|
|
|
|
|
তারাদের কথা
|
|
হৈমন্তী শুক্ল
সঙ্গীতশিল্পী
ছোটবেলা থেকেই পুজো দেখা আমার ভীষণ নেশা ছিল। কখনও বাবা-মায়ের হাত ধরে, কখনও বা নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে। পায়ে ফোস্কা পড়ত তবুও কুছ পরোয়া নেহি। এর মধ্যেও খুব কৌতূহল ছিল কোন পাড়ায় কোন প্যান্ডেলে কোন গান বাজছে। সেই গান শুনে এসে বাড়িতে গুনগুন করে গাইতাম। ভাবতাম, আমি যখন বড় শিল্পী হব আমার গানও কি এমন করেই বাজবে প্রত্যেক প্যান্ডেলে?
সবই মায়ের ইচ্ছা। এক দিকে গর্ভধারিণী মায়ের স্নেহ, অন্য দিকে দশভুজার আশীর্বাদ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল বাবার শেখানো তালিম আর নিষ্ঠায়। ‘এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে,’ বেজেই যাচ্ছে। মানুষের মনে, প্যান্ডেলে। গান ও সুর তো কখনও থামে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল ভেঙে যখন মহানগরীর ভিড়ে হারিয়ে যাই তখন মনে পড়ে যায় শৈশবের সেই সব স্বপ্ন দেখার কথাগুলো। মানুষের ইচ্ছা ও চেষ্টা কখনও বিফলে যায় না। মা তো আসেন মাত্র তিন দিনের জন্য। তাঁর কাছে আমরা সবাই তো আশীর্বাদ চাই, যেন আরও ছুটতে পারি নিজের কর্মে, নিজের সাধনায়। আমারও সেই একই প্রার্থনা, আমার কণ্ঠে আরও তেজ আসুক। নতুন নতুন সুর আসুক। আমি আরও কিছু করতে চাই, মানুষের ভালবাসা পেতে চাই। এক একটি দুর্গাপুজো আমার কাছে তাই আরও প্রত্যাশা জাগিয়ে দেয়।
|
|
লোপামুদ্রা মিত্র
সঙ্গীতশিল্পী
পুজোতে এই শহরই ভাল লাগে। কিন্তু খ্যাতির বিড়ম্বনায় খুব কম বছরই আছে যে আমি এই শহরের পুজোয় প্রত্যেক দিন আনন্দ করেছি, প্যান্ডেলে-প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়িয়েছি। বিদেশে যদি নাই গেলাম কিন্তু এই পুজো উপলক্ষেই দেশের কোনও না কোনও অনুষ্ঠানে গাইতে যেতে হয়। তবে সে কলকাতা হোক বা অন্য প্রান্তবাঙালিদের আনন্দের রূপ কিন্তু একই। বরং প্রবাসীদের মধ্যে আবেগ আরও বেশি। আমাদের ঘিরে কী উত্তেজনা, কী আতিথেয়তাভাবা যায় না। তবুও বলি, কলকাতার জন্য মনটা কেমন করে। বাইরে থেকে ফোন করি, কেমন চলছে কলকাতার পুজো।
আমার বড় আফশোস, পুজোর এই দিনগুলো এত তাড়াতাড়ি কেটে যায় কী করে? কেনই বা তিন দিনের বদলে আরও দুটো দিন বেশি পুজো হয় না? আমাকে পাগল ভাববেন না। সারা বছর এত ব্যস্ততার মধ্যে থেকে ক্যালেন্ডারের এই দিনগুলোই যে আমাদের চলার পথের বড় আনন্দ।
|
|
মেঘনাদ ভট্টাচার্য
নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা
আমার শৈশব ঘুরে-ফিরে শহর থেকে তেপান্তর। কোনও বছর কলকাতার পুজো দেখা, তো কোনও বছর অজ বাংলার মেঠো গাঁয়ে। আজ এতগুলি বসন্ত পেরিয়ে এসে মনে হয়, কাশফুলের রং সেই সাদাই। ঢাকের তালের ছন্দও সেই একই। কোনও ভেদাভেদ নেই। বৈষম্য নেই। আনন্দ শুধু আনন্দ। আমার সব চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল কোন পুজোয় কোন নাট্যদল পুজো মাতাবে। এমনও হয়েছে মাকে রাজি করিয়ে সারা রাত লুকিয়ে নাটক দেখেছি। বাবা টের পাওয়ার আগেই ভোরবেলায় ঘরে ঢুকে বিছানায় ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থেকেছি।
আসলে মনের মধ্যে একটা অভিনয় সত্তা গোপনে কাজ করত। পুজো এলেই অঞ্জলি দেওয়ার নাম করে প্রার্থনা করতাম আমি যেন অনেক বড় অভিনেতা হতে পারি। পরের জীবনে যখন দেশ ছেড়ে বিদেশেও পুজো উপলক্ষে নাটক করতে গেছি, মায়ের মুখের দিকে তাকালেই আমার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে যেত। ‘বাবা, তুই পারবি। তোর অভিনয় দেখে মানুষ খুশি হবে।’
এখন এই শহরের ঘেরাটোপে লক্ষ মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। বাস্তবে তা হয় না। বরং একটু নির্জনতায় খুঁজে পাই আমার ফেলে আসা দিনগুলোর সেই মুহূর্তগুলো। অষ্টমীতে মায়ের হাতের ফুলকো লুচি, কষা আলুর দম আর রসে ভেজা টাটকা বোঁদে। নবমীতে খাসির মাংস, দশমীতে পোলাও। মা আসেন প্রতি বছর, কিন্তু গর্ভধারিণীর সেই স্নেহ আর ফিরে আসে না। আক্ষেপ শুধু এটুকুই। |
|
অভিজিৎ
সঙ্গীতশিল্পী
পুজো নিয়ে আমি এখনও এক রকম নস্টালজিয়ায় ভুগি। নিজে আনন্দ করি, অন্যকেও আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি। মুম্বইতে আমার পুজোয় অনেকেই আসেন। পুরোপুরি বাঙালিওয়ানা। এখানে তো অনেকেই বলেন ‘বাঙালিবাবুর পুজো’। নিয়ম, নিষ্ঠা এবং ভক্তিএই তিনটিই আমার পুজোর মূল থিম। ‘ঢাকের তালে কোমর দোলে’ এই গানটি তখন মাথায় থাকে না। থাকে ঢাক ও কাঁসরের যুগ্ম প্রতিযোগিতা। ঢাকের তালে অনেক সেলিব্রিটিও কোমর দোলান। আরে, এটাই তো আনন্দ। আর ধুনুচি নাচের প্রতি আমার দুর্বলতা আগেও ছিল এখনও আছে। এই দিনটি আমার কাছে যেন শৈশবের অনেক কিছুই ফিরিয়ে দেয়। আমি কম্পিটিশনে যে কত প্রাইজ পেয়েছি তার কোনও ইয়ত্তা নেই।
পুজো মানেই তো ভোগ। শালপাতায় গরম ভোগের কোনও তুলনা হয়? হয় না। আসলে এত আনন্দের মধ্যেও কোথায় যেন বিষাদের একটা ছায়া আমার মনকে ঘিরে রাখে। সেটা আর কিছু নয়, মাত্র তিন দিন পরেই যে মা চলে যাবেন। প্যান্ডেলে পড়ে রইবে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা প্রদীপটি। উফ, ওটা ভাবতে পারছি না।
|
অনুলিখন: বিপ্লবকুমার ঘোষ |
|
|
|
|
|
|