|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
রূপের অতীত রূপ: রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা |
নন্দন ৩-এ অনুষ্ঠিত হল রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি বিষয়ক তথ্যচিত্র। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
সম্প্রতি নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহে ‘রূপের অতীত রূপ: রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা’ এই শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি বিষয়ে একটি তথ্যচিত্রের প্রথম প্রদর্শন হল। কবির জন্মের সার্ধশতবর্ষে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে তাঁর ছবির নিবিড় চর্চা কিছু হলেও উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র হয়নি। তাঁর ছবি সম্পর্কে সাধারণের সচেতনতা খুবই সীমিত। সহজে অনেকের কাছে বার্তা পৌঁছানোর পক্ষে চলচ্চিত্রের বিশেষ ভূমিকা থাকে। সুষ্ঠু ও সামগ্রিক উপস্থাপনার জন্য ছবিটি সেদিক থেকে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্যচিত্রটি তৈরি হতে পেরেছে অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন-এর পৃষ্ঠপোষকতায়। গবেষণা ও পরিচালনা করেছেন সনৎ মহান্ত। চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন পবিত্র সরকার। ৪৮ মিনিট দৈর্ঘের ডিজিটাল ফর্ম্যাটে করা ছবিটি রবীন্দ্রনাথের প্রেক্ষাপট, ক্রমবিবর্তন, তাঁর জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে চিত্রের সম্পর্ক, বিষয়-ভিত্তিক বিভাজন, প্রকরণ বা অঙ্কন-পদ্ধতি ইত্যাদি অনেক ব্যাপারেই তন্নিষ্ঠ আলোকপাতের চেষ্টা করেছে। কবির ছবি আঁকার সূচনা হয়েছিল ১৯২৩ সালে ‘রক্তকরবী’র পাণ্ডুলিপির একটি পাতায় কাটাকুটির মাধ্যমে একটি বিচিত্র জান্তব প্রতিমাকল্প গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। তখন তাঁর বয়স ৬২। তার পর ১৯২৪ সালে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি সচিত্রকরণের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে। পরে ১৯২৭-২৮ নাগাদ শুধু পাণ্ডুলিপি ছেড়ে তিনি পরিপূর্ণ চিত্ররচনায় মগ্ন হন। ১৯৪১ সাল পর্যন্ত প্রায় স্বপ্নতাড়িতের মতো ছবিতে মগ্ন থেকেছেন। এঁকেছেন প্রায় আড়াই হাজারের মতো ছবি। প্রথম জীবনেও তাঁর ছবির চর্চা যে একেবারে ছিল না, তা নয়। ‘মালতী পুঁথি’তে বা ‘শিলাইদহে’ তিনি যে ছবি এঁকেছেন, তার কিছু দৃষ্টান্ত এই তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে। |
|
রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলার একটি ছবি
|
ভারতের আধুনিক চিত্রকলার ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথের ছবির অবস্থান কোথায়, সে সম্পর্কে একটি ভুল সিদ্ধান্ত অনেকেই অনেক দিন পর্যন্ত মেনে আসছেন। সেই কবে উইলিয়াম আর্চার রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন ‘দ্য ফার্স্ট মডার্ন পেইন্টার অব ইন্ডিয়া’। সেই থেকে অনেকেই ধ্রুবপদের মতো এই কথাটির পুনরাবৃত্তি করছেন। আলোচ্য তথ্যচিত্রটিও সেই ভিত্তির উপর নির্মিত।
রবীন্দ্রনাথ যদি প্রথম আধুনিক হন, তাহলে অবনীন্দ্রনাথের অবস্থান কোথায়? স্বদেশ চেতনা আশ্রিত আধুনিকতার প্রথম সূচনা হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে। সেই আধুনিকতা বিকশিত হয়েছে নন্দলাল বসু ও নব্য ভারতীয় ঘরানার শিল্পীদের চর্চার মধ্য দিয়ে। ১৯২৩-২৪ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতার এই প্রথম পর্যায়ের রূপ চেতনাকে অতিক্রম করে নতুন চেতনার উদ্বোধন ঘটান। সেটাকে আমরা বলতে পারি আধুনিকতাবাদী বা মডার্নিস্ট। মডার্নিস্ট রূপচেতনার একটি বৈশিষ্ট্য। আমাদের দেশে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন প্রথম মডার্নিস্ট বা আধুনিকতাবাদী। রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে অনেকেই তন্নিষ্ঠ গবেষণা করেছেন। প্রথম পর্যায়ের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণীয়। তাঁর গবেষণা মূলত সাহিত্যভিত্তিক। এই তথ্যচিত্রটি গড়ে উঠেছে তাঁরই সন্ধানের ভিত্তি থেকে। পরবর্তী কালে রতন পারিসু-র গবেষণা সব চেয়ে অন্তর্দীপ্ত ও গভীরপ্রসারী। তিনিই আদিমতা ও অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ছবির যোগকে নিবিড় ভাবে বিশ্লেষণ করেন। সেই ধারাতেই নতুন মাত্রা যোগ করে কেতকী কুশারী ডাইসন ও সুশোভন অধিকারীর গবেষণা। রতন পারিসু অবশ্য আর একটি বৈশিষ্ট্যের কথাও বলেছেন, যা অনেকেই সেভাবে মনে রাখেন না। আদিমতা ও পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদ ভিত্তিক হলেও রবীন্দ্রনাথের ছবির মূল নিহিত আছে তাঁর ভারতীয় চেতনার উপর। তাঁর ছবির আঙ্গিক বিশ্লেষণ করেও এটা দেখানো যায়। যোগেন চৌধুরী তাঁর ভাষণের মধ্যে এই বিষয়টির উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আলোচ্য তথ্যচিত্র এই বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করেনি। আর একটি অভাব। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর অবদানকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ‘পূরবী’র পাণ্ডুলিপির ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে ভিক্টোরিয়া রবীন্দ্রনাথকে অনেকটাই অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমাদের ছবির আধুনিকতা বিকাশের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল নিবিড়। সেই ধারাবাহিকতায় দেখলে তাঁর ছবির সঠিক পরিপ্রেক্ষিতটি অনুধাবন করা যায়। সে সম্পর্কেও এই তথ্যচিত্র খুব গভীরে যায়নি। এসব অভাব সত্ত্বেও তথ্যচিত্রটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। |
|
|
|
|
|