ঈশ্বর কণার বাজিমাত।
এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার ‘হিগস-বোসন’ ওরফে ঈশ্বর কণার জন্যই মিলবে, এমন জল্পনা চলছিল বেশ কিছু দিন। সেই জল্পনা সত্যি করে মঙ্গলবার নোবেল সুইডিশ কমিটি জানিয়ে দিল, ১৯৬৪ সালে দুই প্রবন্ধে ঈশ্বর কণার ব্যাখ্যা দেওয়া দুই বিজ্ঞানী ব্রিটেনের পিটার হিগস এবং বেলজিয়ামের ফ্রাসোয়াঁ এঙ্গলার্ট পদার্থবিদ্যায় এ বারের নোবেলজয়ী। হিগস এখন ৮৫ বছরের বৃদ্ধ, এঙ্গলার্ট মাত্র ৪ বছরের ছোট।
নোবেল কমিটির ঘোষণায় জানানো হল, এই ব্রহ্মাণ্ডে কণা ভারী হওয়ার মূলে যে কারণ, সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য হিগস-এঙ্গলার্টের এই শিরোপা। ব্যাখ্যার কেন্দ্রে অবশ্যই এক কণা। পদার্থবিদ্যায় যা পরিচিত ওই ‘হিগস-বোসন’ নামে। নামের মধ্যে ‘বোসন’ শব্দটি জানিয়ে দিচ্ছে, কণাটি বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু-আবিষ্কৃত এক বিশেষ জাতের।
সত্যিই, মহা মূল্যবান দুই বিজ্ঞানীর ব্যাখ্যা। এই ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে কেবলই কণা। গ্রহ-নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, গাছপালা, ফুল কিংবা মানুষ সবই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার পিণ্ড। কণা ভারী না-হলে, এ সব কিছুই থাকত না। কারণ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণারা একে অন্যকে কাছে টানত না, কেবলই ছুটে বেড়াত আলোর বেগে। হিগস-বোসনের অস্তিত্ব না থাকলে ব্রহ্মাণ্ডের চেহারা কী হত, তা কল্পনা করাও দুষ্কর। ১৯৬৪ সালে বিখ্যাত জার্নাল ‘ফিজিকাল রিভিউ লেটারস’-এর দুই প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করা হয় কণাদের ভারী হয়ে ওঠার রহস্য। প্রথম পেপার এঙ্গলার্ট এবং তাঁর সহযোগী রবার্ট ব্রাউটের। দ্বিতীয় পেপারের লেখক অবশ্যই হিগস। ব্রাউট মারা যান দু’বছর আগে। নয়তো, বোঝাই যাচ্ছে, এ বার পদার্থবিদ্যায় তৃতীয় নোবেল বিজয়ী হতেন তিনিও। |
|
|
পিটার হিগস |
ফ্রাসোয়াঁ এঙ্গলার্ট |
|
কিন্তু ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব বাতলানোর প্রায় অর্ধ শতক পরে নোবেল কেন?
পরে নয়, বলা উচিত, এ বারের নোবেল পুরস্কার বিশ্বে বিখ্যাততম শিরোপার ইতিহাসে দ্রুততম স্বীকৃতির নিদর্শন। বিজ্ঞানে তত্ত্ব শেষ কথা বলে না, শেষ কথা বলে পরীক্ষামূলক প্রমাণ। হিগস, এঙ্গলার্ট এবং ব্রাউটের পেপারে ইঙ্গিত মিলেছিল যে কণার, তা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল দু’টো কারণে। বিজ্ঞানীরা বুঝেছিলেন, ওই কণাটি না থাকলে ব্রহ্মাণ্ড অর্থহীন ও কায়াহীন। এ ছাড়া, বিশ্বরহস্য ব্যাখ্যায় ওঁদের ঝুলিতে যে মূল সম্বল বিজ্ঞানের পরিভাষায় যে থিয়োরির নাম ‘স্ট্যান্ডার্ড মডেল’ তা দাঁড়িয়ে হিগস-বোসন বা ঈশ্বর কণার ভিতের উপর। কণাটি না-থাকলে বিজ্ঞানীদের সাধের ওই থিয়োরি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে তাসের ঘরের মতো।
ফলে ১৯৬৪ সালের পর থেকেই দুনিয়া জুড়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের সাধ ছিল, ঈশ্বর কণার দর্শন। স্বপ্ন সফল সহজ নয়। তার দেখা মিলতে পারে যে যন্ত্রে, তা বানাতে খরচ হাজার কোটি ডলার বা ইউরো। অনেক দূর এগিয়েও হাল ছেড়ে দিয়েছিল আমেরিকা। কিন্তু দমেনি ইউরোপ। জেনিভা শহরের অদূরে সার্ন গবেষণাগারে তৈরি হয়েছিল লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি)। যেখানে কর্মরত প্রায় ১০ হাজার বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার গবেষকের পরিশ্রমে গত বছর শনাক্ত হয়েছিল ঈশ্বর কণা।
প্রক্রিয়া অভিনব। কণায় কণায় সংঘর্ষ। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয় লক্ষ কোটি ভগ্নাংশ। যারা আবার জন্মের পর সেকেন্ডের কোটি কোটি ভাগের মধ্যে উধাও! এ হেন পরিস্থিতিতে হন্যে হয়ে খোঁজা হিগস-বোসনকে। কাজটা কেমন কঠিন? সানের্র ডিরেক্টর-জেনারেল রলফ হয়্যার কলকাতায় এসে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “এ যেন একটা খড়ের গাদায় একটা ছুঁচ খোঁজা নয়, হাজারটা খড়ের গাদায় একটা ছুঁচ খোঁজার সামিল।” সেই জটিল কাজে সাফল্যের খবর সার্ন-এ ঘোষিত হয়েছিল গত বছর ৪ জুলাই। জানানো হয়েছিল, এলএইচসি-র দুই যন্ত্র অ্যাটলাস এবং সিএমএস খুঁজে পেয়েছে হিগস-বোসনের চিহ্ন।
এলএইচসি-তে ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব প্রমাণকে পণ্ডিতেরা বলেছিলেন, এ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাফল্য। নোবেল কমিটিও টেনে এনেছে সার্ন-এর কথা। যেন বলতে চেয়েছে, পুরস্কার দেওয়া হল ওই সাফল্যের সূত্রেই। পুরস্কার পেয়ে মিতবাক হিগস বলেছেন, “এই সম্মানে আমি অভিভূত। আশা করি এই স্বীকৃতি মৌলিক গবেষণার মূল্য সম্পর্কে সকলকে সচেতন করবে।” উৎফুল্ল এঙ্গলার্ট বলেছেন, “বুঝতেই পারছেন, ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ নয়! বেঁচে থাকতে থাকতে এ স্বীকৃতি পেলাম, সে জন্য ভাল লাগছে।”
গত বছর ৪ জুলাই সার্নে ঘোষণার পরে অনেকেই ভেবেছিলেন, অক্টোবরে নোবেল কমিটি স্বীকৃতি জানাবে ওই সাফল্যকেই। কিন্তু কে পাবেন পুরস্কার?
শান্তি পুরস্কার কখনও ব্যক্তির বদলে প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলেও, অন্য সব নোবেল ধার্য ব্যক্তির জন্য। তাই ঈশ্বর কণার ব্যাপারে পুরস্কার দিলে, কে হবেন বিজেতা? অ্যাটলাস এবং সিএমএস-এর বিজ্ঞানী দলের দুই প্রধান? কিন্তু তা কী করে হয়? ওই সব প্রধানের পদ তো কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধানের মতো, সময়ে সময়ে বদলে যায়। যখন শনাক্ত হয়েছিল ঈশ্বর কণা, তখন যাঁরা ছিলেন প্রধান, তাঁরা তো ছিলেন কেবল ওই সময়টুকুর জন্য।
তা হলে কি পুরস্কার দেওয়া হবে তাঁদের, যাঁরা তত্ত্বে প্রথম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ঈশ্বর কণার? তাতেও বিপদ। কেন না, সে ক্ষেত্রে দাবিদার অনেকে। এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হিগস-এঙ্গলার্ট কিংবা ব্রাউট ছাড়াও আরও অন্তত পাঁচ জন কাজ করেছিলেন হিগস কণা বিষয়ে। এঁরা হলেন টম কিব্ল (ইম্পিরিয়াল কলেজ, লন্ডন), কার্ল হাগেন (রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা), জেফরি গোল্ডস্টোন (এমআইটি, আমেরিকা), জেরাল্ড গুরালনিক (ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা) এবং ফিলিপ অ্যান্ডারসন (প্রিন্সটন, আমেরিকা)। এঁদের মধ্যে অ্যান্ডারসন ইতিমধ্যেই নোবেলজয়ী। কিন্তু বাকি চার জন? ওঁদের বাদ দিতে গিয়ে নোবেল কমিটিকে নামতেই হয়েছে চুলচেরা বিশ্লেষণে। এ বারের পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক, অতএব, অনিবার্য।
তবে হিগস-এঙ্গলার্টের পুরস্কারপ্রাপ্তির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে ইলাহাবাদে হরিশ্চন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন প্রধান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তারকনাথ পালিত অধ্যাপক অমিতাভ রায়চৌধুরী বললেন, “ওঁরা তাত্ত্বিক দিক থেকে যে কাজটি করেছেন, মৌলিক পদার্থবিদ্যা চর্চায় ভীষণ মূল্যবান। ব্রহ্মাণ্ডে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন বলের মধ্যে ঐক্য খুঁজেছিলেন ওঁরা। এই পুরস্কারের মধ্যে দিয়ে নোবেল কমিটি বুঝিয়ে দিল পদার্থবিদ্যায় মৌলিক গবেষণা কত মূল্যবান।”
নোবেল পুরস্কার বলে যখন কথা, তখন ভারতীয় বা বাঙালি মনে উঠে আসবে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম। যিনি বঞ্চিত ছিলেন ওই পুরস্কারে। গত বছর এ শহরে এসে হয়্যারও বলেছিলেন, “আমি মনে করি বসুর নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল।” তবে তা অন্য বিষয়ের জন্য। ঈশ্বর কণার পূর্বাভাস দানে সত্যেন্দ্রনাথের কোনও ভূমিকা ছিল না। আসলে, প্রাণী যেমন দুই জাতের, পুরুষ এবং স্ত্রী, ব্রহ্মাণ্ডে কণাও তেমনই দুই শ্রেণির। এক শ্রেণির নাম ‘ফের্মিয়ন’, যাদের কথা বলেছিলেন এনরিকো ফের্মি এবং পল ডিরাক। আর এক শ্রেণির কণা পরিচিত ‘বোসন’ নামে। এদের কথা বলেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ এবং আলবার্ট আইনস্টাইন। এই চার প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানীর মধ্যে কেবল বাঙালিই নোবেল শিরোপা থেকে বঞ্চিত। |