আবহমান সংস্কৃতির টানে
শুভশ্রী নন্দী
আটলান্টা, আমেরিকা যুক্তরাস্ট্র
গ্রীষ্ম শেষের ফর্সা ধবধবে আকাশে মেঘের দোয়াত উল্টে দিল বর্ষা। আর তার পর পরই ঝরঝরে শরতে দল বেঁধে মেঘেদের সকাল বিকেল পায়চারি, হাত ধরাধরি করে। একঘেঁয়েমি কাটাতে কখনও জলরঙের ছোঁয়ায় নীল হয়ে যায় আকাশের ক্যানভাস। এ সবের পাশাপাশি খোঁজ পড়ে পাঁজি আর বাংলা ক্যালেন্ডারের। শুক্লা প্রতিপদে দেবী চণ্ডী স্থাপিত হন ঘটে। পুব বাংলা থেকে আসা পূজারী মহেন্দ্র কাব্যতীর্থ, পুজোর আয়োজনে পুরোহিত মশাই়কে এগিয়ে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত তন্ত্রধারক দেওঘরিয়া, প্রশস্তিবন্দনা, রামতনু নায়েব, খাজাঞ্চি খুড়ো— বিগত শতাব্দীর সাদা-কালো ছবিগুলো নেচে বেড়ায় মনের পর্দায়!

স্মৃতির ঝাপটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় স্থান কালের দেওয়াল। পৌষ মাস যেমন চাষিদের ধান ভাঙতে ব্যস্ত হওয়ার সময়, তেমনই গল্প বুনতে বা উপন্যাস বাঁধতে ব্যস্ত লেখকদের ঋতু শরত। শারদীয়ার মলাটের প্রচ্ছদে শিল্পীর হাতের টানে ফুটে ওঠে দুর্গার কত নতুনত্ব ঘেঁষা অকল্পনীয় ঘরোয়া ও দৈবিক রূপ। সম্পাদকদের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রচেষ্টায় আলোর মুখ দেখে রবীন্দ্রনাথের অনাবিষ্কৃত চিঠি।

চেনা পথে না এসে আমার জীবনে দুগ্গাপুজো ধরা দিয়েছে একটু ব্যতিক্রমী ভাবে। যে কোনও সাদা কালো ছবিতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারদের চেহারা যেমন হয়, আমার প্রবল প্রতাপী প্রপিতামহ ছিলেন তেমনই। তিনি সংকল্প করেছিলেন, মূর্তি পুজো না করতে পারলেও বংশপরম্পরায় ঘট পুজো চলবেই। এ কথা বলার সময় পারিবারিক ভাবে আর্থিক অবনতির সম্ভাবনা তাঁর মাথায় থাকলেও খেয়াল হয়নি যে, কোনও এক দিন বংশে পুত্রের সংখ্যা কমে কন্যা সন্তান বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। আজও সাড়ম্বরেই যৌথ পরিবারের সেই পুজো হয়। ১২৫ বছরের বাড়ির পুজোর ইতিহাসের বিরল তকমাও জুটেছে। আর আমি সেই কৃতিত্বের সহজাত ‘দাবিদার’ চতুর্থ প্রজন্মের এক জন হয়ে। শাক্ত পরিবারের প্রথা মেনে সেই পুজোয় উপাচারে পশুবলি দেওয়া হত। বৈষ্ণব পরিবার থেকে আসা আমার ঠাকুমার চোখ কান বুজে তাতে নীরব অসমর্থন দেখতে দেখতেই আমার বড় হয়ে ওঠা। অন্য সবার বিদ্যার দৌড় সন্ধিপুজো পর্যন্ত হলেও ঠাকুমাদের গল্পের ঝুলি থেকে নিয়ে আজও আমি গড় গড় করে বলে যেতে পারি ‘সর্বত ভদ্র মণ্ডলী’ বা আসনের নির্দিষ্ট মাপ ও পুজোর তাত্পর্য। এই আসনের উপরেই ঘট বসানো হয়। মণ্ডলীর আলপনার প্রয়োজনীয় ৫টি রং ও তার উপাদান— সাদা (ময়দা), লাল(আবির), সবুজ (বেলপাতা শুকিয়ে গুঁড়ো করা), কালো (ধূপের গুঁড়ো), হলুদ (হলুদ গুঁড়ো) যা আজও চলে আসছে। আলপনা পুরোহিতই আঁকেন। এর একটা ব্যাখ্যা আছে। সপ্তমীর রাতে পরিবারের সকলে ১টি করে কলা আর যে কোনও মূল্যের ১টি করে মুদ্রা দিয়ে মণ্ডলী দর্শন করার পর সেখানে ৫টি ঘট বসিয়ে নির্দিষ্ট দৈর্ঘের কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। ওখানেই হয় সন্ধিপুজো। এমন আরও কত কথা! শহর কলকাতায় ছুটি কাটাতে গেলে অনেক বন্ধুদের আঁতকে ওঠা চোখে দেখতাম মহিষবলি নিয়ে প্রচ্ছন্ন ধিক্কার। ছেলেবেলার দুর্গাপুজো তাই আমার গৌরব, দ্বিধা ও সংকোচের গুঁড়ো মেশানো।

আমার অধ্যাপক বাবা পুজোর আগে তাঁর চাইতে ঢের গুণ স্বচ্ছল ব্যবসায়ীর বাড়ির উদ্দেশে বেরোনোর সময় বলতেন, ‘প্রজাদের কাছে খাজনা আদায়ে যাচ্ছি’। ঘটনাচক্রে সরকারি কেরানি হয়ে যাওয়া ছেলের বাবা রামতনু নায়েব তখনও আয়তক্ষেত্রাকার লাল খাজাঞ্চি খাতা সমেত হিসেব কষতে ঢুঁ মারতেন বাড়িতে।

জীবনের প্রথম ব্যান্ডও দেখেছি পুজোর হাত ধরেই। সে আমাদের পারিবারিক ব্যান্ড। যৌথ পরিবারের জ্যাঠা, কাকা কেমন পেশাদারিত্বের সঙ্গে ঢাক-কাঁসর-করতাল মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বাজাতেন। সারা বছরের কোনও মহড়া ছাড়াই নির্ভুল তালে ছন্দে থাকত সেই ‘কনসার্ট’। এখনও পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, যে পুজোতেই যাই না কেন, শত ভিড়ের মাঝে পুজো মণ্ডপের পাশে ম্যারাপে থাকা সেই বাজনার জায়গাটা আমায় আজও গিলে খায়। যৌথ পরিবারে বংশের অচেনা ডালপালা-শাখা-প্রশাখা চেনার উপযুক্ত সময় ছিল ওই দুর্গাপুজো। সেই ব্যান্ড পাততাড়ি গোটানোর আগেই হাওয়ায় মিলিয়েছিল যৌথপরিবার নামের সমাজব্যবস্থাও।

আমার জীবনে পুজোর অভ্যুত্থান দ্বন্দে ও ছন্দে। উত্তর ইউরোপের ফিনল্যান্ডের ছোট্ট শহরে পুজোর দিন কাটত চোখের জল গালে শুকিয়ে। সেই নোনতা দুঃখ নিজের সঙ্গে ভাগ করা ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ঝাপসা চোখের জলছবিতে নড়েচড়ে উঠত পুজোর কত হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। আমেরিকাতে প্রত্যেকটি মেয়েই দশভুজা! এখানে মেয়েরা সব কাজ সামলে জুড়ে যায় পুরুষদের সঙ্গে পুজোর মণ্ডপ তৈরিতে। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে। কাঠ কিনে, তক্তা থেকে হাতুড়ি পিটিয়ে ফ্রেম তৈরি এবং তাঁকে সাজানো অবধি। মণ্ডপের সাজসজ্জা কোনও প্রতিযোগিতা বা পুরস্কারের অন্তর্ভুক্তিতে নেই জেনেও, কাজ করেন এঁরা। নৈবেদ্যর জন্য বানানো দেড়শো-দু’শো সন্দেশ। এদেরই পরিশ্রমের ফল হিসেবে একশো আটটি টাটকা পদ্মফুল অকালবোধনের থালায় হাসে।

এখানে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার পুরোহিত শুক্রবার অর্ধেক দিন অফিস করে ফিরে পুজোর তিন দিন নিরামিষ খেয়ে, নিষ্ঠা ভরে পুজোর ইচ্ছেয় বইয়ের তালিকা মিলিয়ে লিস্টি ধরিয়ে দেন। আর সেই তালিকা মেনেই চলে আসে গঙ্গাজল-কর্পূর-সহ পুজোর সমস্ত উপাচার। তিথি দিন ক্ষণ মিলিয়ে নয়, সপ্তাহান্ত খুঁজে মাইকের গমগমে আওয়াজে বাতাসে ভাসে পুজোর মন্ত্র। চলে অঞ্জলি দেওয়ার পর্ব। বাঙালির উত্সবের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হাত ধরাধরি করে চলে। তাই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মালা ঘিরে রাখে তিনদিনের পুজোকে। সত্তরের দশকে এই পুজোতেই সল্টলেকে দেখেছিলাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক।

উত্তর আমেরিকাতে আর এক প্রাপ্তি পুব বাংলার জগদীশপুরের দত্তচৌধুরীদের বাড়ির পুজো। ঘাস কাচিয়ে শিশিরের জল সঞ্চয় করা, গুনে গুনে একশো আটটি দুব্বো তোলা, কাপড় কিনে মেশিনে সেলাই করে মঞ্চের পর্দা বানানো— সবই হচ্ছে একাগ্রতায়। দুর্গাপুজোর চিত্রকল্পগুলো যেন ডকুমেন্টারি ছবির টুকরো। সকালের করজোড়ে অঞ্জলির চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা চেহারার সন্ধের ধুনুচি নাচ। সন্ধ্যারতির পঞ্চপ্রদীপের আগুনের তাপ অথবা দশমীতে সিঁদুর-শাড়ি-মুখ সবেতেই লাল রঙের প্রাণখোলা খেলার আমেজ। নবমীর আরতির বাজনার শব্দের ভিড় ছাপিয়ে বেরিয়ে আসে গলায় আটকে থাকা আবেগ— আসছে বছর আবার হবে। বিসর্জনের বেদনায়, দৈনন্দিন বেদনাকে জড়িয়ে ফেলি আমরা। ঘরের মেয়ে ও উমাকে বাঙালি গুলিয়ে ফেলতে ভালবাসে। জল চোখে মিষ্টি মুখে দুর্গা যাত্রা আর মেয়ের বাপের বাড়ি ছাড়ার দৃশ্যে কোনও তফাত্ রাখেনি বাঙালি।

অসুর নিধন উপাখ্যান তো দুর্গাকে চিরনায়িকা করে তাঁর দৈবিক রূপকে কালজয়ী করেছে। সেই শক্তিতেই তো সকাল থেকে সন্ধে কত আসুরিক শক্তির মোকাবিলা করি আমরা মেয়েরা। মনে পড়ে মফস্সলে আমার বাল্য কৈশোরের শহরে, ভাসানে ট্রাকজোড়া হয়ে যেতেন দুর্গা। সঙ্গে টুইস্ট নাচ আর ধুনুচির মিশেলে পায়ে পায়ে এগোতো মিছিল। আর ঠিক এর বিপরীত চিত্রে, রাতের অন্ধকারে ট্রাকভর্তি হয়ে সেই টুইস্ট নাচিয়েরা লোকসুরে গাইতে গাইতে ফিরত ‘মারে ভাসিয়া জলে কি লইয়া ফিরমু ঘরে’! খালি গলায় সে গানের কান্না যেন বাতাসে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভাসত। ভাসানের আর এক রূপ মনে পড়ে, পোর্ট ট্রাস্টের জাহাজে চেপে মধ্য গঙ্গায় ভাসতে ভাসতে তীরের ভাসান দেখা। কাঁপা কাঁপা জলে ধুয়ে যাচ্ছে টুকরো টুকরো পুজোর স্মৃতি— গঙ্গার বুকে ভাসছে জাহাজ, জাহাজে ভাসছি আমরা। ডুবতে উন্মুখ মা ভাসছেন জলে। মূর্তি তো নয়, সারা বছরের প্রতীক্ষা, কুমোরটুলির তিলে তিলে গড়া শ্রম, প্রাণ প্রতিষ্ঠার শপথ— আসছে বছর, আবার হবে— সব মিলেমিশে বিষাদ মাখানো ‘মিস্টিসিজম’ বাতাসে। এর পর কান্না ভোলাতেই যেন আনন্দের মিলনোত্সব বিজয়া আসে।

ঘরের তৈরি ফটফটে সাদা ক্ষীর-নারকেলের সন্দেশ, সঙ্গে কুচো নিমকি ভরা ধবধবে সাদা কাগজের প্লেট। সদলবলে মুখে কুড়মুড়ে শব্দে গুঁড়ো হচ্ছে তারা। সঙ্গে অ্যান্টিক আচার, বিচার, কোলাকুলির ঢেউ আর পেন্নামের ঠ্যালা। আশীর্বাদের বন্যায়, নোয়ানো মাথার ভিড়ে, এক এক জনকেই যেন কত বার করে প্রণাম করা হয়ে যাচ্ছে! বিজয়া মেলাত সারা বছর মুখ দেখাদেখি-বন্ধ বন্ধু, স্বজন ও প্রতিবেশীদের।

বিষাদ নয়, এ গল্প আনন্দের। সব বিষাদ ফিকে হয়ে যায়। শত নিন্দুকও থমকে যায়, যখন দেখি প্রবল উন্নাসিক থেকে তস্য সাধারণ বাঙালি মুখ প্রবাসে ওয়েবসাইট ঘেঁটে নিকটতম স্থানীয় দুর্গাপুজো খুঁজে নেয়। সাধ্যাতীত ব্যয় করে মোটেলে থেকে হাজিরা দেয় সেখানে। সেই নিকটতম জায়গা কখনও হয় একশো মাইল দূর, কখনও হয় অন্য রাজ্য। লং ড্রাইভ করে ফিরে যাওয়ার আগে দেখা যায় মধ্য বয়সের ‘যুবক’কে তন্ময় হয়ে ‘সেরা বাঙালি’ হিসেবে ধুনুচি নাচতে। স্যুট, বুট, টাই-এর ফাঁসে বাঁধা প্রবল সাহেবসুবো বাঙালির বাঙালিত্ব বছরের ওই তিনটে দিনে তেড়েফুঁড়ে ওঠে এই দূর প্রবাসেও। ক্রিসমাসে পাশ্চাত্যবাসীরা আরও পারিবারিক ও অন্তর্মুখী হয়ে গৃহবন্দি হয়ে গেলেও বাঙালি কিন্তু উত্সবে আরও বেশি করে বেরিয়ে আসে। সে বেরিয়ে আসা শুধু মানুষ হিসেবে নয়, বেরিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আবহমানতা নিয়ে আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.