প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন সংবিধানে যা রয়েছে তা-ই হবে। এক চুলও নড়বো না।
বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার জবাব আন্দোলনের ঝড়ে সব চুল উড়ে যাবে। মানুষই নড়াবে তাঁকে। উৎখাত করে ছাড়বে।
পাল্টা জবাব রুষ্ট প্রধানমন্ত্রীর যাঁর মাথায় পরচুল, তাঁরই চুল উড়ে যাওয়ার ভয়। উনি তো পরচুল পরেন, তাই সেটাকে সামলে রাখুন।
দুই নেত্রী যখন আস্ফালনে মত্ত, তখন এক গভীর ও ভয়াবহ গাড্ডার দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে জানুয়ারির ২৪ তারিখে। তার আগের ৯০ দিনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন করার বিধান রয়েছে সংবিধানে। সেই সময়সীমা শুরু হচ্ছে অক্টোবরের ২৭ তারিখে। অর্থাৎ বড়জোর একটা মাস সময় রয়েছে হাতে। কিন্তু নির্বাচন কার অধীনে হবে, গোল বেঁধেছে তা নিয়ে। আওয়ামি লিগ চায় সংসদ না ভেঙে সরকারকে রেখেই নির্বাচন হোক, যা পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সাফ কথা, অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে তাঁরা তা স্বীকার করবেন না।
শেখ হাসিনা |
খালেদা জিয়া |
সবাই মানেন, সঙ্কট নিরসনের একমাত্র পথ দু’পক্ষের আলোচনা। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন স্বয়ং দুই নেত্রীকে টেলিফোন করে আলোচনায় বসার পরামর্শ দিয়েছেন। একই উপদেশ দিয়ে এ সপ্তাহেই দুই নেত্রীকে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি। বাংলাদেশের বণিকসভা, এমনকী নাগরিক সংগঠনগুলিও সরকার ও বিরোধী পক্ষকে আলোচনায় বসার আর্জি জানাচ্ছেন বারবার। কিন্তু দুই নেত্রীর ভাবান্তর নেই। ভোটের প্রস্তুতি কার্যত শুরু করে দিয়েছে আওয়ামি লিগ। অন্য দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে অক্টোবর থেকেই
লাগাতার সড়ক ও রেল অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি। সঙ্গে শরিক জামাতে ইসলামিও।
এই অশান্তি ও সংঘাতের বাতাবরণে শেষ পর্যন্ত ভোটটা হবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাড়িয়েছে। নাগরিক আন্দোলনের নেতা শাহরিয়ার কবিরের কথায়, ইতিহাস বলছে এমন সঙ্কট যখনই এসেছে, অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছে অপশক্তি। এ
বার যুদ্ধাপরাধের বিচার পর্ব শুরু হওয়ার পর থেকেই জোট বেঁধে আস্ফালন শুরু করেছে মৌলবাদী শক্তি। গোপনে-প্রকাশ্যে কোটি কোটি ডলার ও দিনার অনুদান আসছে তাদের কাছে। সদ্য গজিয়ে ওঠা একটি মৌলবাদী সংগঠন হেফাজত ইসলামের নেতা রীতিমতো হেলিকপ্টারে
চড়ে সভা করে বেড়াচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে ফের গণতান্ত্রিক অধিকার হারানোর আশঙ্কাই চেপে বসছে আমজনতার মনে।
এর আগের চারটি সাধারণ নির্বাচনই পরিচালনা করেছে অন্তর্বর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু নতুন বিধান অনুযায়ী সংসদ ও সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন হবে। ২০০৭-এ আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনাদের সাহায্যে অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে। তার পরেই ঢাকা হাইকোট এই ব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক বলে রায় দেয়। সেই রায়কে হাতিয়ার করেই সংবিধান সংশোধন করেন শেখ হাসিনা। সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, “আমেরিকা, ভারত-সহ বিশ্বের সব দেশে সরকারকে রেখে নির্বাচন হয়। ভোট হয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে। বাংলাদেশেও তা-ই হবে।” হাসিনা সরকারের মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, “গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের ঘটনা বারে বারেই ঘটেছে বাংলাদেশে। কখনও রক্তাক্ত, কখনও আবার রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল হয়েছে। চক্রান্তকারীদের আর কোনও সুযোগ দিতে চায়
না সরকার। সে জন্যই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কোনও অনির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে না।”
বিএনপি-র কেন্দ্রীয় মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আপত্তি জানিয়েছে হাইকোর্ট। এই নামটা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। আমরা একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার চাই, তার নাম তত্ত্বাবধায়ক না হয়ে অন্য কিছু হলেও অসুবিধে নেই।” ফখরুলের অভিযোগ, শাসক দলই চক্রান্ত করছে। হাইকোর্টের রায়কে ব্যবহার করে সাজানো নির্বাচনে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন শেখ হাসিনা।
বিএনপি-র এই চক্রান্তের অভিযোগ সম্পর্কে হাসিনা সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, “হাস্যকর কথা। ভোট তো সরকার করবে না, করবে নির্বাচন কমিশন। সর্বত্র সেটাই হয়।” ইনু জানান, গত দু’মাসে নির্বাচন কমিশন ছ’টি বড় শহরে কর্পোরেশন নির্বাচন করেছে। সর্বত্র সুষ্ঠু ভাবে ভোট হয়েছে। ছয় শহরেই জিতে মেয়র হয়েছেন বিরোধী প্রার্থীরা। কিন্তু গণনার সময় পর্যন্ত তাঁরা অভিযোগ করে গিয়েছেন, সাজানো নির্বাচন হচ্ছে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, “অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে খালেদা-সহ বিএনপি-র প্রায় সব নেতাকে জেলে পুরেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অথচ সেই ব্যবস্থা ফেরাতে চেয়েই দেশকে অশান্ত করে তুলছে তারা।”
সময় গড়িয়ে চলেছে। তপ্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বসার কোনও সদর্থক উদ্যোগই নেই সরকার ও বিরোধী পক্ষের। আর সেই সুযোগে ফের স্বৈরতন্ত্রই কি ভবিতব্য বাংলাদেশের? |