বাহির পানে: দক্ষিণের টান
গন্ডার-সাম্রাজ্যের সন্ধানে
রু রাস্তা। দু’ধারে কাঁটাগাছের ঝোপ। একটু অসতর্ক হলেই মুখে, মাথায় লাগতে পারে কাঁটার খোঁচা। জঙ্গলে ঢোকার আগে বিট অফিসার বলে দিয়েছিলেন জঙ্গলের যত গভীরে ঢুকব ততই সরু হবে রাস্তা, আর দু’ধারের কাঁটার ঝোপ ক্রমশ গায়ের উপরে এসে পড়বে। কিছুক্ষণ পরেই টের পেলাম কাঁটাগুলি কতটা মারাত্মক। মাথা সরিয়ে নিলেও সোয়েটারে
ঢুকে গেল কাঁটা। আর সেই কাঁটা বের করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত রক্তারক্তি কাণ্ড।
আমরা যাচ্ছিলাম দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু নাটাল এলাকার ঠান্ডা সংরক্ষিত বনাঞ্চলের সব থেকে ঘন এলাকার মধ্য দিয়ে। বিট অফিসার ব দিয়েছিলেন, “ওখানেই মিলিতে পারে অমূল্য রতন।” কি সেই রত্ন, যার জন্য আমাদের এই বিপদসঙ্কুল যাত্রা? জঙ্গলের মধ্যে ফোঁস ফোঁস শব্দ হচ্ছিল। তা বুনো শুয়োরের শব্দও হতে পারে। আমরা আসার পথে দুটো বুনো শুয়োরকে এ দিকেই আসতে দেখেছি। কিংবা হতে পারে বড় চেহারার ওয়াইল্ডেবিস্ট। হরিণ আর গাধার মাঝামাঝি একটা প্রাণী। জঙ্গলের মধ্যে প্রাণীটা আসলে কী তা কিছুতেই বলবেন না গাইড থিও। কিছু ক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেল। জঙ্গল ছেড়ে ফোঁস ফোঁস শব্দটা এ বার আমাদের খুব কাছে। আর তখনই চোখে পড়ল আমাদের সামনে পুরো রাস্তাটি আটকে এক বিশাল চেহারার গন্ডার। সঙ্গে একটি ছানা। মা আর শাবকের কিছুটা দূরেই আরও একটা বিশাল চেহারার গন্ডার। আমাদের গাড়ির চালক থিও গাড়িটাকে নিয়ে গিয়ে থামালেন একেবারে মা গন্ডারের পিঠের কাছে।
গন্ডার বলতে এত দিন জেনে এসেছি তারা প্রচণ্ড মারমুখী পশু। কেউ বিরক্ত করলেই তেড়ে যায় খড়্গ বাগিয়ে। সেই খড়্গ ফালা ফালা করে দিতে পারে সারা শরীর। সামনের বড় খড়্গটিতে রক্ষা নেই, পিছনেও রয়েছে ছোট আর একটি। আমাদের ডুয়ার্সের জঙ্গলে যে সব গন্ডার দেখি, সেগুলি তুলনায় ছোট। আর তাদের নাকের উপরে রয়েছে একটি মাত্র খড়্গ। ডুয়ার্সেও দেখেছি কাছাকাছি এলেই মাথা নামিয়ে পজিশন নেয়। সতর্ক করে দেয়, ‘আর এগোলেই কিন্তু খড়্গ ঢুকিয়ে দেব পেটে।’ এখানে আমরা এত কাছাকাছি চলে এসেছি কিন্তু শাবক সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও মা গন্ডার তাড়া করছে না তো!
থিও বললেন, “ওটা হোয়াইট রাইনো। চেহারায় বড় হলেও, তুলনায় ওরা শান্ত। ব্ল্যাক রাইনো হলে এত কাছে আমরা যেতেই পারতাম না। চার্জ করত।” গায়ের রং মোটেই সাদা নয়। তা হলে হোয়াইট রাইনো নাম কেন? তাঁবুতে ফিরে এসে বই ঘেঁটে জানতে পারলাম রহস্যটা। দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাচরা যখন বাণিজ্য করতে আসে, তখন তারা ওই বিশাল চেহারার গন্ডারগুলির চওড়া মুখ দেখে তাদের নাম দেয় ওয়াইড রাইনো। আফ্রিকানদের মুখে তা অপভ্রংশ হয়ে যায় হোয়াইট রাইনো। আর সেই শুনে ব্রিটিশরা ওই গন্ডারের নামকরণ করে হোয়াইট রাইনো। পরবর্তী কালে আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট অন্য প্রজাতির গন্ডারের নাম হয় ব্ল্যাক রাইনো। তবে এই প্রজাতির গন্ডারের গায়ের রং অপেক্ষাকৃত গাঢ়।
আমাদের সামনেই গন্ডারের পুরো পরিবারটি হেলেদুলে খাবার খাচ্ছিল। তবে দেখলাম বাচ্চাটি বার বার আমাদের গাড়ির সামনে চলে আসায় মা গন্ডারটিকে ঘন ঘন নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে হচ্ছে। বাচ্চাটিকে আড়াল করে দাঁড়াচ্ছিল মা। রাস্তার অন্য দিক থেকে আমাদের উপরে কড়া নজরদারি চালাচ্ছিল পুরুষ গন্ডারটি। আমরা যত ক্ষণ ছিলাম সে একটি কাঁটা ঝোপের নীচে দাঁড়িয়ে আমাদের উপরে নজর রাখছিল। আর ফোঁস ফোঁস আওয়াজ করছিল। মা গন্ডারটি বাচ্চাকে নিয়ে ঝোপের আড়ালে চলে যাওয়ার পরেই সেটি উল্টো দিকের ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল। তার পরে অনেক ক্ষণ তার ফোঁস ফোঁস আওয়াজ আমরা শুনেছি। আমরা যখন এগোচ্ছিলাম ও আমাদের পাশে পাশেই যাচ্ছিল। এক সময় তা বন্ধ হয়ে গেল। থিও বললেন, “ওর নিজের এলাকা শেষ হয়ে গিয়েছে। মা তার বাচ্চাকে নিয়ে এই এলাকার বাইরে কখনও যাবে না।”
হোয়াইট রাইনো ব্ল্যাক রাইনো
চওড়া মুখ সরু, তীক্ষ্ণ
১১-১৩ ফুট দৈর্ঘ্য ৯ -১১ ফুট
৩৫-৫৯ ইঞ্চি (দৈর্ঘ্য) সামনের খড়গ ২২-৫৫ ইঞ্চি (দৈর্ঘ্য)
২৩০০ কিলো (পুরুষ)
১৭০০ কিলো (মহিলা)
ওজন ২১৯৯ কিলো (পুরুষ
১৭০০ কিলো (মহিলা)
শাবকের সঙ্গে থাকে বাবা থাকে না
গ্রাফিক্স: প্রবাল ধর
হোয়াইট রাইনো তো দেখা হল, কিন্তু গন্ডারের অন্য প্রজাতিটি কোথায়? থিও যা বিবরণ দিলেন তাতে ব্ল্যাক রাইনোটিকে আমাদের জলদাপাড়ার গন্ডারের জাতভাই বলেই মনে হল। শুধু নাকের উপরে একটি খড়্গ বেশি। ওই ব্ল্যাক রাইনোর হদিশ পেতে থিওর ল্যান্ডরোভার জঙ্গলের সম্ভাব্য প্রতিটি এলাকায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিন্তু প্রাণীটির দেখা মিলল না। সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে বেশ কয়েকটি জিরাফ এবং জেব্রার দেখা মিলল। এ দিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাত বেশি হওয়ার আগেই আমাদের ফিরতে হবে ক্যাম্পে। এমনই কড়া নির্দেশ।
ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ক্যাম্পে ফিরছি, এমন সময় থিও হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে দিলেন, “ওই জঙ্গলের মধ্যে একটাকে পেয়েছি। ও পিছনের রাস্তার দিকে যাচ্ছে। আমরা ওর আগেই ওখানে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করছি।” জঙ্গলের মধ্যে থিও গন্ডারটিকে নজর করতে পারলেও আমরা কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না।
তবে হঠাৎই দেখলাম ঝোপের মধ্য থেকে থপ থপ করতে করতে ছুটে আসছে কালো একটা প্রাণী। থিয়ো ব্রেক কষলেন, “ওই যে ব্ল্যাক রাইনো। আমাদের আর এগনো ঠিক হবে না। ও চার্জ করতে পারে।”
আলোআঁধারিতে ওর অবয়বটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। নাকের উপরে দুটি খড়্গ প্রায় ১০০ মিটার দূর থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। গন্ডারটা আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। এক বার দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। আমাদের মনটাও ভাল হয়ে গেল। সব ভাল যার শেষ ভাল।



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.