পাতাঝরা মরসুমে আগমনীর গান
রূপসা মণ্ডল দাশগুপ্ত
বস্টন, আমেরিকা
ক ঝাঁক বুনোহাঁস উড়ে গেল বারান্দার সামনে দিয়ে। শীত পড়ার আগে ওরা উড়ে যাচ্ছে উষ্ণ আশ্রয়ের দিকে। আমাদের অবস্থা অনেকটা ওদের মতোই। শীত গ্রীষ্মের নিয়ম মেনে ঠাঁই বদল না করলেও, কাজের সূত্রে ‘পরিযায়ী’ তো বলাই যায়। মে মাসে বস্টন এসেছি। কাউকে চিনি না। দু’ এক ঘর ভারতীয়ের দেখা মিললেও বাঙালি জোটেনি। এ দিকে গুছিয়ে বসবার আগেই পুজো এসে গেল। এখানে পুজো হয় পাতাঝরার ঋতুতে— চারিদিকে হলুদ, কমলা, তীব্র লালের সাজ। শরতের থেকে অন্য রকম হলেও সত্যিই সুন্দর। তবে শিউলি, শিশির, কাশ ও ঢাকের আওয়াজের অভাব মানিয়ে নিতে হয়।

ধরেই নিয়েছিলাম, পুজোর আনন্দ এ বার আমাদের কপালে নেই। ওয়েব ঘেঁটে কয়েকটা পুজোর খবর পেলাম। তাদের মধ্যে সুবিধাজনক দূরত্বে ‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ নিউ ইংল্যান্ড’-এর পুজো। সেখানেই যাওয়া হবে। তার পর ১১ থেকে ১৩ অক্টোবর— তিন দিন যেন আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া জলের মতো বেরিয়ে গেল। কত নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কত পুরনো মুখ খুঁজে পাওয়ার আনন্দ মিশে গেল পুজোর গন্ধে।

‘বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ নিউ ইংল্যান্ড’-এর পুজোয় আমরা এক রকম অতিথি। প্রথমে প্রতিমার কথা বলি। ১০ বছরের পুরনো এই পুজোয় এ বার নতুন দুর্গা এসেছেন সাগরপারের কুমোরটুলি থেকে। সুন্দর ঝকঝকে সোনালি সাজ দুর্গা ও তাঁর ছেলেমেয়েদের। আগামী কয়েক বছর এই প্রতিমারই পুজো হবে। কারণ কলকাতার মতো বছর বছর মূর্তি বদল এ দেশে বিলাসিতা।

১১ তারিখ রাতে ছিল ঘরোয়া খাবারের আয়োজন। সদস্যরাই রান্না করেছেন। খাবার টেবিলে আমরা নতুন মুখ। বাকিরা সকলেই প্রায় পুরনো। ওখানেই আলাপ হল গৌতমবাবুর সঙ্গে। আমার ছেলে বাংলা শিখছে না বলাতে জানালেন, ওঁর একটা বাংলা শেখানোর স্কুল আছে। শুধু ভাষা নয়, বাঙালিয়ানার সব কিছুই শেখানো হয় সেখানে। তিন দিনে ওঁর সঙ্গে যত বার দেখা হল তত বার হাসিমুখে আমাদের ভাল লাগছে কি না খবর নিয়েছেন।

আমার ৫ বছরের ছেলে অঞ্জলি দেওয়ার সময় ফিসফিস করে জানতে চাইল, মন্ত্র কি স্প্যানিশে বলা হচ্ছে? তবে মন্ত্র সে ঠিকঠাক না বলতে পারলেও প্রসাদ খেল চেটেপুটে। মেখলার সুবাদে আলাপ হল শিলচরের মেয়ে রাকার সঙ্গে। সন্ধের অনুষ্ঠানে যাদবপুরের এই প্রাক্তনী খুব সুন্দর আবৃত্তি করেছিল একটা আলেখ্যর সঙ্গে। ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রে নানা ভাবনার মিলমিশ ও গানের ব্যবহার নিয়ে এক অনবদ্য অনুষ্ঠানে শতভিষার স্ক্রিপ্ট, শরণ্যার গান ও রাকার পাঠ সবই নিখুঁত। আগের দিনের বাচ্চাদের অনুষ্ঠান আমরা দেখিনি। শুনেছি সেটাও নাকি খুব ভাল হয়েছিল। এ দিন লোকগানের সঙ্গে নাচের অনুষ্ঠানও খুব উপভোগ করেছি। দেখার ফাঁকে ফিরে যাচ্ছিলাম আমার শহর বহরমপুরের পুজোয় পাড়ার মঞ্চে ছোটদের নিয়ে ‘রাম রাবণের ছড়া’ নাটক ও কলকাতার আবাসনে মেয়েদের নিয়ে ‘পূজারিণী’ নৃত্যনাট্যে আমার অতিব্যস্ত পুজোর সন্ধ্যায়।

শেষ দিন দুপুরে অদ্ভুত ভাবে জুটে গেল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক চেনা মানুষজন। দুপুর থেকে রাতের খাওয়া পর্যন্ত চলল ম্যারাথন আড্ডা। ছেলেবেলার পুজোর দিনগুলোয় ঝরা শিউলি কুড়োনোর মতো কুড়িয়ে নিচ্ছিলাম টুকরো টুকরো দৃশ্য— বর্ষার বকুলবীথি, বসন্তের জারুল-শিমুল-রাধাচূড়া ছড়ানো পথ, টিং টিং পাহারাদারের সাইকেল ঘণ্টির জানান দিয়ে যাওয়া— খোকাখুকুরা এ বার ভালয় ভালয় যে যার হস্টেলে সেধিয়ে পড়ো। রাত দশটায় লেডিস হস্টেলের গেট বন্ধ হওয়া, বন্ধ গেটের দু’ধারে প্রেমিক প্রেমিকাদের লাস্ট মিনিট বাক্যালাপ— সব এসে ভরিয়ে দিল প্রবাসী শারদোৎসব। দীপান্বিতা তুলনামূলক সাহিত্যে আমার জুনিয়র ব্যাচ। আমাদের কাছে শিবাজীদার (অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়) ‘সত্যান্বেষী’-তে অভিনয় একটা বিরাট খবর। কী ভাবে সিনেমাটা তাড়াতাড়ি দেখে ফেলা যায় দু’জনে তাই নিয়ে পরিকল্পনা করলাম। দিনের শেষে বাংলা ব্যান্ড ‘কায়া’র অনুষ্ঠান— সবাই নেচে-গেয়ে মেতে উঠল। এক সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডায় প্রিয় গায়ক ছিল শুভ। আজ সে স্ত্রী কন্যা নিয়ে আমাদের সঙ্গে দর্শকাসনে। কায়ার গান কি ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পুরনো গানধোয়া দিনে?

বিজয়ার সন্ধ্যা আমার কাছে আনন্দ ও বিষাদময়। তবে নস্ট্যালজিয়া সিক্ত। গত বছরের পুজো কেটেছিল আটলান্টাতে। সেখানেও পেয়েছিলাম অনেক পুরনো বন্ধুদের। এ বছর তাদের থেকে অনেক দূরে। পরের পুজো কোথায়, কাদের সঙ্গে কাটবে জানি না! ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’, হয় তো আমরাও ফিরব এক দিন!
 



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.