বিনোদন কাশ্মীরে জুবিনের শান্তিধারা,
বাস্তবের ভূস্বর্গে ঝরল রক্তও

চারশো বছরের পুরনো মুঘল গার্ডেন। চিনার গাছ আর ডাল লেকের জলে সূর্যের অস্তরাগ। এ দিকে বিঠোফেন-মোৎজার্টের সিম্ফনিতে মোহাবিষ্ট পনেরোশো শ্রোতা। জঙ্গি সংগঠনগুলির হুমকি, কাশ্মীর জুড়ে বন্ধের মধ্যেই জুবিন মেটার সুর-মূর্চ্ছনায় ভাসল কাশ্মীর।
জার্মান দূতাবাস আয়োজিত ‘এহসাস-ই কাশ্মীর’ কনসার্ট ঘোষণার দিন থেকেই সঙ্গী ছিল বিতর্ক। জঙ্গি হানা, সেনা-জঙ্গি সংঘর্ষ দেখে দেখে ক্লান্ত কাশ্মীর জুবিনের সোনার কাঠির ছোঁয়ায় নতুন করে বেঁচে উঠবে কি না, তা নিয়ে জল্পনাও চলেছে পুরোদস্তুর। শেষমেশ জয় হল সেই সঙ্গীতেরই। তবে আজও বন্দুকের নল গর্জে উঠেছে উপত্যকায়। যদিও শ্রীনগরে নয়, ৫২ কিলোমিটার দূরের সোপিয়ানে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বিনা প্ররোচনায় সিআরপি জওয়ানরা গুলি চালিয়ে চার যুবককে হত্যা করেছে। সেনাবাহিনীর তরফে জানানো হয়েছে, তাঁদের ছাউনিতে হামলা চালাতেই এসেছিল ওই যুবকেরা। এই গন্ডগোলের রেশ অবশ্য জুবিনের অনুষ্ঠানে পড়েনি।
১৫০০ আমন্ত্রিত অভ্যাগতর সামনে অর্কেস্ট্রায় সুরের ঝঙ্কার তুললেন সাতাত্তর বছরের জুবিন। ট্রাম্পেটে অ্যান্দ্রিয়াস ওটল্। ভায়োলিনে যোগ্য সঙ্গত দিলেন জুলিয়ান রাখলিন। পশ্চিমী ধ্রুপদ সঙ্গীতের মায়া ছড়িয়ে পড়ল আসরের কোনায় কোনায়। অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের সুর-তাল-গন্ধ নিয়ে স্বমহিমায় হাজির ছিল কাশ্মীরও। কনসার্টে আজ সন্তুর পরিবেশন করেন কাশ্মীরেরই শিল্পী অভয় রুস্তম সোপোরি। সন্তুর, রাব্বাব, সারেঙ্গীর মতো দেশীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি।
এ রকম একটা দিন দেখার জন্যই এত দিন অপেক্ষা করেছিলাম মঞ্চে উঠেই জানালেন জুবিন। হিন্দিতে বললেন, ‘হাম বহত খুশ হ্যায়, বহত খুশ হ্যায়।’ তবে আর নিমন্ত্রত দর্শকের সামনে নয়, গোটা কাশ্মীরের সামনেই পরের বার অনুষ্ঠান করতে চান, খোলা গলাতেই জানান কিংবদন্তি এই শিল্পী।

‘এহসাস-ই কাশ্মীর’ কনসার্ট তখনও চলছে। জুবিন মেটার সঙ্গীতে
মেতেছে অভ্যাগতরা। শনিবার মুঘল গার্ডেনে। ছবি: পিটিআই
দেশ-বিদেশ থেকে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গেই এ দিন দর্শকাসনে ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল এন এন ভোরা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা। আর এখানেই আপত্তি বিরোধীদের। কাশ্মীরের বাসিন্দাদের জন্যই যদি এই আসরের আয়োজন করা হয়, দর্শক সংখ্যা বেঁধে দেওয়ায় তাঁদের অংশ নেওয়ার সুযোগ কোথায়। যে কাশ্মীরকে চাঙ্গা করতে এই প্রচেষ্টা, তাঁরা তো সেই বঞ্চিতের দলেই রয়ে গেলেন। মধ্যপন্থী হুরিয়ত নেতা মিরওয়াইজ ওমর ফারুকের কথায়, এহসাস-ই-কাশ্মীর সমাজের মাথাদের অনুষ্ঠান হয়েই রয়ে গেল। বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্যর হাল ফেরাতে ব্যবস্থা নিলে আখেরে কাশ্মীরিদেরই লাভ হতো।
এ দিকে সঙ্গীতের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে সঙ্গীতকেই বেছে নিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলি। মুঘল গার্ডেনে যখন জুবিনের অনুষ্ঠান চলছে, সেই সময়ই কিছু দূরে মিউনিসিপ্যাল পার্কে পাল্টা কনসার্টের আয়োজন করেন মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীরা। বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়েই নাম রেখেছিলেন ‘হকিকত-ই-কাশ্মীর।’
জঙ্গি সংগঠনগুলোর চোখরাঙানির ফলে এ দিন কাশ্মীর জুড়েই ছিল আঁটোসাটো নিরাপত্তার ব্যবস্থা। ডাল লেকের পাড় বরাবর বুলেভার্ড রোড বন্ধ করে দেওয়া হয় নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করতে। কট্টরপন্থী হুরিয়ত নেতা সৈয়দ আলি শাহ্ গিলানি কনসার্টের বিরোধিতায় উপত্যকায় বন্ধের ডাক দিয়েছিলেন এ দিন। ফলে স্কুল, কলেজ, দোকানপাট মোটের উপর বন্ধই ছিল কাশ্মীরে। সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণের হুমকি থাকলেও সারা দিন শান্তই ছিল রাজধানী শ্রীনগর।
দিনে এক বারই কিছুটা তালভঙ্গ হয় সোপিয়ানের ঘটনায়। সকালেই সিআরপি জওয়ানরা জানান, তাঁদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে জঙ্গিরা। সিআরপি-র ইনস্পেক্টর জেনারেল নিলিন প্রভাত দাবি করেন, মোটরবাইকে করে চার যুবক তাঁদের ক্যাম্পের দিকে আসছিল। হঠাৎই তারা গুলি চালাতে থাকে। পাল্টা গুলি চালায় জওয়ানরাও। ঘটনাস্থলেই মারা যায় চার যুবক। নিলিনের দাবি, ওই চার যুবকই আত্মঘাতী হামলা চালানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জওয়ানদের তৎপরতায় সেই ছক বানচাল হয়ে গিয়েছে।
যদিও সিআরপি-র এই দাবি মানতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা জানিয়েছেন, নিহত চার জনই নিরীহ যুবক। কয়েক দিন আগে জঙ্গি হানায় এক সিআরপি জওয়ান মারা যান। তার প্রতিশোধ তুলতেই নির্বিচারে গুলি করে মারা হল ওই চার যুবককে। এই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও দেখায় উত্তেজিত জনতা। বছর উনিশের আদিল ওয়াচকু। সিআরপি হামলার প্রত্যক্ষদর্শী। সিআরপি-র গুলির আঘাতে মারা গিয়েছেন তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু তৌসিফ। আদিলেরও পেটে গুলি লেগেছে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “জুবিন মেটার কনসার্টের জন্য বন্ধ ডেকেছে। রাস্তায় কোনও গাড়িঘোড়া চলছিল না। আজ পরীক্ষা ছিল। তাই তৌসিফকে বললাম মোটরবাইক করে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছে দিতে। সিআরপি ক্যাম্পের সামনে বাইক আটকাল জওয়ানেরা। পরিচয়পত্র দেখাতে বলল। দেরি হয়ে যাচ্ছে বলায় টেনে হিঁচড়ে বাইক থেকে নামিয়ে গালাগালি দিতে লাগল। তার পর হঠাৎই গুলি চালাতে শুরু করল আমাদের লক্ষ্য করে।” আদিল জানালেন, বুকে গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তৌসিফ। বললেন,“ওর কোনও সাড় ছিল না। আমি দেখতে গেলাম। ওরা আমাকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করল। পরে কোনও রকমে তৌসিফকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক বললেন ও মরে গিয়েছে।” অশান্তির খবর মিলেছে পুলওয়ামা থেকেও। কেউ নিহত না হলেও দুষ্কৃতীদের গ্রেনেড হামলায় ১২ জন পুলিশকর্মী-সহ ১৩ জন আহত হয়েছেন।
বন্দুকের নলের সামনে তো প্রতিদিনই দাঁড়ায় কাশ্মীর। আজ না হয় চিনার গাছ চুঁইয়ে পড়ল গান। বন্দুকের গর্জনকে ছাপিয়ে গেল অর্কেস্ট্রার সুর।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.