দক্ষিণের টান
সিল-সাম্রাজ্যের সন্ধানে
ক্ষিণ আফ্রিকায় সিল মাছ?
কেপটাউনে আমাদের গাইড আবদুল লতিফ যখন সিল মাছ দেখতে যাওয়ার কথা বললেন তখন বাসে বসা পর্যটকদের বেশির ভাগই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, মেরুপ্রদেশে বা ঠান্ডা জায়গাতেই এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে দেখতে আমাদের চোখ অভ্যস্ত। অবশ্য আমি অবাক হইনি। কারণ, গত বছর অস্ট্রেলিয়ার ক্যাঙারু দ্বীপে গিয়ে দেখেছিলাম সিল। উষ্ণ আবহাওয়ায় যে ওরা দিব্যি থাকে, বংশবিস্তারও করে, তা দেখেছিলাম। সেটা ছিল প্রশান্ত মহাসাগর। দেখেছিলাম সমুদ্রের ধারে সাদা বালিতে সিলেদের সংসার। এ বার সিলেদের সংসার দেখতে আমাদের গন্তব্য অতলান্তিক মহাসাগর!
আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের কিছুটা উত্তরে হাউট বে-তে নেমে যেখানে সিল মাছেদের দেখতে যাচ্ছিলাম সেটা অতলান্তিকের উপরে একটা দ্বীপ। সেখানেই সংসার আফ্রিকান ফার সিলদের। গায়ে মোটা লোমের আস্তরণের জন্য ওদের ওই নাম। সাগরবেলায় ওরা আসে না কখনও। ফলস হাউট বে থেকে যখন আমাদের ক্যাটামারান ছাড়ল তখন আকাশ ছিল মেঘলা। তাই সমুদ্রের হাওয়াটা হাড়ে কাঁপন ধরাচ্ছিল।
কিন্তু ক্যাটামারান মিনিট ২০ পরে যেখানে পৌঁছল সেখানকার দৃশ্যটা দেখে উত্তেজনায় শীত গেল পালিয়ে। সামনে-পিছনে সব জায়গা থেকে ক্লিক ক্লিক আওয়াজ আসছে। তীব্র হাওয়ায় ক্যাটামারান দুলছিল ভয়ঙ্কর ভাবে। ভারসাম্য রাখা যাচ্ছিল না। কিন্তু কাঁপা কাঁপা হাতে ওই দৃশ্য ধরে রাখার জন্য এমন হুড়োহুড়ি শুরু হল যে আমাদের সারেংকে দেখলাম ক্যাটামারানের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
দৃশ্যটা কী? দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল নীল সমুদ্রের বুকে বিশাল বিশাল পাথর। সেই পাথরের রং কোথাও লালচে বাদামি, কোথাও কালো, কোথাও বা স্লেটের মতো। বাদামি রঙের উপরে কালো আর স্লেট রঙের ছোপ। দ্বীপের আরও একটু কাছাকাছি চলে যেতেই দেখলাম পাথরগুলি নড়ছে। পাথর থেকে কিছু একটা ঝাঁপ দিয়ে পড়ছে সমুদ্রে। সারেং বললেন, “আমরা সিল মাছের ডেরায় এসে গিয়েছি। কেউ বেশি ঝুঁকবেন না। পড়ে গেলে সলিল সমাধি। আর সাঁতার জানলেও রক্ষে নেই। কারণ সিলের বড়বড় তীক্ষ্ণ দাঁত রয়েছে। তা দিয়ে কিন্তু ওরা কামড়ায়।” ক্যাটামারানের ধারে থাকা ভিড়ের একাংশ চলে এল খোলের ভিতরের দিকে। হুড়োহুড়ি কিছুটা কমল।
দূর থেকে দ্বীপের যে তিন রকমের রং দেখতে পাচ্ছিলাম সেটা তা হলে কী? আসলে আফ্রিকান সিলদের গায়ের রং তিন রকমের হয়। যেগুলি বয়স্ক পুরুষ তাদের গায়ের রং স্লেটের মতো। পূর্ণবয়স্ক মেয়েদের গায়ের রং বাদামি। আর একেবারে যারা অল্পবয়স্ক তাদের গায়ের রং কালো। দলে পূর্ণবয়স্ক মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। তাই দ্বীপটাকে বাদামি বলে মনে হচ্ছিল।
সিল-দ্বীপের সামনে যেতেই পরিষ্কার হয়ে গেল সব। জলযানে ওঠার আগে আমাদের গাইড আবদুল বলে দিয়েছিলেন, ‘‘নীচের ডেকের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন। তা হলে সিলগুলিকে একেবারে কাছ থেকে দেখতে পাবেন। দারুণ ছবি হবে।’’ আবদুলের কথা শুনে সব থেকে আগে ক্যাটামারানে উঠেছিলাম। সিল-দ্বীপের একেবারে কাছে এসে তার ফলটাও পেলাম। দেখলাম দূর থেকে দেখা দ্বীপটা নড়ছে।
আমাদের ক্যাটামারানটা দ্বীপের থেকে ফুট দশেক দূরে গিয়ে দাঁড়াল। তখনই দেখলাম সিলেরা পুরো দ্বীপটাই দখল করে বসে আছে। তাদের মধ্যে ভীষণ ব্যস্ততা। একে অপরকে ঠেলছে। ঠেলায় কেউ কেউ পড়ে যাচ্ছে জলে। ফের সাঁতার কেটে পাথরের গায়ে নিজের আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছে। বেশ কয়েকটা বড় বড় পাথর নিয়ে সিলদের ওই সাম্রাজ্য। গোটা সাম্রাজ্যের এলাকা ৪০ বর্গ কিলোমিটার।
পাথরের দ্বীপে রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় বড় খাঁজ। সেই খাঁজে প্রসব করে স্ত্রী সিল। এমনই বেশ কয়েকটি শিশু সিল নজরে এল আমাদেরও। দেখলাম সন্তানকে আগলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে মা। আর বিশাল চেহারার স্লেট রঙের একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ সিল সন্তানকে মায়ের থেকে আলাদা করার জন্য স্ত্রী সিলকে ঠেলা মারছে। ক্যাটামারানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন উত্তর কোরিয়ার এক জীববিজ্ঞানী পার্ক সু। সু বললেন, “সন্তানকে বড় করা সিল-মায়ের কাছে কম হ্যাপার কাজ নয়। হাঙর, ছোট তিমি তো রয়েছেই, তা ছাড়া পূর্ণবয়স্ক পুরুষ সিলেরাও বাচ্চাদের কাছে বিপদের।”
কেন? জীববিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ, “বাচ্চা যত দিন ছোট থাকে তত দিন মা তাকে আগলে আগলে রাখে। পুরুষ সিলদের পাত্তাই দেয় না মায়েরা। তাই পুরুষ সিলেরা তক্কে তক্কে থাকে। মায়ের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে বাচ্চা সিলকে মুখে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাথরের উপরে। তার পরে সন্তানহারা মায়েদের শোক প্রকাশের সুযোগটাও দেয় না পুরুষ সিলেরা।”
ওদের এক একটার ওজন কত? জুলজিক্যাল সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, পূর্ণবয়স্ক একটি পুরুষ সিলের ওজন ২০০ থেকে ৩০০ কিলোগ্রাম। ২.৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয় তারা। পূর্ণবয়স্ক মহিলা সিলের ওজন হয় ৩৫ থেকে ১০০ কিলো। লম্বায় ১.২ থেকে ১.৭ মিটার। সিলের গড় আয়ু ২৫ বছর। আমাদের সফরসঙ্গী জীবনবিজ্ঞানী সু সিলের সাম্রাজ্য দেখতে দেখতেই তাঁর ল্যাপটপ খুলে ফেলেছেন। সু-র সংযোজন, “নামিবিয়ার উপকূল এবং হাউট বে-র দ্বীপ মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ আফ্রিকান সিল রয়েছে। এরা অস্ট্রেলিয়ান ফার সিলদেরই জাতভাই। তবে অস্ট্রেলীয় ভাইদের তুলনায় এরা আকারে কিছুটা বড়। বাঁচেও বেশি দিন। দুই দেশের জলবায়ুর প্রকারভেদই তার মূল কারণ।”
তবে অস্ট্রেলিয়ান সিলের থেকে আফ্রিকার সিলদের দেখে মনে হল অনেকটা কম আক্রমণাত্মক। এটাও কি জলবায়ুরই প্রভাব? সু-র কাছে আমার এই প্রশ্নের জবাব ছিল না।



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.