|
|
|
|
|
|
কাশফুল ও শিউলিফুলেরও বিকল্প হয়! |
রুমি বাগচী ভাওয়াল
ক্যালিফর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র |
|
প্রথম যে দিন আমার বন্ধু অরুণিমা ফোন করে বলল, বিকেলে তোর বাড়িতে যাব, পুজোর অনুষ্ঠানের প্ল্যান করতে। আমি অবাক! এখনই? সবে তো জুলাই মাস।
— কেন, ভুলে গেলি? প্রত্যেকবারই তো এ রকম হয়। তার ওপর এ বার তো তোকে অনেক দায়িত্ব নিতে হবে।
— কী কী দায়িত্ব রে?
— তোকে আমাদের পুজোর ওয়েবসাইটটা বানাতে হবে। আর লিখিস-টিখিস যখন, পুজোর শারদ সংখ্যার পুরো দায়িত্বটা নিবি। তা ছাড়া তোর বাড়িটা মাঝামাঝি জায়গায় বলে বেশ কয়েকটা রিহার্সল তোর বাড়িতে করব ঠিক করেছি। সবাই আসতে পারবে।
ভেবেছিলাম, ওয়েবসাইট বানানোটা আর শারদ সংখ্যার দায়িত্বটা কাজ হিসেবে অনেক। কিন্তু পুজোর আমেজ হিসেবে তেমন কিছু নয়। একদম ভুল। সেগুলোও আমেজের একটা অন্য রূপ। কত বার যে ‘পুজো’, ‘দুর্গা’ এই শব্দগুলো লিখতে হল।
বিকেলে যখন ওঁরা কয়েক জন আমার ঘরে ঢুকে হই হই করতে করতে পুজোতে কী কী হবে, কে কে করবে, কবে কবে রিহার্সাল হবে, ঠিক করছিল, চা-স্ন্যাক বানাতে বানাতে দূর থেকে আমি ওঁদের দেখছিলাম। আসল রিহার্সালের দিন কিন্তু অনেক কাজ করতে হল। কারণ নাচ-গানের মেয়েদের সঙ্গে তাঁদের স্বামীরাও এসেছিল। তাঁদের সবার জন্য রান্না করেছিলাম। আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া হল। তার পর রিহার্সাল। বাচ্চারা এক ঘরে, মেয়েরা এক ঘরে, ছেলেরা বাগানে। বাড়িতে পা রাখার জায়গা নেই।
ভাবছিলাম আমেরিকায় পুজোর আমেজ তবে এ ভাবেই আসে। শুধু কাশফুল, শিউলি ফুল-ই একমাত্র আমেজ আনে না। তারও বিকল্প আছে!
বাচ্চাদের ঘর থেকে অনুরোধ হল, তুমি কম্পিউটারে গানগুলো চালিয়ে দেবে? ‘ও ও, আয় রে ছুটে আয়, পুজোর গন্ধ এসেছে’ এটা দিয়ে শুরু করবে। মেয়েদের ঘর থেকে তখন ভেসে আসছে ‘জাগো মা দুর্গা’...
এই জুলাই মাসেই আমেরিকায় বসে আমার বাড়ি কেমন ‘মা দুর্গা’ শব্দে ভরে গেছে। এই আমেজ অনেক বেশি সজীব, অনেক মুখর। যদি দেশে থাকতে প্রকৃতি আমাকে বলত, তুমি দেখবে কাশ ফুলগুলো যেন ঠিক সময়ে ফোটে, শিউলি ফুলগুলোর বৃন্তের রং ঠিক যেন আগের মতো গাঢ় কমলা-ই হয়, তা হলে আমার ঠিক যেমন লাগত, আমেরিকার পুজোতে আমার সে রকম একাত্ম লাগছে।
দেশে সেপ্টেম্বর মাসে যখন একটু একটু করে শরৎকাল আসত, তখন খুবই আনন্দ হত। তার পর পুজোর বাজার করার আনন্দ ছিল। কিন্তু পাড়ার পুজোর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ থাকত না। পুজোর দিনগুলোতে জনস্রোতের মধ্যে, অজস্র আলোর মধ্যে এ-প্যান্ডেল থেকে সে-প্যান্ডেলে ভেসে বেড়াতাম। রাস্তায় অনেক লোক, কিন্তু ক’জনকে চিনি! ক’জনের সঙ্গে কথা হচ্ছে! আজ যে শাড়িটা পরলাম সেটা কে দেখল।
তবু রাস্তা জুড়ে এত আলো, মাইকে গান, এত মানুষ— এই আনন্দর একটা ব্যাপ্তি থাকলেও আমার সঙ্গে তার দূরত্ব থাকত।
অরুণিমা রিহার্সালের পর বলে গেল, ‘রুমি তৈরি থাকিস। লং বিচে বক্সে মা দুর্গা এসে বসে আছে। এই শনিবার ভোরে মা দুর্গাকে আমাদের স্টোরেজে আনতে হবে। একটু হাত লাগাতে হবে।’ দেশে এ ভাবে হাত লাগানোর সুযোগ কখনও আসেনি। হাত পৌঁছাতই না।
আমাদের এই পুজোটা অর্থাৎ বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অব সার্দান ক্যালিফোর্নিয়া-র পুজোটা হয় লস অ্যাঞ্জেলেসের উত্তরে। লস অ্যাঞ্জেলেসের দক্ষিণে হয় অন্য একটি পুজো। এ ছাড়াও ভারত সেবাশ্রমের মন্দিরের পুজো তো আছেই। সেটা আমাদের মতো সপ্তাহান্তের পুজো নয়। দেশের পুজোর সময় মেনেই হয়। তাই অনেকের কাছে এর একটি বিশেষ মূল্য আছে। এই তিনটে পুজো ছাড়া বাংলাদেশের হিন্দুদের দু’টি সোসাইটি ‘বেঙ্গলি হেরিটেজ অব সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া’ এবং ‘সনাতন বেঙ্গলি সোসাইটি’ লস অ্যাঞ্জেলেসে দুটো দুর্গাপুজো করে শনিবারের পুরো দিন আর রবিবারের দুপুর নিয়ে। এঁদের খুব সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
চৌত্রিশ বছরের পুরনো আমাদের এই পুজোটাই (বিএএসসি) লস অ্যাঞ্জেলেসে সবচেয়ে বড় পুজো। এ বার তিন বছর পর ফাইবার গ্লাসের নতুন দুর্গা মূর্তি আনা হয়েছে কলকাতা থেকে। পুরনো মূর্তিটি লস ভেগাসের একটি দলকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বক্সের নীচে চাকা লাগানো ছিল বলে আমাদের সকলের পক্ষে সম্ভব হল গাড়ি থেকে সেটা ঠেলে স্টোরেজে নিয়ে যাওয়া। প্লাস্টিকের মোড়ক খুলে নতুন মূর্তি দেখলাম মন ভরে। বাড়ি ফিরে ওয়েবসাইট নিয়ে বসতে হল। পুজোর নির্ঘণ্ট লিখতে হবে, কী কী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে, কে কে করবে সব কিছুর লিস্ট দেখতে হবে। ওটা দেখেই মানুষ আসবে, ভুল হলে বিপদ। নাম লিখতে হবে ভলান্টিয়ারদেরও। এর পর আছে শারদসংখ্যা প্রকাশের বিপুল কাজ— লেখা জোগাড় করা, প্রুফ রিড করা, প্রিন্টারে দেওয়া। এর মধ্যে শিপ্রাদি ফোন করে বলল, পুজোর জায়গাটা একটু দেখে আসা দরকার। সপ্তাহের মধ্যেই একদিন চলে গেলাম সেখানে।
পুজোর আগে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা উইকএন্ড। আর প্রত্যেক উইকএন্ডেই প্রায় চল্লিশ মাইল গাড়ি চালিয়ে যেতে হচ্ছে রিহার্সাল দিতে।
দেখতে দেখতে পুজো এসে পড়ল।
শুক্রবার সারা দিন অফিসে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে কিন্তু আনন্দিত মনে প্যান্ট ছেড়ে নতুন শাড়ি পরলাম। আমার বাড়ি পুজোর কাছেই। তিন দিন যাতায়াত করতে পারব। অনেকে কাছাকাছি হোটেলে এসে থাকে। পুজোর সময় ধারে কাছের হোটেলগুলো বাঙালিতে ভরে যায়।
মাঠের মতো বড় হলঘরে ঠাকুর। অন্য দিকে বইয়ের স্টল, শাড়ি-গয়নার স্টল। সাহিত্যের স্টলের দায়িত্ব আমার। প্রায় আটশো বাঙালি আসেন এখানে। মোটামোটি সবাই চেনাও হয়ে গেছে। তিন দিন ধরে তাঁদের সঙ্গে দেখা হবে। পাঁচবেলা এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, এক ঘরে পাশাপাশি বসে অনুষ্ঠান দেখা। আড্ডা-তর্ক, কখনও প্রশংসা, কখনও নিন্দা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বইয়ের পাতা ওল্টানো, শাড়ি দেখা, দরদাম করা।
এ বার
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা সবাই এখানে এসেছে। যাদের সঙ্গে সারা বছর দেখা হয় না, শুধু ফোনে কথা হয়, তারাও। প্রত্যেক বার লস অ্যাঞ্জেলেসে কিছু নতুন বাঙালি আসে, যাদের সঙ্গে এই পুজোর সময়ই আলাপ হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ খুব ভাল বন্ধুও হয়ে যায়। আর এ ভাবেই প্রত্যেক পুজোয় জীবন আরও সমৃদ্ধ হয়।
যদি ছোটবেলায় শহর ছেড়ে বাইরে পা না রাখতাম, যদি পুরনো স্মৃতির সঙ্গে বিচ্ছেদে ভয় পেয়ে গুটিয়ে থাকতাম তবে পুজোর এই অন্য রূপকে কোনও দিনই দেখা হত না।
শনিবার খুব ভোরে উঠে গেলাম ফল কাটতে। ফিরে এসে স্নান করে অন্য শাড়ি পরে আবার পুজোয়। বিকেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধেয় আবার সাজ গোজ, আবার পুজোয়। রবিবার সারা দিন পুজোর ওখানে। তারই মাঝে পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে মনের মধ্যে বিষাদের চোরাটান টের পেতে থাকি। অনেত রাতে বাড়ি ফেরা। বিষাদটাই ক্লান্তি হয়ে দেহে-মনে লেগে থাকে। পর দিন সকালে উঠেই অফিস যেতে হবে ভাবতে ভাবতে বিছানায় যাই। মনকে সান্ত্বনা দেই এর পর লক্ষ্মীপুজো আছে, ক্রিসমাস, নিউইয়ার্স পার্টি আছে। কিন্তু উৎসবের সেরা উৎসব, সবচেয়ে বড় মিলন মেলা দুর্গাপুজো তো শেষ হয়ে গেল।
অফিসে গিয়ে মনে একটু ধাক্কা লাগে— এঁদের কাউকে আমার এই বিষণ্ণতার কথা বলা যায় না। দুর্গাপুজো এদের কাছে কিছুই নয়।
দিন যায়...আমি অপেক্ষা করে থাকব আবার কবে হঠাৎ করে একদিন অরুণিমার ফোন আসবে। এ বার হয়তো অরুণিমা না হয়ে শুভমিতা হবে। কিন্তু আমি জানি, ফোনের বক্তব্য এক-ই থাকবে— আজ বিকেলে তোদের বাড়ি আসব। পুজোর প্ল্যান করতে।
সে কী, এত তাড়াতাড়ি! |
|
|
|
|
|
|