শেখার কোনও শেষ নেই! চল্লিশ বছর রাজনীতি করে এসে মোক্ষম বুঝছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য!
শেখার কোনও বয়সও নেই! সত্তর পার করে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সইফুদ্দিন সোজ, এ কে অ্যান্টনি, ভায়ালার রবি...!
এই তো সেদিন বাবা খড়্গ সিংহ মার্গে নিজের সরকারি ফ্ল্যাটে বসেছিলেন প্রদীপবাবু। টেবিলে ঝকঝকে একটা স্মার্ট ফোন রাখা। বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললেন, “ভাবা যায়, এখন কিনা এতে রাহুল গাঁধীর ই-মেল আসবে! প্রদেশ দফতরে বরাবর কালো ধ্যাবড়া একটা ফোন ছিল। ক্রিং ক্রিং করে ফোন ঘোরাতাম। আশপাশে না থাকলে হাঁক পেড়ে ডেকে আনত!” সেই প্রদীপবাবু এখন স্মার্টফোন অন করা শিখছেন! অনভ্যস্ত আঙুল স্ক্রিনে বুলিয়ে খুলে ফেললেন ইনবক্স “দ্যাখো, এই ভাবে মেল দেখতে হবে, সেন্ড করতে হবে!”
সবচেয়ে বড় কথা, যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে। হাইকমান্ডের নির্দেশ, সক্কলকেই এ বার থেকে সাইবার-জগতে দড় হতে হবে।
দিল্লিতে এক প্রস্ত কর্মশালা করেছেন রাহুল গাঁধী স্বয়ং। এ বার দেশের ৭৩টি শহরে দলের কর্মীদের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারে সড়গড় করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। আজই হল কলকাতায় প্রথম কর্মশালার উদ্বোধন করে ফেললেন এআইসিসি-র প্রচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত অজয় মাকেন। |
দলীয় কর্মীদের বৈঠকে মোবাইল ক্যামেরা হাতে অজয় মাকেন।
শনিবার সল্টলেকে। ছবি: শৌভিক দে। |
মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কথা! এখন না-হয় রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। না হলে এই ঝক্কি তিনি কি পোহাতেন? রাজি হতেন আদৌ? কেন্দ্রে যখন মন্ত্রী ছিলেন, মোবাইলের টেক্সট মেসেজ খুলে পড়তে পর্যন্ত পারতেন না প্রণববাবু! একসঙ্গে সত্তর-আশিটি টেক্সট মেসেজ টাইপ করে তাঁকে প্রিন্ট আউট দিতেন তাঁর আপ্ত সহায়ক। প্রযুক্তির দিকে এ ভাবে পিঠ ঘুরিয়ে রাখায় উনিশ-বিশের ফারাক ছিল তাঁর সমসাময়িক কম বেশি কংগ্রেসের সব নেতারই।
শুধু কংগ্রেস কেন! এসএমএস-এর প্রিন্ট আউট বার করে দিতে হয় বিজেপির অরুণ জেটলিকেও। দুঁদে উকিল, কৌশলী রাজনীতিক অথচ নতুন প্রযুক্তির সামনে কী অসহায়! নিজের একটা ওয়েবাসাইট আছে বটে। কিন্তু সে তো পেশাদারে সামলায়! সুষমা স্বরাজ জেটলির থেকে এগিয়ে। কিন্তু টুইট করার জন্য ভাড়া-করা লোক আছে। নীতীশ কুমারও তাই। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং প্রচুর এসএমএস করেন, ইদানীং আইপ্যাডে ছবি তোলাও শুরু করেছেন! প্রবীণ লালকৃষ্ণ আডবাণীও ই-দুনিয়ার বাসিন্দা। ব্লগ লেখেন নিজে। ব্লগ সামলানোর আলাদা লোক অবশ্য আছে। কিন্তু সেটা প্রযুক্তি-অজ্ঞতার জন্য নয়। এই বয়সে দিব্যি ই-বুক পড়েন আডবাণী। বিপরীত মেরুর লোক, বয়সেও ছোট। ই-বুক পড়ার একই রকম নেশা সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরির। আইপ্যাডও আছে।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কিন্তু কোনও দিন এ সবের ধার ধারেননি। প্রকাশ কারাট এসএমএস করেন, নিরুপম সেন ই-মেল করেন, নীলোৎপল বসু ফেসবুকে আছেন ব্যস, ওই পর্যন্তই। কংগ্রেসের শশী তারুর বা তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েনের মতো আপাদমস্তক ‘টেক-স্যাভি’ সিপিএমে খুঁজে
পাওয়া মুশকিল।
কংগ্রেসের তরুণ ব্রিগেড রাহুল, সচিন পায়লট, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ারা সবাই প্রযুক্তিতে চোস্ত! বর্ষীয়ানদেরও আধুনিক করে ছাড়ার পণ করেছেন রাহুল। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, আর আঠেরো মাসে বছর নয়! কংগ্রেসে তথ্যের আদানপ্রদান হোক আলোর গতিতে। তাঁর নির্দেশ, সর্বভারতীয় কংগ্রেসের পদাধিকারী থেকে শুরু করে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, পরিষদীয় দলনেতা সকলকেই স্মার্টফোন রাখতে হবে। অথবা এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে ই-মেল সর্বদাই খোলা থাকে। যে কোনও মুহূর্তে জরুরি কোনও বার্তা দিয়ে ই-মেল পাঠাতে পারেন তিনি। বার্তা পাঠানোর পর সঙ্গে সঙ্গে জবাবও চান।
দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার নির্দেশ পৌঁছে দিতে গিয়েই সেদিন ১২ নম্বর তুঘলক লেন থেকে বেরিয়ে হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন এক তরুণ নেতা। বলছিলেন, “সিনিয়র লিডারদের ফাঁপরে ফেলে দিলেন রাহুল। এ বার ঠ্যালা বুঝুন!”
তাই কি! মধ্যপ্রদেশের বর্ষীয়ান প্রদেশ সভাপতি কান্তিলাল ভুরিয়া কিন্তু মানতে চাইলেন না তিনি ফাঁপরে পড়েছেন। বরং স্মার্ট ফোনটি বের করে বললেন, “ভালই তো! শেখার কি আর শেষ আছে!”
কী বলবেন একে? পরিবর্তন? এআইসিসি নেতা শাকিল অহমেদ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাইলেন অন্য ভাবে। তাঁর কথায়, “কংগ্রেসে রাহুলের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এই পরিবর্তন বলতে পারেন ‘অ্যাটাচমেন্ট’ হয়েই এসেছে। জয়পুরে দলের চিন্তন শিবিরের শেষ দিনেই সেটা বোঝা গিয়েছিল।” সেদিন রাহুল বলেছিলেন, “মাঝে মাঝে আমি অবাই হই, শতাব্দীপ্রাচীন এই দল চলছে কী ভাবে?” তার পরেই বেসিক মোবাইলকে সরিয়ে নিঃশব্দে হরেক স্মার্টফোনের প্রবেশ কুর্তার পকেটে।
বিজেপি-র নরেন্দ্র মোদীও প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শুরু করে দিয়েছেন পুরোদমে। এমনকী ক’দিন আগে মোদী এও বলেছেন, “ওয়াটস অ্যাপটা বেশ ভালো লাগছে। ব্যবহার করা সহজ।” গোটা একটা টিম আছে মোদীর, সাইবার-প্রচারের জন্য। আর রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেসের ‘ওয়ার রুম’টা কার্যত চলে বিবিএম আর ই-মেলেই। বর্ষীয়ানদের বলে দেওয়া আছে, পিছিয়ে থাকলে পিছনেই থাকতে হবে!
গাঁধীটুপিতে এখন অগত্যা প্রযুক্তির পালক! |