|
|
|
|
|
চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা আরাধনা
(চোরবাগান, কলকাতা) |
মধ্য কলকাতার চোরবাগান অঞ্চলের রামচন্দ্র ভবন। নির্মাণকর্তা রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন এই সুবিশাল বাসভবন। পরবর্তীকালে সমাজমূলক কাজকর্মের জন্য কলকাতা পুরসভা চোরবাগান অঞ্চলের একটি রাস্তার নামকরণ করে রামচন্দ্র চ্যাটার্জি লেন।
স্ত্রী দুর্গাদাসীর পরামর্শে রামচন্দ্র এই বাড়ির ঠাকুরদালানে ১৮৬০ সালে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। পরিবার সূত্রে জানা যায়, অসুরের কোমরবন্ধে এই সালই উল্লেখিত আছে। সেই অনুসারে এ বছর চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোর বয়স হল ১৫৩। |
|
• মূর্তির বৈশিষ্ট্য— রামচন্দ্রের সময় ঠাকুরদালানেই মূর্তি গড়া হতো। ৫৫ বছর সেই রীতি মানা হলেও ১৯১৫ সাল থেকে প্রতিমা নিয়ে আসা হয় কুমোরটুলি থেকে। তবে নিয়ম মেনে দ্বিতীয়ার দিনই মাতৃমূর্তির আগমন হয় এ বাড়িতে। আগে ডাকের সাজের প্রতিমা হলেও, স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকে বেনারসি শাড়ি ও স্বর্ণালঙ্কার পরানো হয় দেবীমূর্তিকে। এ বাড়ির মূর্তি হয় এক চালচিত্রের। হাতে থাকে রুপোর অস্ত্র।
উল্লেখ্য, ১৫০ বছরের মাতৃ আরাধনায়, মায়ের অঙ্গসজ্জায় ছিল মাটির গহনা। এমনকী, মুকুটটিও ছিল মাটির তৈরি। পরিবারসূত্রে জানা যায়,
পুরনো দিনের স্মৃতি ধরে রাখতেই এই আয়োজন।
• পুজোর রীতি— চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাবন্দনা হয় বৃহন্নান্দীকেশ্বর মতে। সময়সূচির জন্য মেনে চলা হয় গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা। এক সময় এ বাড়ির দুর্গাপুজোয় পৌরোহিত্য করতেন প্রসন্ন কুমার বিদ্যারত্ন। পরিবারসূত্রে জানা যায়, পুজোর প্রাচীন পুঁথি হারিয়ে গেলে, বিদ্যারত্ন মহাশয় পুজোর বিধির ওপর নিজস্ব কিছু নিয়ম প্রবর্তন করেন, যা বর্তমানেও মানা হয়।
মহাষষ্ঠীর রাতে বাড়ির মেয়েরা ‘বেলবরণ’ রীতির মধ্য দিয়ে মা-কে আমন্ত্রণ জানান গৃহপ্রবেশের। নিয়ম মেনে বাড়ির ছেলেরা ঢাক বাজাতেন এই অনুষ্ঠানের সময়। তবে এখন তা অতীত। প্রায় ৪০ বছর আগে বেলবরণের সময় বাড়িতে ঢাকিদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
সপ্তমীর সকালে কলাবউ স্নান আগে গঙ্গায় করানো হলেও, অনেক বছর হল তা এখন বাড়িতেই হয়।
এক সময় এ বাড়িতে পশুবলি হত। সপ্তমী ও সন্ধিপুজোয় একটি করে এবং নবমীতে তিনটি করে পাঁঠা বলি দেওয়া হত। তবে তা বন্ধ হয়ে গেছে ১৯৩১ থেকে।
রামচন্দ্রের দ্বিতীয় পুত্রসন্তান সুশীলকৃষ্ণের সময় তাঁর স্ত্রী সরোজসুন্দরীর নামে পুজোর সংকল্প করা হয়। তখন থেকেই এই নিয়ম চলে আসছে চট্টোপাধ্যায় পরিবারে। |
অন্যান্য বছরের মাতৃমূর্তি |
১৫০ বছরের মূর্তি |
|
• ভোগের তালিকা— চোরবাগানের চট্টোপাধ্যায়বাড়িই বোধহয় এ শহরের একমাত্র বাড়ি যেখানে পরিবারের ছেলেরা মায়ের ভোগ রান্না করেন। পুজোর তিন দিনই এই নিয়ম পালন করা হয়। খিচুড়ি, ভাত, শুক্তো, পাঁচ রকমের ভাজা, মোচার ঘণ্ট, নানাবিধ মাছের পদ, চাটনি— সবই রান্না করে মায়ের সামনে সাজিয়ে দেন বাড়ির ছেলেরা। বিভিন্ন রকমের মিষ্টিও থাকে ভোগের অঙ্গ হিসেবে। যেমন পায়েস, বোঁদে, পান্তুয়া।
দশমীর দিন মাকে পান্তা ভোগ দেওয়া হয়।
দুর্গাদাসীদেবী দশমীর দিন অরন্ধন প্রচলন করেন। তাই নবমীর রাতেই রান্না করে রাখা হয় ভাত, মুসুর ডাল, ছাঁচি কুমড়ো, ইলিশ মাছের অম্বল। শেষে দধিকর্মা দিয়ে মাকে বিদায় জানানো হয়। পুজোর কয়েক দিনে যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে তার জন্য পরিবারের সদস্যরা বিশেষ প্রার্থনা সঙ্গীত গেয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন—
ভজিতে তোমারে শিখি নাই কভু
ডাকি শুধু তোমায় মা বলে।
সাধনার রীতি জানি নাকো নীতি
পুজি শুধু তোমায়
আঁখি জলে।।...
১৬ পঙক্তির এই স্তব কে রচনা করেছেন, জানা নেই চট্টোপাধ্যায় পরিবারের।
• বিশেষ দ্রষ্টব্য— শোনা যায়, চোরবাগানের এই বাড়ি ঠাকুরদালান সমেতই কেনেন রামচন্দ্র। বিক্রেতা নাকি তাঁকে অনুরোধ করেন যাতে দেবদেউলের অংশ কোনও ভাবেই নষ্ট না করা হয়, কারণ তখনও সেখানে দুর্গাপুজো হতো।
বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত ছিলেন রামচন্দ্র। এক বছর দুর্গাপুজোয় তাই বাড়ির উঠোনেই আয়োজন করেন যাত্রানুষ্ঠানের। সেই ধারা বজায় রেখেছেন তাঁর উত্তরসূরিরাও। প্রতি বছরই তাই নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে। |
|
• দিক নির্দেশ— চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউর ওপরে রামমন্দির বাসস্টপে নেমে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে ঢুকে কয়েক পা গেলেই ডান দিকে রামচন্দ্র ভবন। ১২০ নম্বর বাড়িটি নজরই এড়াবে না কারওই। কাছের মেট্রো স্টেশন মহাত্মা গাঁধী।
|
প্রতিবেদন: শেলী মিত্র
সূত্র: চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদ্যরা এবং ১৫০ বছরের পুজোয় প্রকাশিত পুস্তিকা |
|
|
|
|
|
|