে গিয়েছিলেন, এই ‘প্রয়োগনৈপুণ্য’টা আয়ত্ত করার সুযোগ তাঁদের ছিল না। এই নয়া রাষ্ট্র সম্পত্তির পবিত্র অধিকার কেড়ে নিতে চায়, সম্ভবত এই কারণেই রাষ্ট্রটিকে গোড়াতেই পিষে মারার চেষ্টা করেছে ফ্রান্স এবং ব্রিটেন সহ চোদ্দটি সভ্য-রাষ্ট্রের জোট। নয়া রাষ্ট্রকে পদে পদে মোকাবিলা করতে হয়েছে অন্তর্ঘাত ও গুপ্তহত্যার। রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের সম্পর্কের জটিলতা বুঝে বলশেভিক আদর্শ এবং সাধারণ নাগরিকের আকাঙ্ক্ষার মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য শাসনকাঠামো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবার পরিস্থিতিই ছিল না স্তালিন যুগে। টিকে থাকার তাড়নায় প্রয়োজনে এবং অপ্রয়োজনে অনেক কিছুই করা হয়েছে, যা অবাঞ্ছিত। কিন্তু তাদের অপরাধের তালিকা বানানোর সময় এটাও খেয়াল করা দরকার যে, ওদের তুলনায় কম চাপের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও এবং ‘বর্বরতার একটা সভ্যরকম রূপ’ দিতে সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও, তথাকথিত ‘ফ্রি সোসাইটি’র রাষ্ট্র যা করে, তা কম কিছু নয়। সোভিয়েতের বন্দি-শিবিরের কথা আমরা বলি, কিন্তু গোয়ান্তেনামো তার তুলনায় কম কীসে? সোভিয়েতের কোনও নাগরিকেরই নাকি কোনও প্রাইভেট স্পেস থাকত না (‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং’)। এডওয়ার্ড স্নোডেনকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার পর এখন আমরা জানি, সন্ত্রাসহামলার ছক থেকে প্রেমালাপ সব কিছুর তথ্য এখন মার্কিন দেশের উটা শহরে সার্ভারবন্দি। স্নোডেনকে কিল মারতে দেওয়া হচ্ছে না বলে ফ্রি সোসাইটির রাষ্ট্রনায়কদের যে তর্জন-গর্জন শোনা যাচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে মনে হয় ‘কিল মারার গোঁসাই’ খুঁজতে সম্ভবত ভুল ইডিওলজির চশমা পরেছেন লেখক। কিল সোভিয়েতও মেরেছে, তবে কিল মারার গোঁসাই হবার মর্যাদা তাকে দেওয়া যায় না। ওই মর্যাদা বাঁধা আছে অন্যত্র।
সোভিয়েতকে কিল মারার গোঁসাই বানাতে ব্যস্ত গ্রন্থকার এই সহজ সত্যটা ভেবে দেখার চেষ্টা করেননি যে কোথাও একটা জোরের জায়গা ছিল এই রাষ্ট্রটির, যার দরুন এত প্রতিকূল অবস্থায় দাঁড়িয়েও রাষ্ট্রটি তার শেষ নাগরিককে পর্যন্ত একজোট করে একটা মরণপণ যুদ্ধে নামতে পেরেছিল নাতসিদের বিরুদ্ধে। স্তালিনগ্রাদে একটা হাতাহাতির যুদ্ধে দুর্ধর্ষ জার্মান বাহিনীকে পরাস্ত করতে নামে যে সোভিয়েত নাগরিকরা, তারা নিশ্চয়ই স্তালিন শাসনে এই আশঙ্কা নিয়ে রোজ ঘুমোতে যেত না যে পরদিনের সকালটা তাদের জন্য বরাদ্দ আছে স্তালিনের বন্দি-শিবিরে কিংবা বধ্যভূমিতে। জোরের যে জায়গাটা এই রাষ্ট্র নির্মাণ করেছিল, মেধাজীবীদের শ্রেষ্ঠ অংশকে যা আকৃষ্ট করেছিল, সেটা হল এই যে, যে অসম্মানের জীবন নিয়ে দিন কাটাত রাশিয়ার মুজিক চাষি কিংবা কারখানার শ্রমিক, লাল ঝান্ডা তাঁদের সেই অসম্মানের জীবন থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কোনও এক মে দিবসের সকালে বার্লিনের রাইখস্টাগের উপর লাল পতাকা তুলতে বীরদর্পে এগিয়ে এসেছিল যে রাশিয়ান মেয়েটি, সোভিয়েত তাকে দিয়েছিল একটা অন্য জীবনের স্বাদ যে জীবন স্রেফ কিল খেয়ে খেয়ে তৈরি হয় না। আলোচ্য বইটির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এই যে, এই সহজ সত্যটাই পাশ কাটাতে হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সংক্রান্ত একটা অগভীর ধারণা থেকে। ফলত, সোভিয়েত তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে মেধাজীবীদের রাগ-অনুরাগ ভরা সম্পর্কের জটিলতাও অনেকটাই অধরা থেকে গেছে বইটিতে।
কিল মারার ঘটনা খুঁজতে একটু কম ব্যস্ত থাকলে লেখকের চোখে এটা অধরা থাকত না যে, সোভিয়েত রাশিয়া তথা সোভিয়েত অনুপ্রাণিত কমিউনিস্ট পার্টিগুলির প্রতি মেধাজীবীদের আকর্ষণের কারণটা হল তাদের সামাজিক অ্যাজেন্ডা, যার মূল কথাটা হল পার্থিব সম্পদে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে একটা সমমর্যাদা-ভিত্তিক সমাজজীবন গড়ে তোলা। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: ‘ধনমদমত্ত সভ্যতার বিরাট কারাগারে শৃঙ্খলাবদ্ধ অসংখ্য বন্দিকে মুক্ত করার সাধনায় নেমেছে সোভিয়েত।’ এই সাধনার প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই আসে সোভিয়েতপ্রীতি, আসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি আকর্ষণ। সাধনার মন্ত্রে ভুল হতে পারে, সাধনায় ভ্রষ্টাচার আসতে পারে। কিন্তু সে জন্য এই সাধনাকে খাটো করে দেখার কারণ থাকে না। রবীন্দ্রনাথ বা রমা রল্যাঁ এ ভাবেই বুঝতে চেয়েছেন এই বিকল্প সমাজ গড়ার পরীক্ষাটিকে, এবং, বিষয়টাকে এ ভাবে উপস্থাপিত না করলে কেন শেষ পর্যন্ত এই মনীষীদের কাছে সোভিয়েত সম্পর্কে ‘মায়া রহিয়া গেল’, সেটা বোঝা যায় না।
‘মায়া রহিয়া গেল’ থেকে মানবসমাজ যে মুক্তি পায়নি, সোভিয়েতের পতনের দুই দশক পরের পৃথিবীও তা অহরহ প্রমাণ করছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের তালিকায় এখনও মার্কস-এর নাম পাওয়া যায়, ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ নিয়ে আলোড়িত হয় লাতিন আমেরিকা। ‘সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চেয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের সমাজতন্ত্রও ভালো’ এ কথা বলেন হোসে সারামাগো, যিনি তাঁর উপন্যাসে লেখেন পুঁজিবাদী অসুস্থতার সংক্রমণের কথা, লেখেন ১৯৯৫-এ যখন সোভিয়েত ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া পৃথিবী কথা বলছে পুঁজিবাদেরই ভাষায়। এই বাস্তবতা থেকে শুরু করলে, এত পীড়ন সত্ত্বেও এই কমিউনিস্ট ইডিওলজির আকর্ষণ কেন যায় না, এটাই হতে পারত বইটির আলোচ্য বিষয়ের ভরকেন্দ্র। তা হলে, জানা বিষয়ের মধ্যেই আমরা পেতে পারতাম নতুন কিছু চিন্তাভাবনার উপাদান। তার বদলে যা পাওয়া গেল, তা হল, বিদ্বেষবিষে জারিত কিছু পুরনো তথ্যের নয়া উত্থাপন, মননশীল পাঠককে যা হতাশ করবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.