সরকারবাড়ির দেবীবন্দনা
(বেলেঘাটা, কলকাতা)
বাড়িতে দুর্গাপুজো হবে অথচ যাত্রানুষ্ঠান হবে না— এ যেন ভাবতেই পারে না বেলেঘাটার সরকার পরিবার। তার কারণ, এমনটাই হয়ে আসছে ১২১ বছরের এই পারিবারিক দুর্গাপুজোয়। বেলেঘাটার তত্কালীন জমিদার গগনেন্দ্র সরকার ১৮৯২ সালে বাড়ির ঠাকুরদালানে মাতৃবন্দনার সূচনা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র পণ্ডিত গণপতি সরকার ও দুই ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ও বিধুভূষণ সরকার সেই দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেন এবং চার দিনের এই উত্সবকে মহোত্সব করে তোলেন। গণপতি সরকারের পুত্রসন্তান না থাকায় বর্তমানে তাঁর দৌহিত্র শুভজিত্ মজুমদার পুজোর দায়িত্ব পালন করেন অন্য আত্মীয়দের সহযোগিতায়। “এ বছর আমাদেরই পালা”, বললেন শুভজিত্। এর পরের দু’বছর পুজোর দায়িত্ব থাকবে যথাক্রমে সুরেন্দ্রনাথ ও বিধুভূষণের বংশের। পুজোর নিয়মরীতি প্রায় মুখস্ত শুভজিতের স্ত্রী নূপুরদেবীর। ১৯ বছর ধরে পালাক্রমে পুজোর কাজে হাত পাকিয়েছেন তিনি। “ভুলে গেলে বা সংশয় থাকলে বাড়ির বড়রা তো আছেনই”, বললেন নূপুরদেবী। ঘটনাচক্রে পণ্ডিত গণপতি সরকারের জন্ম এবং এ বাড়ির পুজোর সূচনা হয় একই বছরে।
• মূর্তির বৈশিষ্ট্য— মৃত্ শিল্পী অনিল পাল এক সময় সরকার বাড়ির ঠাকুর দালানে মূর্তি গড়তেন, বললেন শুভজিত্। এখন তাঁর উত্তরপুরুষরা সেই কাজে বহাল। পাল বংশের পূর্বপুরুষরাও এই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সরকার বাড়ির দেবী মূর্তির পটলচেরা চোখ। এক চালচিত্রের ডাকের সাজ তাঁর।

• পুজোর রীতি— জন্মাষ্টমীর দিন পাঁচটি গড়ান কাঠে কাঠামো পুজো দিয়ে সরকার বাড়ির দুর্গোত্সবের সূচনা হয় প্রতি বছর। ঠাকুরদালানের পাশে একটি সুবৃহত্ বেলগাছ আছে। বিল্ববৃক্ষ পুজো শেষে হয় মহাষষ্ঠীর আরম্ভ।

গণপতি সরকার ছিলেন মহাপণ্ডিত। তাঁর রচিত অগুনতি বইয়ের মধ্যে একটি হল ‘কালিকা পূরাণিও দূর্গাপূজা পদ্ধতি’। এই বইয়ে লেখা নিয়মানুসারে পুজো হয় সরকার বাড়িতে। মেনে চলা হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা।

বলি প্রথা এখনও বজায় আছে। তবে বাড়িতে তা হয় না। কালীঘাটে বলি দেওয়া হলে প্রসাদ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এক সময় কুমারী পুজো ও সধবা পুজো পালন করা হত। তবে তা বন্ধ হয়ে গেছে বহু বছর। কুললক্ষ্মীর পুজো মায়ের সঙ্গে একাসনে পালিত হয় এই চার দিন। সময়সূচি মেনে দশমীর দিনই দেবীমূর্তির বিসর্জন হয় গঙ্গায়। রীতি অনুযায়ী এখনও কাঁধে করে বিসর্জনে নিয়ে যাওয়া হয় মাকে। আগে পরিবারের লোকেরাই এ দায়িত্ব নিতেন। এখন তা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই লোক ঠিক করা আছে এই কাজের জন্য।

মৃত্ শিল্পীর মতো এ পরিবারের দুর্গাপুজোর পৌরোহিত্য করছেন নীলমণি ভট্টাচার্য। প্রায় ৫৭ বছর ধরে তিনি মাতৃ আরাধনার দায়িত্ব পালন করছেন, বললেন শুভজিত্। শুরু হয়েছিল তাঁর ঠাকুরদাদাকে দিয়ে। বর্তমানেও নীলমণি ঠাকুরের পরিবারই এই কাজে যুক্ত।
• ভোগের তালিকা— পুজোর চার দিনই লুচি ভোগ হয়। সঙ্গে থাকে তিন রকমের ভাজা— আলু, পটল ও বেগুন। অন্নভোগ হয় না, তবে আয়োজন থাকে পরমান্নের। ফল-মিষ্টিও থাকে সম পরিমাণে।
নিয়ম মেনে নৈবেদ্য সাজানো হয় একটি বড় বারকোশে যাতে থাকে ন’টি মাটির খুড়ি। একই ভাবে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীতে যথাক্রমে ১৭, ২৮ ও ২৯টি নৈবেদ্য দেওয়া হয়।

• বিশেষ দ্রষ্টব্য— দুর্গাপুজোর যাত্রা ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এ বাড়ির পরম্পরাই বলা যায়। ঠাকুরদালানের সামনের খোলা চত্বরের মাঝখানে স্টেজ বানিয়ে সামিয়ানা টাঙিয়ে প্রতি বছরই যাত্রা হত এক সময়। তখন বেলেঘাটা অঞ্চলে আর কোনও দুর্গাপুজো হত না। তাই পুজো আর যাত্রা— দু’টোর টানেই আশেপাশের লোক ভিড় জমাত সরকার বাড়ির মাতৃবন্দনায়। মুকুন্দ দাস, ছবি বিশ্বাস, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নামী শিল্পীরা এক সময় অভিনয় করে গিয়েছেন এ বাড়ির যাত্রামণ্ডপে। ১৯৯২ সালে বাড়ির পুজোর শতবর্ষে অতিথি হয়ে এসেছিলেন প্রয়াত মন্ত্রী ও সাংসদ অজিত পাঁজা। এক সময় সপ্তমীর পুজো শেষে ব্রাহ্মণ ভোজন ও দরিদ্রনারায়ণ সেবা প্রচলিত ছিল সরকার বাড়িতে। যতদূর মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর পরই তা বন্ধ হয়ে যায় বলে জানালেন শুভজিত্ মজুমদার।

• দিকনির্দেশ— শিয়ালদহ থেকে বেলেঘাটা মেন রোড ধরে ইএম বাইপাসের দিকে গেলে রাস্তার ওপরেই বাঁ দিকে সাদা বাড়ি, ৬৯ বেলেঘাটা মেন রোড। বাসস্টপের নাম ‘সরকার বাড়ি’।

প্রতিবেদন: শেলী মিত্র
ছবি: পারিবারিক সূত্রে



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.