চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয়
আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মিশেল
গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় |
|
থিমের পালে লাগল হাওয়া |
গঙ্গাপারের এক সময়ের ফরাসি ঔপনেবেশিক শহর চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো আর পাঁচটা এলাকার থেকে একেবারেই আলাদা। ঐতিহ্যের দিক থেকেও প্রাচীন এই শহরের পুজো ভিন্ন গোত্রের। অনেক দিক থেকেই এখানকার পুজোর রয়েছে স্বকীয়তা। যেমন, চন্দননগরের আলোর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। আলো তো আছেই, সঙ্গে প্রতিমার শোলার সাজ আর চোখ ধাঁধানো অঙ্গসজ্জা এই উৎসবকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটেছে ঠাকুরের সাজে। এমনকী মণ্ডপ ভাবনাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এখন। এক সময়ের আকাশচুম্বি মণ্ডপের দিন এখন গিয়েছে। সেই জায়গায় এসেছে থিমের ঢেউ। ঠাকুরের সাজের পাশাপাশি আলোর ভাবনাতেও এসেছে পরিবর্তন। টুনি বাল্বের জায়গা নিয়েছে এলইডি আলো।
|
থিম ভাবনার কয়েক ঝলক |
আদতে চন্দননগরের বলা হলেও জগদ্ধাত্রী পুজোর এলাকা মূলত চুঁচুড়া থেকে ভদ্রেশ্বর পর্যন্ত বিস্তৃত। এ বার ‘চন্দননগর কেন্দ্রীয় পুজো কমিটি’র আওতায় মোট ১৫১টি বারোয়ারি পুজো হচ্ছে। যাদের অনেকেই থিমের ভাবনায় আপাতত বুঁদ। কী নেই চন্দননগরের পুজোর থিমের হাটে!
• ছোটবেলার স্মৃতি সবার কাছেই অত্যন্ত সুখের। আর সে জন্যই সেই সময়টার জন্য কমবেশি সবারই মন কেমন করা রয়েছে। এ বার সেই ছেলেবেলাই ফিরে এসেছে চন্দননগরে সাওলি সর্বজনীন পুজো কমিটির মণ্ডপে।
• পরিবেশ নিয়ে এখন সচেতনতা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। সেই ছবিই এ বার সুরের পুকুরের রজতজয়ন্তী বর্ষের পুজোর ভাবনায়। এখানে গাছের কোটরে প্রতিমার অবস্থান। গত রথের দিন থেকে পুজো প্রাঙ্গনেই নানা রকম গাছের চাষ করা হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে পরিবেশ রক্ষায় গাছের ভূমিকাকেও।
• সিংহাসন নিয়ে আদিকাল থেকেই টানাটানি দেবতা থেকে চলতি সমাজ ব্যবস্থায়। অন্যকে হারিয়ে চেয়ারের দখল নিতে পারলেই জয়ী। সেই সিংহাসন নিয়েই নতুনপাড়া সর্বজনীনের এ বারের মণ্ডপ ভাবনা। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন অন্তত ১৫০০ কাঠের সিংহাসন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মণ্ডপ।
পুজোর থিমে যেমন সময় উঠে এসেছে তেমনিই ধরা দিয়েছে গ্রাম বাংলা। এমনকী জঙ্গল মহলের জেলাও।
• বোরো পঞ্চাননতলার চল্লিশ বছরের পুজোয় এ বার পুতুল, খেলনা, বাঁশি, মুখোশ আর ঘুড়ি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে মণ্ডপ।
• ভদ্রেশ্বরের যুব চেতনা তাদের ২৫ বছরের পুজোয় এ বার হোগলা পাতা, গাছের ছাল দিয়ে পুরুলিয়ার একটি শবরতীর্থের আদলে তৈরি করেছে মণ্ডপ। |
|
• হেলাপুকুর ধারের পুজোয় এ বার উঠে এসেছে এক টুকরো নেপাল। দরবার স্কোয়ারের আদলে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ।
• চন্দননগরের থিমে শুধু নেপাল নয় উঠে এসেছে নাগাল্যান্ডও। সেখানকার গ্রামের বাড়ির আদলে বোরো কালীতলার মণ্ডপ তৈরি হয়েছে এ বার দরমা, কাঠ আর ঝুড়ি দিয়ে। উত্তরাঞ্চল সর্বজনীনের থিমে উঠে এসেছে গোল্ড উপজাতিদের শিল্প-সংস্কৃতি। ৪০ হাজার প্রদীপ, ৫০০ হ্যারিকেন আর তালপাতা দিয়ে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ।
• নিয়োগীবাগান নব বালক সঙ্ঘের রজতজয়ন্তী বর্ষের মণ্ডপ এ বার হয়েছে রাজস্থানী ঘরানার সুতো দিয়ে। হাতির পিঠে বসার জায়গার আদলে বানানো হয়েছে মণ্ডপ। ভিতরে রাজা, রানি, সৈন্যদের মডেল।
গোন্দলপাড়া অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব সূর্যের নানা রূপকে তাঁদের মণ্ডপ ভাবনায় তুলে ধরেছেন।
|
পাঁয়ে হেটেই ঠাকুর দেখা |
|
এইসব থিমের কারিকুরি মানুষ যাতে সুষ্ঠভাবে দেখতে পারেন সে জন্য ভাবনার শেষ নেই প্রশাসনের। পুজোর দিনগুলিতে বিকেল চারটে থেকে ভোর চারটে পর্যন্ত চন্দননগরে গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে জিটি রোড দিয়ে। যে সব মানুষ কলকাতা থেকে ঠাকুর দেখতে আসবেন চন্দননগরে তাঁরা নির্দিষ্ট পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে হেঁটে ঠাকুর দেখবেন। কারণ পুজোয় মানুষের ঢল নামে চন্দননগরে। তাতে গাড়ি চলাচল করা একেবারেই অসম্ভব। তার উপর গাড়ি থেকে দুর্ঘটনা ঘটে নানা অঘটন ঘটে যেতে পারে। সে জন্যই গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় প্রশাসনের তরফে।
|
পুলিশ বনাম ভিড় |
পুজোর দিনগুলিতে প্রতিদিন চন্দননগরে লক্ষ লোকের ভিড়। আর এই বিপুল পরিমান মানুষকে সামলাতে পুলিশ প্রশাসনের ঘুম ছুটে যায়। প্রায় ১১০০ পুলিশকর্মী পুজোর দিনগুলিতে নিরাপত্তার দায়িত্বে এ বার থাকছেন চন্দননগরে। শুধু স্থলে নয়, জল নিয়েও পুলিশের মাথাব্যথার অন্ত নেই। কারণ গঙ্গার ঠিক অপর পার উত্তর ২৪ পরগনা থেকে হাজারে হাজারে মানুষ প্রতিদিন গঙ্গা পেরিয়ে আসেন চন্দননগরে। তাই পুজো এলাকার মোট সাতটি গঙ্গার ঘাটে থাকে কড়া পুলিশি নজরদারি। জলে রিভার ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থাকবে জেলা পুলিশের লঞ্চও। কারণ ভিড়ের চাপে অনেক সময়ই পারপার করার নৌকাগুলিতে বেশি মানুষ উঠে পড়েন। যে কোনও সময় গঙ্গায় নৌকা উল্টে বিপদ হতে পারে। তা সামাল দিতেই পুলিশের সর্তক প্রহরা। |
|
আবাহন শেষে ভাসানযাত্রা |
চন্দননগরের ভাসানের শোভাযাত্রাও ঐতিহ্যবাহী। সব পুজোর উদ্যোক্তাদের অবশ্য ভাসানে অংশ নিতে দেওয়া হয় না প্রশাসনের তরফে। এ বার ৬৭টি পুজো উদ্যোক্তা ভাসানের শোভাযাত্রায় অংশ নিচ্ছেন। রং-বেরংয়ের আলোকমালায় সেজে এক এর পর এক ঠাকুর গঙ্গা অভিমুখে রওনা দেয়। সব মিলিয়ে এক চোখ জোড়ানো কোলাজের জন্ম হয় সেই শোভাযাত্রাকে ঘিরে। রাতভর সেই ভাসানযাত্রা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান গঙ্গাপারের এই প্রাচীন শহরে।
|
ছবি: তাপস ঘোষ। |