বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছোটদের অনলাইন আড্ডায় দরাজ
ফেসবুক, উস্কে দিল নয়া বিতর্ক

কেউ বলছেন গেল-গেল! কারও মতে, এতে আর নতুন করে কীই বা এল-গেল! বিতর্কটা তবু জোরালো ভাবেই চাগিয়ে উঠছে। নাবালকদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি নতুন নিয়ম নিয়ে অভিভাবকদের কারও কারও কপালে চিন্তার ভাঁজ পুরু হতে শুরু করেছে।
দুশ্চিন্তার নেপথ্যে বুধবারের একটি ঘোষণা। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিচ্ছেন, নাবালকদের হাতে স্বাধীন মেলামেশার একটি বাড়তি অস্ত্র তাঁরা তুলে দিচ্ছেন। টিন এজাররাও এ বার চাইলে তাদের ছবি বা বক্তব্য সবার সামনে তুলে ধরতে পারবে। এত দিন এই সুযোগ পায়নি ছোটরা। ওই কিশোর-কিশোরী বা বালক-বালিকাদের ‘বন্ধু’ বা ‘বন্ধুর বন্ধু’ তালিকাভুক্ত নয় এমন কেউ ওই খুদেদের ছবি-লেখা চাক্ষুষ করার সুযোগ পেতেন না। এই বাধাটাই এ বার দূর করে দিচ্ছেন ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। অ্যাকাউন্টে নতুন কোনও ছবি বা লেখা ‘পোস্ট’ করার সময়ে ফেসবুকের তরফে প্রথমে খুদেদের জানানো হবে, এ সব লেখা বা ছবি কিন্তু সকলে দেখতে পাবেন। অ্যাকাউন্ট-মালিকের তাতে আপত্তি না-থাকলে সেই পোস্ট’ ‘পাবলিক’ বা সর্বসাধারণের জন্য দৃশ্যমান হবে। তবে ব্যক্তিগত পোস্ট বা ছবি সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কেও মাঝে মাঝে সতর্ক করা হবে ছোট অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের।
নাবালকদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-আসক্তি নিয়েই এতদিন বড়দের কারও কারও যথেষ্ট অস্বস্তি ছিল। এ বার ক্যালিফোর্নিয়ায় ফেসবুকের সদর দফতর থেকে এই ঘোষণা সংবাদসংস্থা মারফত প্রচার হতেই উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। বড়রা যে ভাবে তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের খুঁটিনাটি মর্জিমাফিক কার সামনে তুলে ধরবেন বা তুলে ধরবেন না, সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, নতুন নিয়মে ছোটরাও ততটাই অধিকার পাচ্ছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ যতই বলুন, পোস্ট বা ছবি সবাইকে দেখানোর ব্যাপারে বাচ্চাদের মাঝে মাঝে সতর্ক করা হবে, সমস্যাটা কিন্তু অন্য জায়গায়।
সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া বা ‘শেয়ার’ করাটাই তো ফেসবুকের মূল উদ্দেশ্য। সেখানে ছোটরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? বিপণনের ক্ষেত্রেও তো ওরা অতি উত্তম লক্ষ্য। কারও কারও মত, স্মার্টফোনগুলিতে সুলভ হোয়াট্সঅ্যাপ বা স্ন্যাপচ্যাট-এর মতো আড্ডার মাধ্যমের উদ্ভবের পরেই ফেসবুক নিজেদের বাজার ধরে রাখতে এই পদক্ষেপ করছে। জনপ্রিয়তম সোশ্যাল নেটওয়ার্ক হয়েও ছোটদের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতেই কিছু কড়াকড়ি তারা শিথিল করছে।
তবে ছোটদের এতটা স্বাধীনতা দেওয়া ঠিক কি না, তা নিয়ে দানা বাঁধছে বিতর্ক। শিশু মনস্তত্ত্ববিদ হিরন্ময় সাহা যেমন, ছোটদের চ্যাট করা বা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। এ সব অভ্যেসের দরুণ ছোটদের বই পড়ার অভ্যেস, খেলাধুলো, সামাজিক মেলামেশা— সবই লাটে উঠছে বলে তিনি মনে করেন। তা ছাড়া নাবালকেরা বাজে লোকের পাল্লায় পড়তে পারে বলেও তাঁর আশঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের সেটিংয়ে আরও কিছুটা কড়াকড়ি থাকাই কাম্য ছিল বলে হিরন্ময়বাবুর বক্তব্য।
ছোটদের ফেসবুক ব্যবহারে আরও একটা চিন্তার বিষয় রয়েছে। এই জনপ্রিয় সাইটের মাধ্যমে অনলাইনে কিশোর-কিশোরীরা একে অন্যকে উত্যক্তও করে, এমন নজিরও আছে। যার জেরে গত সেপ্টেম্বরেই ফ্লোরিডায় বছর বারোর মেয়ে রেবেকা অ্যান সেডউইক আত্মঘাতী হয়েছে। পরে জানা যায়, তার বন্ধুরা তার সম্পর্কে ধারাবাহিক ভাবে খারাপ মন্তব্য লিখত ফেসবুকে।
তবে ফেসবুকের নিয়ম শিথিলে ছোটদের ক্ষতিই হবে, এমনটা মনে করছেন না সমাজবিজ্ঞানী প্রশান্ত রায়। তাঁর মতে, প্রত্যেক বয়সের ছেলেমেয়েরই নিজস্ব রুচি রয়েছে। সেটা অনেক কিছুর উপরে নির্ভরশীল। যা খুশি লিখতে ইচ্ছে হলেই কেউ তাই লিখে দেয় না। কোন বন্ধুদের সঙ্গে তার ওঠাবসা, বাড়ির পরিবেশ সব কিছুই গুরুত্বপূর্ণ।” তবে ফেসবুকে কোনও বন্ধুর পরিচয়, ছবি, সবই জাল হতে পারে, এটা চিন্তার বিষয়, বলছেন প্রশান্তবাবু।
শহরের একটি নামী স্কুলের অধিকর্তা দেবী কর অবশ্য বলছেন, “সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এখন সবারই জীবনের অঙ্গ। বাচ্চাদের বকে-ঝকে ও সব থেকে সরিয়ে রাখায় আমার সায় নেই। তবে বাচ্চাদের স্কুলে বা বাড়িতে ফেসবুক-টুকের বিপদের দিকগুলো অবশ্যই বোঝাতে হবে।” মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মনে করাচ্ছেন, ইন্টারনেটের যে কোনও সাইটে ঢুকে পড়তেই বয়স আর বাধা নয়। বড়জোর ওয়েবসাইটের তরফে জানতে চাওয়া হয়, যিনি দেখছেন তাঁর বয়স আঠারোর কম কি না। তার পর কিন্তু সচরাচর বয়স যাচাইয়ের সুযোগ থাকে না। সাধারণ অভিজ্ঞতা বলে, ফেসবুকেও বয়স ভাঁড়িয়ে ছোটদের ঢুকে পড়ার নজির ভুরি ভুরি। ১০ বছরের বাচ্চারাও বয়স লুকিয়ে ফেসবুক করে, এমন নমুনা হাতের কাছে মিলবে। অনুত্তমার মতে, “ফেসবুক ছোটদের ব্যাপারে তাদের নিয়ম সামান্য আলগা করায় নতুন করে সমস্যা বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তবে দেখতে হবে, কী ভাবে ছোটরা নিরাপদে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারে।”
ছোটদের ছবি বা লেখা সবার সামনে তুলে ধরার ছাড়পত্র দেওয়ার পিছনে ফেসবুকের তরফেও নিজস্ব যুক্তি রয়েছে। উঠে এসেছে, পাকিস্তানের তালিবান-অধ্যুষিত এলাকায় নারী শিক্ষার মুখ মালালা ইউসুফজাইয়ের কথা। কিশোরী মালালাও কিন্তু ফেসবুকের পেজ-এর মাধ্যমেই তার দেশের মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে তহবিল গড়তে শুরু করেছে। ছোটদের লেখা সকলে দেখতে পেলে তাদের মাধ্যমে অনেক ভাল কাজ চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের দাবি, ছোটদের বন্ধু তালিকা বা পরিচিত-মহলের বাইরের কেউ তাদের গোপন বার্তা (প্রাইভেট মেসেজ) পাঠাতে পারে না। যদিও এ ক্ষেত্রেও রয়েছে ফস্কা গেরো! মানে বয়স লুকিয়ে অ্যাকাউন্ট তৈরি করলে কোনও বাধা নেই।
সল্টলেকের একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্রী এক কিশোরী এ সব নিয়ম-টিয়মের কথা শুনে হেসেই কুটিপাটি। ১৫ বছরের কিশোরীর দাবি, ১২ বছর থেকে ফেসবুক করি। বয়সটা তখন একটু বাড়িয়েই করতাম। তবে এটা ভাবার কারণ নেই, সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটে আড্ডা মারি মানেই একদম বখে গিয়েছি। অচেনা কারও সঙ্গে আলাপ করার সময়ে একটু সতর্ক থাকতেই হয়। তার প্রশ্ন, “ছোট বা বড়— কারওর জন্যই এমন আড্ডাবাজির বাড়াবাড়িটা ভাল নয়, তা-ই নয় কি?”




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.