পুজোর জার্নাল
নিরুপম রায়
বন, জার্মানি
মহালয়া
শরতের নীল আকাশে সাদা মেঘ, কাশফুল কিছুই নেই। পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণ এই এক পৃথিবী দূরে কখন আসে, কখন যায় বুঝতেই পারি না। তবু আজ ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ আবার বেজে উঠেছে আশ্চর্য সেই কণ্ঠটি। নাস্তিকেরও চোখে জল, যখন আকাশবাণীতে আমাদের সকলের হয়েই দেবীকে মর্তলোকে আবাহন করছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ভোরবেলা আধো ঘুম আধো জাগরণে তাঁকে ঘিরে বসে আছে আপামর বাঙালি, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।
"অয়ি সুমনঃ সুমনঃ সুমনঃ সুমনঃ সুমনোহর কান্তিয়ুতে।
শ্রিতরজনীরজ-নীরজ-নীরজনী-রজনীকর-বক্ত্রবৃতে।
সুনয়নবিভ্রম-রভ্র-মর-ভ্রমর-ভ্রম-রভ্রমরাধিপতে।
জয় জয় হে … "


আগমনী
সকালে ঘুম থেকে উঠে যে গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে সেটা শরতের না কি পুজোর? প্রসন্ন প্রকৃতির মাঝে, ভোরের সোনা রোদ আর স্নিগ্ধ হিমেল হাওয়ায় কার আগমনী, দেবীর না মানবীর? সকালে ঝরে পড়া শিশির ভেজা শিউলি যে দৃশ্য নির্মাণ করে, তা কি করুণ না সুন্দর? এখানে বসেও বুঝতে পারি, কোন দূর দেশে এক গ্রামে সন্ধেবেলা বাতাস ঘন হয়ে ওঠে ছাতিমের গন্ধে। সে কি কল্পনা না বাস্তব? শ্বেতশুভ্র রাজকন্যা পারিজাতিকা গৈরিক বসনে ভোরবেলা হেঁটে যায় একাকী উদাসীন, কোন এক নিঃসঙ্গ সূর্যপ্রতিম যুবকের বিষণ্ণ সন্ধ্যার দিকে—
সুখ নেইকো মনে,
কি যেন তার হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে

এ কি শুধুই রোমান্টিকতা?

মহাষষ্ঠী
এ বার পুজোয় আমি দূরদেশে, কিন্তু মন পড়ে আছে বাঁকুড়ায় আমার গ্রামের বকুলতলায়। শেষ কবে পুজোর দিনগুলো গ্রামের বাইরে কাটিয়েছি, মনেই পড়ে না। ভাবছি, পুজোর জন্য মনের এত আকুলতা ঠিক কীসের জন্য? মণ্ডপের প্রতিমা, ধূপ-ধুনো, আরতি, ঢাকের বাদ্যি, ভুরিভোজ? মনে ভয়মিশ্রিত ভক্তি জাগানো, গর্জন তেলে চকচকে ওই মুখশ্রীর অমোঘ আকর্ষণ? গণেশের শুঁড়, কার্তিকের টেরি, সরস্বতী-লক্ষ্মীর সাজগোজ বা সিংহের লেজের বাহারের প্রতি সুপ্ত শিশুসুলভ কৌতূহল? ভোরের শিউলি, সন্ধের ছাতিমের গন্ধ, বুকের উপর আধখোলা শারদসংখ্যা নিয়ে দুপুরের ঘুম? পুজোর ভিড়ের মধ্যে চোখে চোখ রাখা, প্রতিমার মতো চোখের কৃপাদৃষ্টি, ভিড়ের থেকে একলা হয়ে দু’ একটি কথা— সেই সব কৈশোর স্মৃতির হাতছানি? উৎসবের দিনগুলি মা-বাবা-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ করবার আকাঙ্ক্ষা? জোছনায় ভেসে যাওয়া ফুটবল মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে বসে গাঁজা-সিগারেটের ধোঁয়ার মোহময়তা? মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে, মাটিতে পা না ফেলে গর্বিত হেঁটে যাওয়া সব মেয়েদের দেখে দেখে ঘুরে বেড়ানো? হাজার হাজার এই সব ভাবনা, সহস্র ছবি মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে কোন মন্ত্রবলে আমাকে আবার নিয়ে যায় ওই মণ্ডপে, ওই ছাতিমের গন্ধে, ওই গর্বিত হেঁটে যাওয়া মেয়েদের পাশে, জোছনার মাঠে। সরোজ, গোল্ডি, শঙ্কর, সিদ্ধার্থ, শিবু— আমিও কি আজ রাতে ওদের সঙ্গেই বসে নেই? চল তবে আর একটা সিগারেট ধরানো যাক...

সপ্তমীর সকাল
বছর দশ-পনেরো আগে একটা সময় ছিল, যখন বর্ষার পর শরতের শুরুতে গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িগুলো ঝকঝকে রঙে সেজে উঠত। না, নামী ব্র্যান্ডের দামি কোনও রঙের প্রলেপ নয়! নেহাতই সামান্য গ্রাম্য সাজগোজ। খড়ে ছাওয়া মাটির বাড়িতে খড়িমাটির পোঁচ। সাধ্যে কুলোলে, শখ এবং বিলাসিতা করে, হয়তো কখনও কেউ একটু গুঁড়ো নীল মেশাতেন খড়িমাটির সঙ্গে। বাইরের দেওয়ালে নীচের অংশে আলকাতরা। পুজোর আগে সেই আলকাতরা পুরোপুরি শুকিয়ে উঠত না। সুতরাং, অসাবধানে হেলান দেওয়ার মাশুল হিসেবে, দেওয়ালের আলকাতরা পুজোর জামাতে নির্মম চিহ্ন রেখে যেত প্রায় প্রতি বছরই। ষষ্ঠীর সন্ধেবেলা গিরিমাটি দিয়ে দরজার পাশে লেখা হত শিব-দুর্গা নাম। অনেক সময় এই লেখার দায়িত্বটা পড়ত বাড়ির কচিকাঁচাদের উপর। দুর্গা না দূর্গা— তর্ক হত খানিক নিজেদের মধ্যে। স্বরচিত বা প্রচলিত সাহিত্যকীর্তি ‘অভয়া দুর্গার নাম লিখিলাম দ্বারে’ ইত্যাদিও লেখা হত ঠাকুমা-জেঠিমাদের তত্ত্বাবধানে। পণ্ডিতমশায়ের কাছ থেকে বাবা খবর নিয়ে আসতেন আগমনের শোভাযাত্রার সময়সূচির। গজে বা ঘোটকে আগমনের ফলাফল নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করত সবাই। আর ষষ্ঠীর সারা রাত মণ্ডপে কাজ চলত চালচিত্র, ডাকের সাজ, চাঁদমালার। শেষ মুহূর্তের হাজার খুঁটিনাটি কাজ। সপ্তমীর সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক দৌড়ে দেখে আসা, মাটির পুতুল পুতুল মূর্তি রাতারাতি কেমন দুগ্গা ঠাকুর হয়ে উঠেছে। তার পর ঘট আনবার শোভাযাত্রা। পথের দু’পাশে প্রতিটি বাড়ির সামনে আলপনা, মঙ্গলঘট। গ্রামের দিঘি থেকে উঠে এসে সত্যি সে দিন আমাদের সঙ্গে পথ চলতেন এক দেবী। পুজোর জামা, না-শুকোনো খড়িমাটি আলকাতরার গন্ধ, সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর হাতে ধরা পদ্মকলির গন্ধ আমার চিরচেনা গ্রামের রাস্তাটাকে ‘সাররিয়্যাল’ করে তুলত!

আমার এখানে আকাশে মেঘ, হালকা বৃষ্টি। দেবীর কি এ বার গজে আগমন? হে অভয়াবাহন মহাগজ, বচ্ছরকার দিনে একটু সামলে চলো। কোন দূরগ্রামে, কত পিছনে ফেলে আসা আমার এই দিনগুলি যারা আবার সেই একই ভাবে উপভোগ করছে, পদ্মকলির সুগন্ধ থেকে তারা যেন আজ বঞ্চিত না হয়।

সপ্তমীর সন্ধ্যা
পেট্রোম্যাক্সের আলোয় ঝলমল করে উঠেছে মণ্ডপ। সপ্তমীর সন্ধে। আনন্দ আজ আমাদের ছোট্ট মন্দির, পথ-ঘাট, গ্রামের সীমানা ছাপিয়ে উপচে পড়ে। পেট্রোম্যাক্সের অপার্থিব আলোর সেই বিচ্ছুরিত আনন্দের টানে ভিড় জমায় আশেপাশের চার পাঁচটা গ্রামের লোকজনও। কেয়াদির শ্বশুরবাড়ি থেকে এ বার আসতে
দেয়নি, মিলনকাকুর চাকরিটা চলে গিয়েছে পুজোর মুখে, নারান দাদুর তিন ছেলে ও চার মেয়ে সবাই নাকি এ বার খুব ব্যস্ত, পুজোতে আসছে না কেউই। তবু আকাশে সপ্তমী তিথির আধখানা চাঁদই চরাচর ভাসায়। সেই আলোতে কেয়াদির মা, মিলনকাকু, নারান দাদু সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে যান। আজ যে সপ্তমীর সন্ধে!

বাড়িতে মা-বাবা-ঠাকুমার মন খারাপ। বোনও এ বার পুজোয় শ্বশুরবাড়িতে। তিন বছরের তিতলি আসতে পারলে একাই সারা মামাবাড়ি ভরিয়ে রাখত। সে সব কিছু থাক না থাক, তবু আজ সপ্তমী। মা হয়তো একা একাই একবার মণ্ডপে যাবে সন্ধেবেলা। সেখানে বোনের আর আমার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হলে মনটা আর একটু বেশি খারাপ হবে!

অফিসের জানালা দিয়ে মেঘাচ্ছন্ন ধূসর আকাশ দেখি আমি। বাবা, তোমার প্রিয় কবির লেখা থেকে ওই লাইনগুলো আজ একটু পড়ে শোনাবে আমাকে? ওই যে—
শারদীয়া সপ্তমীর রাতি।
আকাশের পেটিকা খুলিয়া
পুরাতন জীর্ণ নীল সাটি
সাবধানে অঙ্গে আঁটি
চলিয়াছে প্রৌঢ়া রাত্রি প্রতিমা দর্শনে।
ওগো রূপ কোথা আছে?


মহাষ্টমী
আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হবে অষ্টমীর সন্ধিপুজো। ঢাক-কাঁসর-ঘণ্টা থামিয়ে দিয়ে চলবে শুধু গম্ভীর
মন্ত্রোচ্চারণ। ধুনোর ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে লৌকিক অলৌকিক। স্পষ্ট দেখব, প্রাণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে মাটির মূর্তিতে। জীবন্ত হয়ে উঠবে ত্রিনয়ন, নিঃশ্বাসের ওঠাপড়ার ছন্দে দুলে উঠবে ফুল-বেলপাতা। পুজোর পাশাপাশি চলবে চণ্ডীপাঠ,
জ্বালাকরালমত্যুগ্রম অশেষাসুরসুদনম।
ত্রিশূলমপাতুনোভিতের-ভদ্রকালী নমঃস্তুতে।।

শান্ত পুরোহিতমশাই উত্তেজনায় সম্পূর্ণ বদলে যাবেন। ‘জয় মা, মা গো’ চিৎকার করে উঠবে সকলে মিলে। বিশাল তলোয়ারটা মাথার উপর এক বার ঝিকিয়ে উঠে নেমে আসবে চালকুমড়োর উপর। সেই খণ্ডমুহূর্তে মৃন্ময়ীর চোখের পাতা কেঁপে উঠবে, ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে আরতি। এক ঘণ্টা চলবে সেই আরতি। আর অলৌকিক বিশ্বাস বুকে নিয়ে, রুদ্রাণী দেবীকে শান্ত করবার জন্য খোল-করতাল নিয়ে কীর্তনের সুরে গলা মেলাবো আমরা সবাই— তারা মহামায়ে করহে আরতি। পুরোহিতমশায়ের তিন প্রজন্মের পূর্বপুরুষ দ্বিজ শশীভূষণের রচনা আরাধনাগীতি, প্রতি বছরের মতো এ বারও মর্তলোক ছাড়িয়ে পিতৃলোক ও দেবলোকের দিকে উঠে যাবে। শশীভূষণের উত্তরপুরুষেরা অষ্টমী ও নবমীর সন্ধি ক্ষণে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে প্রতিবারের মতো গাইবে—
তখন মা মহামায়া
প্রকাশে নিজ দয়া...


নবমীর সন্ধ্যা
যেও না রজনী আজি লয়ে তারাদলে!
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে...

উৎসবের আনন্দঘন মুহূর্ত ধরে রাখার কি ব্যাকুল প্রয়াস। নবমীর রাত দীর্ঘতর করে তুলতে গ্রামে বসত যাত্রাপালার আসর। রাজা শিখিধ্বজের ‘যাও মধুছন্দা’র হাহাকার যদু হাজরাদের গলায় কত বার বেজে উঠতে শুনেছি এমনই নবমী রাতে। চায়ের দোকান ছেড়ে এসে সিরাজের তলোয়ার নিয়ে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন
ক্ষিতীশ কাকু। মোটা দাগের ‘ভাইজান! তুমি আমাকে ভাইজান বলে ডাকলে...?’ সংলাপে কাসেম আলির মত ক্রুর খলনায়ক বদলে গেছে নায়কে। তিন মাসের রিহার্সালের পরও, অভিনয়ের দিন বিকেলে ডায়ালগ নিয়ে হিমসিম খেয়েছে ছোটনদা। কিশোর সিন্ধুর ভূমিকায় মঞ্চে মৃত্যুতেও অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছি এক দিন— কী সুন্দর ভাবে মারা গেল, দেখলি?

আর যার জন্য এত আয়োজন— নায়ক, খলনায়ক, বিবেক আর কিশোর সিন্ধুদের এত আকুতি, সে সর্বনাশী অনিবার্য ভাবে ভ্রূক্ষেপহীন চলে গিয়েছে দশমীর মন। খারাপের ভোরবেলায়!

বিজয়া দশমী
এ বার সময় হয়েছে, বিসর্জনের কান্নাভেজা বোল উঠেছে ঢাকে। আলতায় রাঙা করে দাও ওঁর পা, সিঁদুরে রাঙিয়ে দাও গাল। এ বারের মতো শেষ দেখে নাও দর্পনে প্রতিবিম্বিত শ্রী। তার পর মাটি ফিরে যাবে মাটিতে, হৃদি ভেসে যাবে নদীজলে। তা যাক, আমরা আবার আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করব। সারা বছর ধরে অতলজলে দম বন্ধ করা ডুব দিয়ে তুলে আনব ওই মাটি, খুঁড়ে আনব ওই হৃদয়। হাসি মুখে তাই আজ বিজয়ার কোলাকুলি, চলে যেতে হবে জেনেও বিষাদহীন অমোঘ উচ্চারণ— তুমি সুন্দর, আমি ভালবাসি। তার পর সকাল-বিকেল দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকব পথ চেয়ে— মেয়ের পথ চেয়ে, বোনের পথ চেয়ে, মায়ের পথ চেয়ে। মাটিতে পা না ফেলে হেঁটে যাওয়া, গর্বিত সেই সব বান্ধবীদের পথ চেয়ে। বছর শেষে ফিরে তো তাকে আসতেই হবে আমার কাছে। বিসর্জন শব্দের মধ্যেই তো আছে সৃজ, আবার সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি। বিসর্জন মন্ত্রেই তো আছে ‘পুনরাগমনায় চ’!
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.