|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
ভারতীয় রেলের বিবর্তনে স্মৃতি বিজড়িত ইতিহাস |
অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল ভারতীয় রেলের ইতিহাস নিয়ে প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
সেই শৈশব থেকে শুনে আসা ছড়া ‘রেলকম ঝমাঝম পা পিছলে আলুর দম’। ‘চরৈবেতি’ মন্ত্রের সূক্ষ্ম এক অনুরণন কি মিশে নেই রেলের ঝমঝম আওয়াজের মধ্যে? আর মধ্য রাতে ঘুম ভেঙে দূর থেকে যখন ভেসে আসত স্টিম-ইঞ্জিনের উদাত্ত হুইস্ল,তা যে সুদূরের জন্য স্বপ্ন জাগাত, তাও হয়তো আজ অতীতের ইতিকথা। তবু আজও আরও বেশি সমারোহে রেল সমগ্র ভারতকে একাত্ম করে রেখেছে।
যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৬০ বছর আগে। সেই থেকে দু’টি সমান্তরাল সরলরেখা, কখনও বা বাঁকের মুখে বক্ররেখা, পরস্পরে না মিলেও একাত্ম করেছে সমগ্র দেশকে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, ওখা থেকে বনগা। বিবর্তনেরও কত বৈভব! স্টিম ইঞ্জিন থেকে ডিজেল। ডিজেল থেকে ইলেকট্রিক, ই.এম.ইউ। প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৫৩-র ১৪ এপ্রিল। মুম্বইয়ের বোরিবন্দর থেকে থানে পর্যম্ত ৩৪ মাইল পথ অতিক্রম করেছিল ভারতের প্রথম রেলগাড়ি। তার পর ১৬০ বছরে শিরা-উপশিরার মতো প্রায় সারা দেশে ৬৪ হাজার কিলোমিটার পথ জুড়ে বিস্তৃত হয়েছে রেল লাইন। সরকারি হিসেব অনুযায়ী প্রতি দিন রেলে ভ্রমণ করেন ২ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ। আর এই গতিকে সচল রাখতে নিরন্তর সক্রিয় থাকতে হয় ১৪ লক্ষ কর্মীকে।
এই বিপুল ইতিহাসকে একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরতে চেয়েছে ভারতীয় রেল। অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রদর্শনী। |
|
প্রদর্শনীর একটি ছবি
|
এ যে শুধু তথ্যের প্রদর্শনী, তা নয়। এর মধ্যে বিবর্তনের ইতিহাস যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্পও। প্রায় সবটাই তুলে ধরা হয়েছে আলোকচিত্রের মাধ্যমে। প্রদর্শনীতে একটি দশ মিনিটের ভিডিয়ো দেখানো হয়েছে, যেখানে রেলের প্রযুক্তিগত ও মানবসম্পর্ক-গত নানা দিক উঠে এসেছে। এটিও একটি প্রাপ্তি।
দু’টি রেললাইন কেবল কি সমান্তরালেই চলে? কখনও কখনও তাদের মিলতেও হয়। বড় শহরের কাছে বা জংশন স্টেশনের কাছে যত এগিয়ে আসে রেললাইন, তত বেড়ে যায় রেখায় রেখায় মিলনের জটিলতা। সংঘর্ষের জটিলতা। সত্যজিৎ রায়ের ‘অপরাজিত’ সিনেমায় আমরা দেখেছি ট্রেনে করে অপুর কলকাতায় প্রবেশের মুখে এই জটিলতার আলেখ্য। রেললাইন ও ট্রেনযাত্রার রয়েছে এ রকম অজস্র স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন ট্রেনে জানালার ধারের আসনে। বাইরে সুদূরের দিকে তাঁর দৃষ্টি। হাওয়ার দাপটে উড়ছে তাঁর শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রু। মহাত্মা গাঁধী কোনও স্টেশনে নামছেন কাঠের ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরা থেকে। দু’হাতে ধরা রয়েছে দু’পাশের হাতল। এ রকম নানা দৃশ্যের আলোকচিত্র রয়েছে প্রদর্শনীতে।
গরিমা যেমন আছে তেমনি আছে যাতনার নানা মুহূর্তও। সদ্য স্বাধীন হয়েছে এই দেশ। স্বাধীনতার অনন্য উপহার দেশভাগ। লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। পশ্চিম ও পূর্ব সীমান্তে দেশব্যাপী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। আম্বালা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ট্রেন। ভিতরে ঠাসাঠাসি মানুষ। সকলেই সীমান্ত পেরোবে। ভিতরে আর জায়গা নেই। তাই ট্রেনের ছাদের উপরে কাতারে কাতারে বসে আছে নর-নারী-শিশু বিপদের সমস্ত ঝুঁকি নিয়ে। তাঁদের এত দিনের প্রিয় দেশ ছেড়ে তাঁদের তো চলে যেতেই হবে সীমান্তের ওপারে। এ রকম একটি রিফিউজি স্পেশাল ট্রেনের আলোকচিত্র দেখি এই প্রদর্শনীতে। পূর্ব সীমান্তের এ রকম কোনও ছবি রাখা হয়নি।
রেলস্টেশনের স্থাপত্যের দৃশ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে এই প্রদর্শনীর একটি অংশ। কত সমৃদ্ধ স্থাপত্য রয়েছে দেশের বিভিন্ন অংশে। স্থানীয় নিসর্গ, ইতিহাস ও জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি স্থাপত্য। রাজস্থানের বিভিন্ন স্টেশনের এই স্থাপত্যসৌষ্ঠব বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লখনউ-এর চারবাগ স্টেশনটিও অসামান্য। বিভিন্ন তলের বিন্যাস, শীর্ষদেশের গম্বুজ, বিভিন্ন তোরণ, তাদের উপর আলোছায়ার খেলা, সব মিলে অসামান্য নান্দনিক বিভা। তুলনায় আমাদের হাওড়া বা শিয়ালদহ স্টেশনকে খুবই দীন মনে হয়। এ রকম সব গৌরবের পাশাপাশি ‘পা পিছলে আলুর দম’-এর অভিজ্ঞতাও প্রতিনিয়ত সঞ্চয় করেন আজকের নিত্যযাত্রী। শহরতলির ট্রেনযাত্রার নিত্য দুর্ভোগ আর দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাও তো ইতিহাসেরই অঙ্গ। তাকে কী করে সীমিত করে আনা যায়, সেটাই আজ ভারতীয় রেলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। |
|
|
|
|
|