রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১...
পুজো প্রোমো
সে থাকলে চলবে না বস, পুজোর প্রোমোশন শুরু করতে হবে জুন মাস নাগাদ। শিবরাত্রির দিন ভোর ভোর উঠে, মায়ের হাজব্যান্ডকে জল দিয়ে, প্রসাদ দিয়ে পেট পুরে বেরিয়ে পড়ুন। কারণ, খাটনি হবে। পাড়ার সবাইকে নিয়ে ভোট চাইবার কায়দায় মিছিল করে গোটা কলকাতা চক্কর দিয়ে নিজেদের পুজোর প্রোপাগান্ডা করুন। ‘আমাদের পুজো দেখতে হবে’, ‘মহিষাসুরের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগান দিন। পাড়ার মেয়েদের আটপৌরে শাড়ি পরিয়ে, খোঁপায় গাঁদা আর ত্রিনয়ন টিপ দিয়ে সাজিয়ে, লাইন করে ঘোরান। কোরাসে গান: জাগো দুর্গা, মাতল রে ভুবন। মাঝেমাঝে মুখশুদ্ধি দু-চারটে হিট দিতে হবে, বাজল ছুটির ঘণ্টা, মঙ্গলদ্বীপ জ্বেলে, আশিকি টু। নইলে শুধু ঢাকের তালে আর মায়ের গানে পুজোর স্পিরিট আসে না। সব শেষে স্লো মোশনে একটা খোলা জিপ। তার গায়ে জড়ানো আপনাদের পুজোর ব্যানার-পতাকা, মাইকে গমগম মহালয়া, সিটে ক্লাবের পুজোর মাথাব্যক্তিটি, পরনে কাজ করা জমিদারি ধুতি পাঞ্জাবি। স্মিত হেসে তিনি রাস্তার ধারে ভিড়, বাড়ির জানলা-বারান্দায় ঝুলন্ত ভড়কে যাওয়া মুন্ডুদের হাতজোড় করবেন। এ জিনিসের লাভ অগুনতি। যানজট বাধিয়ে আপনার পুজো মানুষের ও এফ-এম সঞ্চালকের মুখে মুখে: অমুক রাস্তায় এখন যাবেন না, তমুক পুজোর র‌্যালি বেরিয়েছে। আর, বর্ষার শুরুতেই সহসা পুজোর গন্ধ টেনে এনে পাবলিকের নয়নের মণি তো হচ্ছেনই।
নামী অ্যাড ফিল্ম-মেকারকে বরাত দিয়ে, পুজোর তিরিশ সেকেন্ড-এর একটা দুরন্ত ক্যাচলাইনওয়ালা ট্রেলর বানিয়ে, চ্যানেলে চ্যানেলে লঞ্চ করে দিন, ইউ টিউবে ছেড়ে দিন। বেস্ট হল, মেট্রো স্টেশনের এলসিডিতে চালান। লোকে লেট ট্রেনকে গালাগালি দিতে ভুলে হাঁ করে আপনার পুজোর প্রোমো গিলবে, ভিড়ে স্যান্ডউইচ হয়েও আপনাদের পুজোর থিম সং গুনগুন করবে। আরও জনমোহিনী স্টান্ট: হেলিকপ্টার থেকে পুজোর লিফলেট ফেলুন। কাগজটায় পুজোর বৈশিষ্ট্য দেবেন অল্প অল্প, সাসপেন্স রেখে। আর অনেকটা করে দেবেন কোন রাশি কোন লগ্নের এ বার পুজো কেমন যাবে। ক’টা জামা-জুতো হবে, বোনাস মিলবে কি না, ছোটপিসি রেডিমেড টি-শার্ট দেবে না প্যান্টের ছিরকুটে পিস, কনজাংটিভাইটিস কবে হবে, অষ্টমীর দিন কাজের মেয়ে আসবে কি না এবং অবশ্যই লিখুন আপনাদের প্যান্ডেলে প্রেমের যোগ কী রকম।
এই ‘ইলু ইলু’-টাই হোক আপনাদের ওয়েবসাইটের সেন্টার অব অ্যাট্রাকশন। প্রতিমা কেমন এগোচ্ছে, ডিরেক্ট কুমোরটুলি থেকে তোলা টুকরো টুকরো ছবি-ভিডিয়ো আপলোড তো থাকবেই। আজ হাঁস বসানো হল, কাল কার্তিকের ডান হাত কনুই অবধি কমপ্লিট। তবে, মেন ব্যাপার: পাড়ার সেরা এলিজিবল হ্যান্ডসাম ও হিরোইনদের প্রোফাইল। নবমীর সকালে ডিকো (মেল, ভেরি গুডলুকিং, এজ ২২) ফ্রি আছে, বাইক নিয়ে প্যান্ডেলের তিন ফুট দূরে স্বেচ্ছাসেবীর ডিউটি দেবে। অষ্টমীর সন্ধ্যায় রায়না (ফিমেল, অ্যাট্রাকটিভ, এজ ২০) ভোগ-এর মঞ্চে দাঁড়াবে।
রিয়েলিটি শো তো থাকবেই। ও ছাড়া হয়? কুমারীপুজোর কুমারী, সারা ক্ষণের ঢাকি, শাঁখ-বাজিয়ে, সমস্ত সিলেকশন করুন রিয়েলিটি শোয়ে দুষ্টু অ্যাংকর, রাগী ও সফ্টি কম্বিনেশনের টক-ঝাল-মিষ্টি জাজদের বসিয়ে, জাঁদরেল চ্যানেলে দেখিয়ে, এসএমএস ভোট কুড়িয়ে, হাসি-খুশি-কান্না মাখিয়ে পাবলিক সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে। পুজোর চার মাস আগে থাকতে বাচ্চারা, বাড়ির বউ ও প্রত্যন্ত গ্রামের দুঃস্থ চাষীরা চিঠি লিখে, ই-মেল করে, বা ক্লাবঘরে ডিরেক্ট এসে আবেদনপত্র জমা দিয়ে যাবে। তার পর অডিশন, পারফরমেন্স, এলিমিনেশন, রাউন্ডস, ফিনালে মিলিয়ে পুজোর আগের তিন মাস বাঙালি নিজের সোফায় নয়, আসলে আপনাদের পুজোর প্যান্ডেলেই। যে বাচ্চাটা কুমারী হবে, তাকে অষ্টমীর দিন পুজো তো করবেনই, প্লাস সে একটা গোটা দিন আরাধ্যা বচ্চনের সঙ্গে খেলতে পারবে। যে বউদি শাঁখ বাজানোর চ্যাম্পিয়ন হলেন তিনি নতুন হিট সিরিয়ালে কৃষ্ণকে শেখাবেন কেমন করে পাঞ্চজন্যে মেগা-ফুঁ দিতে হয়।
এ ছাড়াও প্রচুর কনটেস্ট নামিয়ে দিন বাজারে। প্রথম দিকে এসএমএস প্রতিযোগিতা। ‘আমাদের থিম এ বার কী, ঠিক অপশনে টিক দিন’ বা ‘গেস করুন আমাদের উদ্বোধনে থাকছেন কোন স্টার’। তার পর থেকে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। অষ্টমীর দিন রাত আটটার মধ্যে ১০৮টা পদ্ম আনতে পারবে কে? দশমীর সকালে বন থেকে নীলকণ্ঠ পাখি ধরে আনতে পারবে কে? বিকেলে চার ঘটি ভাং খেয়েও মনমোহন সিংহ কী করেন মনে রাখতে পারছে কে? কোন কাপ্ল ষষ্ঠীর সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে শুরু করে সব থেকে বেশি ক্ষণ ফ্রেঞ্চ কিস করতে পারল? কলাবউ স্নানটায় গ্ল্যাম-ফ্যাক্টর আনুন। প্যান্ডেলের সামনে একটা সুইমিং পুল কেটে নিন। বলে দেবেন আন্ডারগ্রাউন্ড পাইপ দিয়ে গঙ্গার জল এনে স্টেরিলাইজ করে ছেড়ে দিয়েছেন। ওখানে কলাবউ স্নানের সময়ই পাড়ার বউদি ও বউদিদের মেয়েদের সুইমিং কম্পিটিশন করান, বিকিনি-রাউন্ডটা লাস্টে রাখবেন।
লাইটিংয়ের বাজেটটা আকাশে লেজার শোতে ঢালুন। ডিরেক্ট স্বর্গের ক্যানভাসে ঋতুপর্ণর সিনেমাগুলোর সিন দেখান, ওঁর জীবনের গল্প বলুন। লোকে খাবে। শুদ্ধু সন্ধিপূজার সময়টুকু মা দুর্গার জায়গায় বিদ্যা বালনকে সাজিয়েগুজিয়ে দাঁড় করিয়ে দিন। অসুরের জায়গায় শাশ্বত-কে ডাকুন, বব বিশ্বাসের গেট-আপে। মাইকে বার বার ‘এক মিনিট’বলে ভয় দেখাবেন। সিংহও আনতে পারেন জ্যান্ত। সার্কাসের মতো খাঁচা থাকবে ঠাকুরের চার দিকে। তবে মানেকা গাঁধীর ব্যাপারটা আপনারা ডিল করে নেবেন।
পুজোই যখন করছেন, পুরাণটা খুব ভাল করে ঘাঁটুন। জয়া-বিজয়া’কে সিনে আনুন। ওদের দিয়ে আইটেম গার্ল, চিয়ারলিডার অনেক কাজই চালিয়ে নেওয়া যাবে। সেফ-ও হবে। এমএফ হুসেনের মতো ডিরেক্ট মা বা লক্ষ্মী-সরস্বতীদের নিয়ে তো আর কিছু গোল পাকাচ্ছেন না। এঁরা তো দুর্গার সখী। যেমন মা কালীর ডাকিনী যোগিনী। জয়া-বিজয়া বানিয়ে সানি লিয়ন, রাখি সবন্তদের ডেকে আনলে ফাটাফাটি। পেয়ারেলাল রে, বলম পিচকারি-র সঙ্গে তুমুল নাচবে। ওদের সঙ্গী হিসেবে নন্দি-ভৃঙ্গিকেও ঢুকিয়ে দিতে পারেন। হয়তো ওদের মধ্যে কোনও অ্যাফেয়ার ছিল, মেন প্লটে জোর দিতে গিয়ে এই অংশটা কেউ এক্সপ্লোর করেনি। আপনি করুন, ‘ম্যায় তেরে অগল বগল হুঁ’-র সঙ্গে ওদের ডবল-যুগলে নাচান, ওদের গ্রাফিক লীলা নিয়ে গ্রাফিক নভেল বের করে প্যান্ডেলের সামনে বিক্রি করুন।
অমিতাভের গলাটায় পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রটা নিদেনপক্ষে রেকর্ড করিয়ে আনুন। ‘আসছে কারা বাগবাজার যাচ্ছে কারা বাগবাজার’ টাইপ হল্লায় ওই ‘অগ্নিপথ-মধুশালা’ ব্যারিটোনটা দরকার। না পারলে মীরকে ধরে অমিতাভ, পিসি সরকার, চিরঞ্জিৎ, ছবি বিশ্বাস, নির্বাক যুগের চ্যাপলিন, যে কাউকে হোক নকল করে দিতে বলতে হবে।
আরও কী কী ভাবে পুজো বেচা যায়, জানতে শাহরুখ খানকে ডাকুন। যে লোক চেন্নাই এক্সপ্রেস মেগাহিট করাতে পারে, খাজা টিমকে নিয়ে হিস্টিরিয়া আমদানি করতে পারে, সে পুজোর মতো এমন পোটেন্ট প্রোজেক্ট পেলে ফাটিয়ে দেবে। সেলিং স্ট্র্যাটেজি দেবে না-ই বা কেন, শুধু মুখ দেখাতে বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছে না কি?
আর একটা কিস্তিমাত তাস আছে। সমস্ত ভাল ভাল ব্র্যান্ডকে বলে দিন কোনও ফিল্মস্টার, কোনও প্লেয়ার, কোনও মডেল আর দরকার নেই। ওঁদের সব অ্যাড করবেন স্বয়ং দুর্গাঠাকুর। এমনিতে কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর তো দশ হাত খালি করেই প্যান্ডেলে আসেন। মূর্তির সামনেই সাপ-ত্রিশূল, সুদর্শন চক্র, খাঁড়া, এগুলোকে ডাঁই করে রেখে মোমবাতি জ্বালিয়ে মহাত্মা গাঁধী ও মুন্নাভাই সঞ্জয় দত্তের (জেলবাসী নয়) ছবি টাঙিয়ে লিখুন ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’। তার পর প্যান্ডেলে ঢোকা মাত্র ঠাকুরের দশ হাতে ধরিয়ে দিন ওয়াশিং পাউডার, সফট ড্রিঙ্ক, গাড়ির ইঞ্জিন ভাল রাখার তেল, ফেয়ারনেস ক্রিম, চিপস, ডেনিম ট্রাউজার্স মানে যে কোম্পানি পয়সা বেশি দিতে পারবে মা তাদের জিনিসই হাতে নিয়ে পাঁচ দিন পোজ দেবেন। ঘণ্টা-প্রতিও চার্জ করতে পারেন। বেশি স্পনসর পেলে? ছেলেমেয়েদের হাত আছে, তাও উপচে গেলে বাহনদের পিঠ, হাঁ, চঞ্চু। আবার সিঁদুরখেলা হয়ে গেলে সেগুলো সব নামিয়ে রাংতার অস্ত্রশস্ত্র ধরিয়ে দেবেন। এই দুর্দিনের বাজারে অত দামি জিনিস গঙ্গায় দেওয়া ঠিক নয়। মা কেন পাপ দিতে যাবেন? সুপার-মম হিসেবে সন্তানের আবদারে তালে তাল মিলিয়ে নাচতে পারবেন না? যাব্বাবা!

ছবি: সুমন চৌধুরী।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.